পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নিজেকে ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ বিশেষণ দিয়াছিলেন। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার আন্দোলনের মোকাবিলায় তাঁহার তৎপরতা সেই স্বরচিত ভাবমূর্তির সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেন্দ্রীয় সরকার স্বতন্ত্র তেলঙ্গানাকে সবুজ সংকেত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের নানা অঞ্চলে রাজ্য-ভাগের আন্দোলনে নূতন ইন্ধন পড়িবে, তাহা জানা ছিল। সুতরাং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁহার প্রশাসন মানসিক প্রস্তুতির সময় পাইয়াছিলেন। তাঁহারা সেই অবকাশটিকে কাজে লাগাইয়াছেন। আন্দোলনের মোকাবিলায় প্রশাসনের বহুমুখী অভিযান তাহার প্রমাণ। মোর্চার নেতারা সম্ভবত এই তৎপরতা অনুমান করেন নাই। তাঁহাদের কথাবার্তা ও আচরণ বিচার করিলে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, তাঁহারা কিঞ্চিৎ বিভ্রান্ত। হয়তো বা, সন্ত্রস্তও। মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই দাবি করিবেন, তিনি শুরুতেই বিমল গুরুঙ্গকে কোণঠাসা করিয়া ফেলিয়াছেন।
পাহাড়ে আন্দোলন অবশ্যই আইনশৃঙ্খলার সমস্যা সৃষ্টি করিতে পারে। বড় সমস্যা। অতীতেও বারংবার তাহা ঘটিয়াছে। জনজীবন বিপর্যস্ত হইয়াছে। পর্যটনের বিপুল ক্ষতি হইয়াছে। প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতিও এই আন্দোলনের হিংসাত্মক ঐতিহ্যের সহিত ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিল, আছে এবং, আশঙ্কা হয়, থাকিবে। সুতরাং এই আন্দোলনের মোকাবিলায় কঠোর হওয়া প্রশাসনের কর্তব্য। সেই কর্তব্যকে দলীয় রাজনীতির হিসাবনিকাশের বাহিরে রাখাও জরুরি। বামফ্রন্ট জমানায় এই বিষয়ে বিলক্ষণ ত্রুটি ও বিচ্যুতি দেখা গিয়াছিল। সেই ঐতিহ্যের ‘পরিবর্তন’ স্বাগত। পাশাপাশি, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের উন্নয়নের স্বার্থে জি টি এ’র কাজ চলমান রাখিবার চেষ্টাও আবশ্যক, রাজনৈতিক বাস্তবের বাধ্যবাধকতায় সেই কাজ যদি সাময়িক ভাবে রাজ্য প্রশাসনকেই পরিচালনা করিতে হয়, হইবে। আইনশৃঙ্খলা এবং উন্নয়নের দ্বৈত পরিপ্রেক্ষিতেই স্বরাষ্ট্রসচিবের দার্জিলিং সফর তাৎপর্যপূর্ণ।
আন্দোলনের মোকাবিলা এবং সমস্যার সমাধান কিন্তু এক নহে। আন্দোলন সমস্যার ফল বা তাহার প্রকাশ। দার্জিলিঙের মূল সমস্যাটি রাজনৈতিক। তাহার সমাধানও রাজনৈতিক পদ্ধতিতেই করিতে হইবে। এবং, কেবল নীতির কারণে নয়, বাস্তবের প্রয়োজনেও এ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পথই সরকারের অনুসরণীয়। তাহা আলোচনার পথ। আন্দোলনকারীদের সহিত সরকারের মত বা অবস্থানের পার্থক্য থাকিলেও আলোচনা জারি রাখিতে হইবে, মতবিনিময়ের মাধ্যমেই সেই পার্থক্য নিরসনের উপায় সন্ধান করা যায়, অন্য গণতান্ত্রিক উপায় নাই। প্রশাসনিক কঠোরতার সহিত আলোচনার রাজনীতির কোনও বিরোধও নাই, বরং প্রশাসন যদি ন্যায়ের পথে থাকে, তবে তাহার কঠোরতা আলোচনাকে ফলপ্রসূ হইতে সাহায্য করে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসিবার পরে প্রথম পর্বে আলোচনার উপর জোর দিয়াছিলেন। কেবল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সহিত নয়, সাধারণ ভাবেই। তাহার সুফলও মিলিয়াছিল, এমনকী দার্জিলিঙেও পরিবেশের উন্নতি সম্ভবত সম্পূর্ণ অন্তঃসারশূন্য ছিল না। কিন্তু দেখিতে দেখিতে সর্বদলীয় বা বহুপাক্ষিক মতবিনিময়ের পরিবেশটি অন্তর্হিত হয়, দ্বিগুণ বিক্রমে ফিরিয়া আসে ‘আমরা-ওরা’র আস্ফালন। বিরোধী শিবিরও নিশ্চয়ই তাহাতে ইন্ধন জোগাইয়াছে। ‘পাহাড় অট্টহাস্য করিতেছে’ বলিয়া আজ বামফ্রন্টের রাজ্য সম্পাদকের কণ্ঠে যে বক্রোক্তি, তাহা তাঁহাদের অন্তর্নিহিত মানসিকতাকেই চিহ্নিত করে, বুঝাইয়া দেয় যে তাঁহারা দলের ঊর্ধ্বে উঠিতে পারেন না। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভুলিতে পারেন না যে, এখন তিনি বিরোধী নেত্রী নহেন, মুখ্যমন্ত্রী, সুতরাং গণতান্ত্রিক আলাপ আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি এবং লালনের দায় তাঁহারই। সেই পরিবেশ নষ্ট হইলে শেষ অবধি রাজ্যেরই ক্ষতি। |