মার্কিন ব্রিটিশ রুশ জার্মান: নানা ভিন্জাতীয় পরিবারের সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন শহরের বিভিন্ন ডাক্তারি ক্লিনিকের আক্ষরিক অর্থেই নাড়ির টান। এই ক্লিনিকগুলির তদারকিতে রহিয়াছেন বহু ভারতীয় মহিলা, যাঁহাদের গর্ভে ওই সব বিদেশি পরিবারের নূতনতম শিশুরা লালিতপালিত হইতেছে। সারোগেট মাদারহুড বা বিকল্পগর্ভ মাতৃত্ব এখন এ দেশে খুবই প্রচলিত একটি ঘটনা। শিশুহীন বিদেশি দম্পতির শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর কৃত্রিম মিলন ঘটাইবার পর নিজেদের ‘বিকল্প’ গর্ভে তাহা প্রতিস্থাপন করিয়া শিশুর জন্ম দেন এই ভারতীয় ‘মাতা’রা, পরিবর্তে পান কয়েক হাজার ডলার। গরিব দেশের অসংখ্য গরিব সংসারে এই অঙ্ক স্বপ্নসম। ক্লিনিকগুলিরও এই গর্ভ-ব্যবসায়ে লাভ বই ক্ষতি নাই। সুতরাং বিকল্পগর্ভ মাতৃত্বের জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়িতেছে। দক্ষিণ ভারতে এমন অসংখ্য ক্লিনিক আছে, যেখানে একসঙ্গে শতাধিক দেশীয় মাতা বিদেশি সন্তানের জন্ম দিতেছেন। পরিস্থিতি এমনই যে, কে কোথায় কত সংখ্যক বার এই কার্যে লিপ্ত হইতেছেন, তাহার উপর কাহারও কোনও নিয়ন্ত্রণ নাই। বিষয়টি লইয়া মানবাধিকার সংগঠনগুলির অভিযোগ অনেক দিনের। কেন্দ্রীয় সরকার এত দিনে এই ভিন্ন গোত্রের ‘মাতা’দের স্বাস্থ্য-নিরাপত্তার লক্ষ্যে কিছু শর্ত বাঁধিয়া দিল। অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাকটিভ টেকনলজি (এ আর টি) বিল আপাতত সংসদে হাজির হইবার অপেক্ষায়।
প্রস্তাব বলিতেছে, বিকল্পগর্ভা মাতাদের বয়স অবশ্যই ২১-এর উপরে এবং ৩৫-এর নীচে হইতে হইবে। সব মিলাইয়া (নিজেদের সন্তান-সহ) তিন বারের বেশি গর্ভধারণ করা যাইবে না। দুটি গর্ভধারণের মধ্যে অন্তত দুই বৎসরের ব্যবধান থাকিতে হইবে। দুঃস্থ পরিবারের মহিলারা বহু ক্ষেত্রেই বার বার এই উপায়ে অর্থোপার্জনে আকৃষ্ট হন, যাহা সমস্যার বিষয়। আরও সমস্যা হয়, যখন পরিবারের পুরুষরা সহজ অর্থাগমের লক্ষ্যে মহিলাদের এই কাজে বাধ্য করেন। শিক্ষার অভাব ও সামাজিক অসচেতনতার কারণে সম্ভাব্য বিপদগুলি বিষয়ে ইঁহারা যথেষ্ট অবহিত নহেন। বেশ কিছু ক্ষেত্রে দুই-তিন সন্তানের দারিদ্রক্লিষ্ট মা বিকল্পগর্ভা মাতা হইতে চাহিয়া শেষ পর্যন্ত জন্মদানের ধকল সামলাইতে না পারিয়া মৃত্যুবরণ করিয়াছেন, অথচ তাঁহার শিশুদের বা পরিবারের কোনও ক্ষতিপূরণ মেলে নাই।
প্রস্তাবিত বিল অনুসারে প্রতি ক্ষেত্রে এক জন স্থানীয় প্রযত্নকারী নির্ধারণ করা জরুরি। আর একটি গুরুতর উদ্বেগ এখানেই। বাঞ্ছিত শিশুর প্রকৃত পিতামাতা বিদেশি নাগরিক, তাই জন্মের আবশ্যিক উপাদান শুক্রাণু-ডিম্বাণু প্রদান করিয়াই তাঁহারা ঝাড়া হাত-পা, বিকল্পগর্ভা মাতাদের প্রয়োজনীয় যত্ন, পুষ্ট, ঔষধের দায়িত্ব তাঁহাদের নহে। বিদেশি বহুজাতিক সংস্থার তৃতীয় বিশ্বের অবহেলিত কারখানাগুলিতে যে দায়হীনতার সমস্যা থাকে, এখানেও ঠিক তাহাই। আবার, যে পরিবারের মহিলা গর্ভ দান করিতেছেন, শিশু সেই পরিবারের সদস্য হইবে না বলিয়া পরিবারও দেখভালের দায় বহন করিতে অনুৎসুক। সকলের সম্মিলিত দায়হীনতার অবকাশে এক বিরাট সংখ্যক ভারতীয় নাগরিকের যে ক্ষতি সাধিত হইতেছে, কোনও তৃতীয় পক্ষের প্রযত্নে তাহা সত্যই রোধ করা সম্ভব কি? সবচেয়ে বড় কথা, জৈবিকসূত্রের পিতামাতার আগ্রহ ব্যতিরেকে, কোনও আইন দ্বারা আদৌ এমন দায়বোধ নির্মাণ করা সম্ভব কি? এই ধরনের প্রশ্নের কোনও সহজ উত্তর নাই বলিয়াই বিশেষ সতর্কতা জরুরি। |