|
|
|
|
‘গড়’ পুনর্দখল, অকাল হোলি কংগ্রেসের |
বরুণ দে • খড়্গপুর |
আগে তিন দফায় পুরপ্রধান ছিলেন। খড়্গপুরের পুরপ্রধানের সঙ্গে সমার্থক হয়ে গিয়েছিল তাঁর নাম। মাঝের দু’বছর ছন্দপতনের পর ফের খড়্গপুরের পুরপ্রধান হিসাবে নির্বাচিত হলেন রবিশঙ্কর পাণ্ডে।
একান্তই কংগ্রেসের এই নেতা ১৯৯০ সাল থেকে খড়্গপুরের পুরভোটে জিতে আসছেন। ১৯৯৫, ২০০০ ও ২০০৫পরের তিন দফায় পুরপ্রধান ছিলেন তিনি। রেলশহরে কংগ্রেসের সংগঠন ধরে রাখার পিছনে জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক এবং প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সদস্য রবিশঙ্করবাবুর বড় ভূমিকা রয়েছে। তবে, এলাকার লোকে বলেন, কংগ্রেসের এই গড় আগলে রেখেছেন যিনি, তাঁর নাম জ্ঞান সিংহ সোহন পাল। শহরবাসীর কাছে তিনি ‘চাচা’ নামেই পরিচিত। কংগ্রেস আর খড়গপুরই যেন তাঁর ঘরসংসার। ‘ইমেজ’ এমনই যে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পরিবর্তনের ঝড়েও জিততে অসুবিধে হয়নি চাচার।
কিন্তু শুধুই কি ব্যক্তি? একদা বামদুর্গ, এখন ঘাসফুলের গড় পশ্চিম মেদিনীপুরে কংগ্রেসের জনসমর্থন ধরে রাখার রসায়ন কি আরও জটিল নয়? রাজনৈতিক মহলের মতে, মূল কারণটা হল শহরের চরিত্র। ‘মিনি ইন্ডিয়া’ বলে পরিচিত এই রেলশহরে প্রচুর অবাঙালি মানুষের বসবাস। তাঁদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির যোগটা কম। রাজ্যে তৃণমূল ও বামফ্রন্ট প্রধান দুই রাজনৈতিক শক্তি হলেও তাঁদের কাছে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। সর্বভারতীয় গ্রহণযোগ্যতার কারণেই হয়তো এই শহরে বিজেপি-রও একজন কাউন্সিলর রয়েছেন। তবে, এর চেয়েও বড় কারণ হল রেল নিজে। রেলশহরের সুখ-দুঃখ আবর্তিত রেলকে ঘিরেই। রেলের অন্যতম প্রধান ইউনিয়ন ‘রেলওয়ে মেনস কংগ্রেসে’র কার্যালয় পাড়ায় পাড়ায় রয়েছে। কংগ্রেসের সাংগঠনিক ভিত ধরে রাখার বড় কারণ অবশ্যই এই শ্রমিক ইউনিয়ন। |
|
রবিশঙ্কর পাণ্ডেকে নিয়ে সমর্থকদের উল্লাস। |
তবে, এ দিনের বোর্ড দখলের সঙ্গে সরাসরি জনসমর্থনের সম্পর্ক নেই। ভোটটা হয়ে গিয়েছে ২০১০ সালে। নির্বাচনের সময় খড়্গপুর পুরসভা আসন সংখ্যা ছিল ৩৫। এর মধ্যে তৃণমূল ১৫টি, কংগ্রেস ১২টি, সিপিআই ৩টি, সিপিএম ৩টি, বিজেপি ১টি এবং নির্দল প্রার্থী ১টি আসনে জেতে। কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে পুরবোর্ড গঠন করে তৃণমূল। পুরপ্রধান হন তৃণমূলের জহরলাল পাল। বছর ঘুরতে না-ঘুরতে পুরবোর্ডের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে কংগ্রেস। প্রায় এক বছর আগে, ২০১২ সালের ১৪ অগস্ট তৃণমূল পরিচালিত পুরসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা আনে কংগ্রেস। ২৭ অগস্ট ওই প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ভোটাভুটি হওয়ার কথা ছিল। শুরুতে সভাপতি নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর কৌশলে ভোটাভুটি এড়িয়ে যায় তৃণমূল। পরে রাজ্য সরকার একটি নির্দেশ জারি করে। সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করে কংগ্রেস। চলতি বছরের ১৫ জুলাই হাইকোর্ট এক নির্দেশে জানায়, তিন সপ্তাহের মধ্যে বোর্ড মিটিং ডেকে খড়্গপুরে পুরপ্রধান নির্বাচন করতে হবে। হাইকোর্টের নির্দেশে গত দশ মাস ধরে ভারপ্রাপ্ত পুরপ্রধানের দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন উপপুরপ্রধান তুষার চৌধুরী। নির্দেশ মতো তিনিই বোর্ড মিটিং ডাকেন।
