পাহাড় পরিস্থিতির রাশ কড়া হাতে ধরতে সোমবার রাজ্য সরকার গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার উপরে চাপ আরও বাড়াল। সরকারি সূত্রের খবর, মহাকরণের নির্দেশে পুরনো মামলায় অভিযুক্ত মোর্চার প্রথম সারির নেতাদের ধরতে অভিযান শুরু হল সোমবার। বিকেলের মধ্যে বিমল গুরুঙ্গের অন্যতম ঘনিষ্ঠ তথা জিটিএ সদস্য অনিত থাপাকে কার্শিয়াং থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গুরুঙ্গ-ঘনিষ্ঠ অনিত।
|
অনিত মোর্চার আন্দোলনের গোড়া থেকে গুরুঙ্গের ছায়াসঙ্গী বলে পরিচিত।
মোর্চার অন্যতম সংগঠন ‘গোর্খাল্যান্ড পার্সোনেল’ (জিএলপি)-র যে সদস্যদের নামে নানা মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে, তাদেরও শীঘ্রই গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য সরকার। অনিতের গ্রেফতারির খবর চাউর হওয়া মাত্র কার্শিয়াং থানা ঘেরাও করেছে মোর্চা।
এর আগে বন্ধের প্রথম দিন, শনিবার রাম্মাম এলাকায় দু’টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র অচল করে দেওয়ার অভিযোগে জিটিএ সদস্য প্রকাশ গুরুঙ্গকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তখনও দার্জিলিং থানা ঘেরাও করেছিল মোর্চা। তবে পাহাড়ের লোকজনই বলছেন, মোর্চায় অনিতের গুরুত্ব অনেক বেশি। মোর্চা প্রধান গুরুঙ্গ নিজে মুখ খুলেছেন এই গ্রেফতারির প্রতিবাদে। |
জানিয়েছেন, “অনিত কোনও দোষ করেনি।” উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবের অবশ্য বক্তব্য, “অপরাধ করলে গ্রেফতার তো হতেই হবে।” পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, পুরনো মামলায় অনিতের বিরুদ্ধে এক সময় গ্রেফতারি পরোয়ানা বেরিয়েছিল। তার ভিত্তিতেই গ্রেফতার করা হয়েছে তাঁকে। পুরনো মামলা তুলে এনে যে মোর্চার উপরে চাপ বাড়ানো হবে, সেটা রবিবারই মহাকরণ থেকে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। গুরুঙ্গ, রোশন গিরির বিরুদ্ধেও এমন মামলা সামনে এনে তাঁদের পাসপোর্ট বাতিলের আবেদন ইতিমধ্যেই কেন্দ্রের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে রাজ্য। একেবারে পাশের লোক গ্রেফতার হওয়ায় কিছুটা সাবধানী হয়েছেন গুরুঙ্গ। মোর্চার অন্দরের খবর, গ্রেফতারি এড়াতে দলের প্রথম সারির নেতা-কর্মীদের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। বার্তা দিয়েছেন, ‘আপাতত কিছুটা পিছু হটতে হবে’। মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতা ইতিমধ্যেই বাড়ি ছেড়ে জিএলপি-র ‘ক্যাম্প’-এ থাকার প্রস্তুতি নিয়েছেন। গুরুঙ্গ দার্জিলিঙে বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী আন্দোলন মোকাবিলার নামে তাকে দমন করতে চাইছেন।”
একই সঙ্গে আজ, মঙ্গলবার থেকে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ানোর কথাও স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন মোর্চা প্রধান। আজ পাহাড়ে আসছেন স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন গিয়েছেন ডিজি আইবি। শীঘ্রই যাচ্ছেন জাভেদ শামিম-সহ আরও একাধিক অফিসার। পাহাড়ে প্রশাসনের এই কার্যত ‘কন্ট্রোল রুম’ খুলে ফেলার মুখে গুরুঙ্গের হুঁশিয়ারিকে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছে প্রশাসনের একাংশ। এর পাশাপাশি নানা ভাবে প্রশাসনকে চাপে ফেলার কৌশলও নিতে শুরু করেছে মোর্চা। এই কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে জিএলপি-কেও। |
এ দিনই কার্শিয়াং ও দার্জিলিঙের দুই থানার দু’জন শীর্ষ অফিসারের বাড়িতে গিয়ে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে জিএলপি-র বিরুদ্ধে। মোর্চার অভিযোগ, ওই দু’জন পাহাড়ের আবেগ-বিরোধী কাজকর্ম করে রাজ্যকে সাহায্য করছেন। নিরাপত্তার স্বার্থে ওই দু’জনকে আপাতত অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। তবে কলকাতায় রাজ্য সরকারের এক জন শীর্ষ কর্তা জানান, মোর্চা দু’জনকে সরানোর ছক কষলে তাঁরাও মোর্চার বিরুদ্ধে চার গুণ কড়া পদক্ষেপ করতে দ্বিধা করবেন না। জিএলপি সদস্যদের সম্পূর্ণ তালিকাই রয়েছে রাজ্য সরকারের কাছে।
