লাশের রাজনীতি ঘিরে পরিস্থিতি লাগামছাড়া হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই আত্মঘাতী গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা সমর্থক মঙ্গল সিংহ রাজপুতের দেহ নিয়ে মিছিলে প্রচুর পুলিশ এবং সিআরপি মোতায়েন করেছিল প্রশাসন। শেষ পর্যন্ত সোমবার দুপুরে কালিম্পঙে ভালোয় ভালোয় অন্ত্যেষ্টি পর্ব মিটে যাওয়ায় তারা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। মঙ্গল সিংহের শেষযাত্রা ঘিরে জনস্রোত বা উন্মাদনা এ দিন দেখা যায়নি পাহাড়ে। যা কিছুটা হলেও স্বস্তি বাড়িয়েছে পুলিশ-প্রশাসনের।
বিমল গুরুঙ্গের দল কর্তৃত্ব কায়েমের পরে একাধিক বার লাশের রাজনীতি দেখেছে পাহাড়। দেহ নিয়ে মিছিলের সময় কখনও রোহিণীতে সরকারি বাংলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কখনও থানা আক্রমণ হয়েছে। কখনও ঘটেছে পুলিশ নিগ্রহের ঘটনা। |
ফলে পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবি নিয়ে নতুন করে আন্দোলন শুরু হওয়ার পরে এ দিনের শোকযাত্রাও রণংদেহী হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। বিশেষ করে কালিম্পং শহর ও লাগোয়া এলাকার প্রতিটি বাড়ি থেকে অন্তত এক জনকে মিছিলে সামিল হওয়ার জন্য মোর্চার তরফে ফতোয়া জারি করার পরে। এই ফতোয়ার নিরিখে কালিম্পঙের ডম্বর চকে অন্তত ১০-১২ হাজার লোক জমায়েত হবেন বলে মনে করেছিল প্রশাসন। কিন্তু এ দিন বিকেলের দিকে অন্ত্যেষ্টি পর্ব মিটে যাওয়ার পরে এক পুলিশ কর্তার দাবি, ভিড়টা হাজার তিনেকের আশপাশেই ছিল। এবং অন্যান্য বারের তুলনায় অনেক নিয়ন্ত্রিত। |
মোর্চার তরফে অবশ্য বলা হচ্ছে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কোনও অভিপ্রায়ই তাদের ছিল না। তারা যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে চায়, এই সুশৃঙ্খল মিছিলের মাধ্যমে সেই বার্তাই দেওয়া হয়েছে। রাজ্যের তরফে চাপ সৃষ্টি করা সত্ত্বেও শোক মিছিলে মোর্চা সমর্থকদের স্বতঃস্ফূর্ত ঢল নেমেছিল বলে দাবি করে গুরুঙ্গ বলেন, “এই ভিড় হওয়াটা বড় ব্যাপার নয়। এমন ‘টার্নিং পয়েন্ট’ আগামী দিনেও আসবে। মানুষ আরও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে পথে নামবেন।” মোর্চার ফতোয়া সত্ত্বেও ভিড় না-হওয়াটাকে কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন প্রশাসনিক কর্তাদের একাংশ। পাহাড়ের মানুষের আবেগকে অস্বীকার না-করেও তাঁদের বক্তব্য, যে কায়দায় অনির্দিষ্টকাল বন্ধ ডেকে জনজীবন স্তব্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, তা মোর্চার কর্মী-সমর্থকদের অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না। মোর্চার নেতা-কর্মীদের একাংশের তরফে নানা ভাবে সেই বার্তা দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি পুলিশেরও।
শোক সমাবেশে অংশগ্রহণকারী কালিম্পঙের লাগোয়া এলাকার ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের একাংশ নাম না-প্রকাশের শর্তে বলেছেন, “আলাদা রাজ্যের দাবি নিয়ে আমাদের আবেগ রয়েছে। আন্দোলনও চাই। তা বলে যখন জিটিএ-কে ঘিরে কাজকর্ম হচ্ছে, পর্যটকদের ঢল নামছে, তখন বন্ধ না-করে আমাদের নেতাদের অন্য কিছু করার কথা ভাবতে হবে।”
এ দিনই দার্জিলিঙের ‘সিটিজেন্স ফোরাম’-এর মুখপাত্র বিজয় কুমার প্রধান, সিকিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য মহেন্দ্র পি লামার মতো বিশিষ্ট জনেরা লিখিত বিবৃতিতে জানিয়েছেন, পাহাড়ে শান্তি বজায় রাখার আর্জি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা।
ঘটনা হল, জিটিএ চুক্তির পরে দু’টি পর্যটন মরসুমে পর্যটকদের ঢল নামায় দার্জিলিঙের অর্থনীতি অনেকটাই চাঙ্গা হয়ে ওঠে। পুজোর মরসুম শুরু হতে আর মাসখানেক বাকি। সে জন্য নানা মহল থেকে পর্যটন ক্ষেত্রে বহু টাকা বিনিয়োগও হয়েছে। বড় মাপের ব্যবসায়ীরা তো বটেই, ছোট মাপের দোকানদার, পরিবহণ শিল্পে যুক্ত চালক, খালাসি, মজুররাও বাড়তি উপার্জনের আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু, অনির্দিষ্টকাল বন্ধ, তার উপরে লাশের রাজনীতি দেখে সকলেই খানিকটা যেন সিঁটিয়ে গিয়েছেন। সমাবেশ থেকে ফেরার পথে কালিম্পং বাস স্ট্যান্ড এলাকার কয়েক জন খালাসি, গাড়ির চালক বললেন, “চাল-ডাল-তেল-নুন ফুরিয়ে যেতে বসেছে। জমানো টাকা ফুরিয়ে আসছে। এ ভাবে কত দিন চলবে?”
দু’দিক কী করে সামলাবেন, সেটাই মোর্চা নেতাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। |