অভিনেতা থেকে পরিচালক। পরিচালক থেকে অভিনেতা।
সিনেমার ইতিহাসে অনেক দিন অবধি প্রথম ঘটনাটা অনেক বেশি ঘটতে দেখা যেত। ইদানীং দ্বিতীয়টা বেশি ঘটছে। কিন্তু বুধবার বিকেলে যে ঘটনাটা ঘটল, সেটা এর আগে বাংলা সিনেমায় ঘটেনি। এক জন নয়, দু’জন নয়, একসঙ্গে চার-চার জন ডাকসাইটে পরিচালক রাজি হয়ে গেলেন একসঙ্গে একটা ছবিতে অভিনয় করতে।
এত দিন বাঙালি দর্শক এই ট্যাগলাইনগুলো দেখত ‘আ ফিল্ম বাই অপর্ণা সেন’, ‘গৌতম ঘোষের ছবি’, ‘ডিরেক্টেড বাই কৌশিক গাঙ্গুলি’ বা ‘অঞ্জন দত্তের ছবি’। এ বার দেখবে শ্রেষ্ঠাংশে অপর্ণা সেন, গৌতম ঘোষ, অঞ্জন দত্ত, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়...। পরিচালনা? সৃজিত মুখোপাধ্যায়।
অপর্ণা-অঞ্জন তো আগে অভিনেতা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। সৃজিত নিজে অপর্ণা-অঞ্জন-কৌশিকের ছবিতে অভিনয় করে ফেলেছেন। কৌশিক নিজের ছবির বাইরেও অভিনয় করা শুরু করেছেন। পরিচালক গৌতম ঘোষও নতুন করে অভিনেতা হয়ে ফিরে এসেছেন সৃজিতেরই ‘বাইশে শ্রাবণে’!
এ বার ‘চতুষ্কোণ’ এই আয়তক্ষেত্রটা সম্পূর্ণ করতে চলেছে। বুধ-বিকেলে বাইপাসের ধারে অপর্ণা সেনের ফ্ল্যাটে বসে সব কিছু ঠিক হয়ে গেল। শ্যুটিং শুরু নভেম্বরের শেষে। |
বুধবার অপর্ণা সেনের বাড়িতে, বৈঠক শেষে। ছবি: প্রযোজকের সৌজন্যে |
সঙ্গে রয়ে গেল একটা বিষাদের ছায়াও। অনেক দিন ধরেই এই ছবিটার পরিকল্পনা বহু দিন ধরেই করছিলেন সৃজিত। অপর্ণা-গৌতম-অঞ্জনের সঙ্গে অভিনয় করার কথা ছিল ঋতুপর্ণ ঘোষের। কিন্তু ঋতুপর্ণর আকস্মিক মৃত্যুর পর ছবিটা আদৌ হবে কিনা তা নিয়েই একটা অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এখন ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিবর্তে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় অভিনয় করবেন বলে ঠিক হয়েছে। কৌশিক বলছেন, “আমার খুব এক্সাইটিং লাগছে, কারণ অপর্ণা সেন আমার সহ-অভিনেত্রী এই ছবিতে। এর থেকে বড় ফ্যান্টাসি আমার পক্ষে কিছু হতেই পারে না। তার উপর শ্যুটিংয়ের ফাঁকে যত আড্ডা-তর্ক-বিতর্ক হবে, তা মানুষ এবং পরিচালক হিসেবে আমাকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করবে বলেই আমার ধারণা।”
এ রকম একটা হেভিওয়েট ছবির পরিচালনা করতে পেরে গর্বিত সৃজিত মুখোপাধ্যায়ও। ওঁর কথায়, “চতুষ্কোণ’-এর স্ক্রিপ্টটা আমি লিখেছিলাম ‘অটোগ্রাফ’-এর ঠিক পরেই। এই ছবিটা রীনাদি, গৌতমদা, কৌশিকদা, অঞ্জনদাএই চার পরিচালককে আমার ট্রিবিউট বলতে পারেন। ঋতুদা চলে যাওয়ার পর কৌশিকদার মতো করে চরিত্রটা আমি রি-রাইট করেছি। ওঁরা সবাই সময় বার করেছেন আমার ছবির জন্য, আমি কৃতজ্ঞ।”
বর্লিউডেও আজকাল পরিচালকরা একে অন্যের ছবিতে প্রায়ই মুখ দেখাচ্ছেন। অনুরাগ কাশ্যপের ছবিতে কর্ণ জোহর অভিনয় করতে নামছেন তো ওনিরের ছবিতে অনুরাগ! ফারহান আখতার ‘মিলখা সিংহ’ সেজে চমকে দিচ্ছেন তো ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুরে’ টিগমাংশু ঢুলিয়া! বাংলা ছবিতেও এই ট্রেন্ডটা কিছু দিন ধরেই দেখা যাচ্ছিল! ঋতুপর্ণকে প্রথম অভিনয় করতে দেখা যায় কৌশিকের ছবিতেই। আবার ঋতুপর্ণ ‘কহানি’র মোড় ঘুরিয়ে দেন সুজয় ঘোষকে ব্যোমকেশ বানিয়ে! অনেকটা যে রকম চমক ছিল বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘গৃহযুদ্ধ’য় গৌতম ঘোষের অভিনয় বা মৃণাল সেনের ‘আকালের সন্ধানে’-তে রাজেন তরফদার!
কিন্তু একসঙ্গে চার জন? এটা আগে হয়নি। গল্পটা আসলে চার জন চিত্রপরিচালককে নিয়েই, জানাচ্ছেন সৃজিত। সেই কারণেই চার জন পরিচালককে অভিনেতা হিসেবে নেওয়া। তবে কারণ যাই হোক না কেন, ঘটনাটার অভিনবত্বই তোলপাড় ফেলেছে টলিপাড়ায়। রীতিমতো ‘কাস্টিং ক্যু’ বলেই ধরা হচ্ছে এটাকে। পরিচালক রাজ চক্রবর্তী বলছেন, “মাল্টি-স্টারারের সংজ্ঞাটাই বদলে দিল সৃজিত। বাংলা ছবির পক্ষে এটা খুব ভাল খবর। ” ‘অভিনেতা’রাও ভারী উত্তেজিত। গৌতম বলছেন, “আমি শুধু আমার রোলটা নিয়ে পড়াশুনো করছি, অ্যাবসর্ব করছি। অপর্ণা আমার ছোটবেলার বন্ধু। অঞ্জন আমার এবং আমার স্ত্রীর বহুদিনের পরিচিত। আমাদের পরের প্রজন্মের পরিচালক হিসেবে কৌশিক আমার খুব প্রিয়। একসঙ্গে কাজ করতে দারুণ মজা হবে।” আবার অপর্ণা বলছেন, “বেশ ভয় করছে। অঞ্জন আর কৌশিক এত ভয়ানক ভাল অভিনয় করে! আমি আর গৌতম বরং কাছাকাছি আছি! খুব চ্যালেঞ্জিং হবে!”
যৌথ ভাবে ছবিটি প্রযোজনা করছেন রানা সরকার ও রিলায়্যান্স এন্টারটেনমেন্ট। রানা জানেন, শুধু দর্শক নয়, গোটা ইন্ডাস্ট্রিরই চোখ থাকবে এই ‘চতুষ্কোণ’য়ের উপর। “এটা তো সত্যি একটা বিশাল ব্যাপার। আশা করি আমারা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারব!’’
চার জন পরিচালক-অভিনেতার অভিনয় আর এক জন পরিচালক-অভিনেতার পরিচালনা! চতুষ্কোণ নিয়ে উত্তেজনা এখনই পঞ্চমে! |