মোর্চা যে জিএলপিকে হাতিয়ার করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সে খবর মহাকরণেও পৌঁছেছে। এ দিন লেবঙে জিএলপি সদস্যরা ‘প্যারেড’ ও ‘রুট মার্চ’ করেছেন। ঠিক যে ভাবে রাজ্য সশস্ত্র বাহিনীর জওয়ানরা কম্যান্ডান্টের নির্দেশে ‘মার্চ পাস্ট’ করেন। এই বিষয়টিকে ভাল ভাবে নেয়নি রাজ্য প্রশাসন। মহাকরণের এক কর্তা বলেন, “কোথাও কোনও গোলমাল হলে জিএলপি-র কর্মীরা সেখানে ছুটে যাচ্ছেন। লোকজনকে সরিয়ে দিচ্ছেন। এলাকার দখল নিচ্ছেন। তাঁদের হাবভাব এমনই যে, ওঁরাই পাহাড়ের পুলিশ। এটা বরদাস্ত করা যায় না।” সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, যে সব জিএলপি সদস্যর বিরুদ্ধে আগের নানা মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে, তাঁদের সকলকে যত দ্রুত সম্ভব গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যেই ২৫ জন জিএলপি সদস্য গ্রেফতার হয়েছেন বলে জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। জিএলপি-র কিছু কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় মোর্চার ওই ‘স্বেচ্ছাসেবী’ সংগঠনের বিরুদ্ধে আরও কোনও কঠোর পদক্ষেপ করার কথা কি ভাবছে রাজ্য? সন্ধ্যায় এই প্রশ্ন করা হলে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “আমি সব জানি। যা বলার পরে বলব।”
এ দিন পুলিশ-প্রশাসনের তরফে পাহাড়ে সরকারি অফিস খোলা রাখার চেষ্টা হয়। দার্জিলিঙের অতিরিক্ত জেলাশাসক ও মহকুমাশাসক অফিসে ঢোকেন। তবে অধিকাংশ এলাকায় মোর্চার পিকেটিংয়ে প্রায় কোনও কর্মীই অফিসে ঢুকতে পারেননি। মোর্চা নেতা বিনয় তামাং বলেন, “রাজ্য ব্যর্থ হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে।”
|
মোর্চা আর মমতা, দু’পক্ষকেই সঙ্গে রাখতে চাইছে বিজেপি
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
বিমল গুরুঙ্গ ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে ভারসাম্য রেখেই এগোতে চাইছে বিজেপি। আগামী লোকসভা নির্বাচনে ফের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা খোলা রাখতে চাইছেন বিজেপি নেতৃত্ব। আবার তৃণমূলকেও সম্ভাব্য জোট শরিক হিসেবে দেখছেন তাঁরা। বিজেপি ও আরএসএসের শীর্ষ নেতৃত্বের বৈঠকে ঠিক হয়েছে, যে সব আঞ্চলিক দলের সঙ্গে জোটের সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সুর চড়ানো হবে না। তাই গুরুঙ্গদের বাড়তি সহানুভূতি দেখিয়ে মমতাকে চটাতে চাইছে না বিজেপি। আজ রোশন গিরির নেতৃত্বে মোর্চা নেতারা সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। রোশনের দাবি, বিজেপি সংসদীয় বোর্ডে গোর্খাল্যান্ড নিয়ে আলোচনার প্রতিশ্রুতি মিলেছে। তবে বিজেপি নেতৃত্ব গোর্খাল্যান্ড প্রশ্নে অবস্থান স্পষ্ট করেননি। তাঁদের বক্তব্য, সুশাসন এবং উন্নয়নের খাতিরে তাঁরা ছোট রাজ্যের পক্ষে। কিন্তু দার্জিলিঙের ভৌগোলিক অবস্থান যথেষ্ট স্পর্শকাতর। তা ছাড়া, খুব ছোট রাজ্য গঠন করে কতটা লাভ হবে, সেই প্রশ্নও রয়েছে। বিজেপি মুখপাত্র শাহনওয়াজ হুসেন বলেন, “আমরা ছোট রাজ্যের পক্ষে ঠিকই। কিন্তু ন্যানো-রাজ্যের পক্ষে নই।” এ প্রসঙ্গে মোর্চার বিধায়ক রোহিত শর্মা বলেন, “প্রস্তাবিত গোর্খাল্যান্ডের আয়তন সিকিমের থেকে বড়।” বিজেপি সূত্রের দাবি, গত লোকসভা ভোটের ইস্তাহারে গোর্খাল্যান্ডকে সরাসরি সমর্থন করা হয়নি। বলা হয়েছিল, বিজেপি পৃথক তেলঙ্গানাকে সমর্থন করবে। কিন্তু ক্ষমতায় এলে দার্জিলিং ও ডুয়ার্সে গোর্খা, আদিবাসী ও অন্যদের দাবিকে সহানুভূতির সঙ্গে খতিয়ে দেখা হবে। |