তিনি ইতিহাসবিদ ও সাহিত্যিক। ভারত ও ইসলামি দুনিয়া ফিরে ফিরে আসে তাঁর লেখায়। সাম্প্রতিক বইয়ের প্রেক্ষাপট প্রথম ইঙ্গ-আফগান যুদ্ধ। সেই বই, ‘রিটার্ন অফ আ কিং দ্য ব্যাটল ফর আফগানিস্তান ১৮৩৯-১৮৪২’-এর প্রকাশ অনুষ্ঠানে সম্প্রতি বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন তিনি উইলিয়াম ডালরিম্পল। যে মন্তব্য ঘিরে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। গত শনিবার জালালাবাদে ভারতীয় কনসুলেটের গা ঘেঁষে জঙ্গি হামলার পর যে মন্তব্য আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
 |
উইলিয়াম ডালরিম্পল |
একটি পাক সংবাদপত্রের খবর, সম্প্রতি করাচির ‘ইন্দাস ভ্যালি স্কুল অফ আর্ট অ্যান্ড আর্কিটেকচার’-এ নতুন বইয়ের প্রকাশ অনুষ্ঠানে ডালরিম্পল মন্তব্য করেন, মার্কিন সেনা সরে গেলে আফগানিস্তান হয়ে উঠতে পারে দ্বিতীয় কাশ্মীর! এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আরও একটা ছায়াযুদ্ধ শুরু হতে পারে। ভারত অস্ত্র করবে হামিদ কারজাইকে, পাকিস্তান অস্ত্র করবে তালিবানকে।”
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন আফগানিস্তানে। এমন কথাও সাফ লিখেছেন, ‘আফগানিস্তানে পুতুল-শাসক (স্পষ্টতই ইঙ্গিত কারজাইয়ের দিকে) বসিয়ে আগেও লাভ হয়নি, এখনও হবে না।’ কিন্তু কাশ্মীরের অনুষঙ্গ কেন? কারণ, ভারত ও ইসলামি দুনিয়া নিয়ে ১০টি গ্রন্থের রচয়িতা ডালরিম্পল মনে করছেন, আফগানিস্তানে বর্তমান যুদ্ধের কেন্দ্রে রয়েছে ভারত-পাক বৈরিতা। এবং কালক্রমে তা আরও বাড়বে বই কমবে না। দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে এই সংঘর্ষ আফগানিস্তান তো বটেই, গোটা বিশ্বের নিরাপত্তার পক্ষেই বিপদের কারণ হয়ে হয়ে উঠতে পারে। এমনকী ডালরিম্পল এ-ও বলেছেন, “পাকিস্তান পরমাণু কৌশলের দিকে ঝুঁকছে বলেই খবর আসছে।” কিন্তু এ সব সত্ত্বেও আমেরিকা জেনে-বুঝে বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে বলে তাঁর অভিযোগ।
স্বভাবতই মার্কিন কূটনীতিকরা ডালরিম্পলের এই মন্তব্যে অখুশি। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি বারাক ওবামার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে পড়ে। সম্প্রতি কাবুল প্রশ্নে ভারত-পাকিস্তানকে এক টেবিলে বসানোরও একটা প্রবল চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে ওয়াশিংটনের তরফ থেকে। জোর দেওয়া হচ্ছে আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং অর্থনৈতিক প্রকল্পের উপর। সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূত একসঙ্গে সাংবাদিক সম্মেলন করে কাবুলে ভারতের উপস্থিতিকে একযোগে স্বাগতও জানিয়েছেন। নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত এক মার্কিন কূটনীতিকের বক্তব্য, ডালরিম্পল মূলত সাহিত্য জগতের মানুষ। এই জটিল পরিস্থিতিতে যখন শান্তি প্রক্রিয়া জোরদার করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তখন তাঁর এই পর্যালোচনা কোনও ভাবেই সহায়ক হবে না। যদিও ওই কূটনীতিকের মন্তব্যের পাল্টা অনেকেই বলছেন, ডালরিম্পল শুধু সাহিত্যিক নন, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিকও বটে। আফগানিস্তানের পরিস্থিতি তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। সুতরাং তাঁর পর্যবেক্ষণ একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ‘হোয়াইট মুঘলস’-এর রচয়িতার মতে, পশ্চিমের বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ এই প্রচারই করে যাচ্ছেন যে, আফগানিস্তানের বর্তমান যুদ্ধ চলছে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর সঙ্গে আল কায়দা এবং তালিবানের। কিন্তু তাঁরা সমস্যার গভীর পর্যন্ত দেখেন না। আবার আফগানিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, এই যুদ্ধ আসলে হামিদ কারজাই সরকারের বিরুদ্ধে পাখতুন নেতাদের বিদ্রোহ। কারণ, পাখতুনরা মনে করেন, কারজাই জমানায় তাজিক, উজবেক এবং হাজারা সম্প্রদায়ের লোকেরা সংখ্যালঘু হয়েও সর্বত্র সুবিধা পেয়ে আসছে।
ডালরিম্পলের মতে, এই দু’টি পর্যবেক্ষণই আংশিক। প্রকৃতপক্ষে কাবুলের মাটিতে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে বেড়ে ওঠা উত্তেজনাই সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক। তাঁর কথায়, “ভারত হল এমন এক দেশ, যাকে গোটা বিশ্ব মনে করছে আগামী প্রজন্মের সুপার পাওয়ার। সফটওয়্যারে তার ব্যুৎপত্তি বাকি বিশ্বকে ছুঁয়েছে। দ্রুত বাড়ছে অর্থনীতির লেখচিত্র। অন্য দিকে, পাকিস্তান বিশ্বের কাছে উন্মোচিত হয়ে গিয়েছে মৌলবাদ, ওসামা বিন লাদেনের আশ্রয়দাতা দেশ হিসেবে।”
দিল্লি অবশ্য নওয়াজ শরিফ নতুন পাক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর সতর্কতার সঙ্গেই আস্থাবর্ধক পদক্ষেপে ভরসা রাখার পক্ষপাতী। তবে জালালাবাদের হামলায় সেই ভাবনা কিছুটা হলেও ধাক্কা খেয়েছে, কারণ সন্দেহের তির পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের দিকেই। সাউথ ব্লকও এই ঘটনাকে ভারতের উপর আক্রমণ হিসেবেই দেখছে। এই পরিস্থিতিতে ডালরিম্পলের মন্তব্য নতুন বিতর্ক উস্কে দিল বলেই মনে করা হচ্ছে। |