সোমবার সকাল থেকে পুরসভার সামনে কংগ্রেস ও তৃণমূলদু’পক্ষের লোকজনই জমায়েত হয়েছিলেন। গোলমাল এড়াতে বাড়তি পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়। ছিলেন খড়্গপুরের এসডিপিও দ্যুতিমান ভট্টাচার্য। খড়্গপুরের মহকুমাশাসক আর বিমলা’র উপস্থিতিতে সকাল ১১টা নাগাদ বোর্ড মিটিং শুরু হয়। বহিষ্কৃত সিপিআই কাউন্সিলর এবং বামফ্রন্টের বাকি ৩ কাউন্সিলর আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাঁরা পুরপ্রধান নির্বাচনে যোগ দেবেন না। সেই মতো ৩০ জন কাউন্সিলরের উপস্থিতিতে বোর্ড মিটিং শুরু হয়। শুরুতে সভাপতি নির্বাচন হয়। তৃণমূলের পক্ষ থেকে দিব্যেন্দু পালের নাম প্রস্তাব করা হয়। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে চিত্তরঞ্জন মণ্ডলের নাম প্রস্তাব করা হয়। ভোটাভুটিতে ১৬-১৪ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন চিত্তরঞ্জনবাবু। এক নির্দল কাউন্সিলর এবং এক বিজেপি কাউন্সিলর কংগ্রেসের প্রস্তাবকে সমর্থন করেন। পরে পুরপ্রধান নির্বাচনেও ওই একই সমীকরণ দাঁড়ায়। তৃণমূলের পুরপ্রধান পদপ্রার্থী তুষার চৌধুরীকে ১৬-১৪ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে জয়ী হন কংগ্রেসের রবিশঙ্কর পাণ্ডে। ভোটাভুটি শেষে নির্বাচিত পুরপ্রধানকে শপথবাক্য পাঠ করান খড়্গপুরের মহকুমাশাসক।
বিজেপি-র সমর্থন নিয়ে ভোটে জেতায় কংগ্রেসকে খোঁচা দিতে ছাড়ছে না তৃণমূল। দলের পুরপ্রধান পদপ্রার্থী তুষারবাবুর কটাক্ষ, “সেই বিজেপির সমর্থন নিয়ে ভোটে জিততে হল! আসলে নীতি-আদর্শ বলে কিছু নেই। লক্ষ্য শুধু ক্ষমতা দখল। মানুষ সব দেখছেন। শেষ কথা মানুষই বলবেন।”
কটাক্ষ ফিরিয়ে নবনির্বাচিত পুরপ্রধান রবিশঙ্করবাবুর মন্তব্য, “নীতি-আদর্শের বুলি কারা আওড়াচ্ছে? আমরা তো এক বছর আগেই বোর্ড ফেলে দিয়েছিলাম। শুধু দলতন্ত্রের উপর ভর করে ওরা ক্ষমতায় ছিল! একটা দল গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসছে। আর ক্ষমতায় এসেই গণতন্ত্রকে হত্যা করছে! সরকারের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে আমরা আদালতে মামলা করেছিলাম। বিজেপিও তার শরিক ছিল। এটা গোপন কিছু নয়।” |
|
বোর্ড মিটিংয়ে চিন্তিত তুষার চৌধুরী ও জওহরলাল পাল। |
রেলশহরে কংগ্রেস-তৃণমূলের সম্পর্ক এমনটাই বরাবর। কংগ্রেস-শিবির কোনও দাবি করলে, পাল্টা দাবি করে তৃণমূল। আবার তৃণমূল-শিবির কোনও অভিযোগ করলে, পাল্টা অভিযোগ করে কংগ্রেস। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দু’দলের জোট হয়েছিল। সেই সময় দু’দলের দূরত্ব কিছু কমে আসে। জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতা থেকে কংগ্রেস-তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা কাছাকাছি আসতে শুরু করেন। তবে, সম্পর্ক সে ভাবে জোড়া লাগেনি। তাই বছর ঘোরার আগেই ফের ‘দূরত্ব’ বাড়তে শুরু করে। সম্পর্কে ফাটল ধরে! সাংগঠনিক ভাবে কংগ্রেস কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে।
ক্ষমতায় ফিরে আসায় এ বার শহরের বুকে সংগঠন ফের আগের মতো চাঙ্গা হবে বলে মনে করছে কংগ্রেস। দলের শহর কংগ্রেস সভাপতি অমল দাস মানছেন, “পুরসভা ফের আমাদের দখলে। এর ফলে দলের কর্মীদের মনোবল বাড়বে। তাঁরা নতুন করে উজ্জীবিত হবেন। সংগঠন অনেকটাই চাঙ্গা হবে।” যদিও কংগ্রেসের এই দাবি উড়িয়ে দিচ্ছে তৃণমূল। দলের শহর সভাপতি দেবাশিস চৌধুরীর কথায়, “কী করে ওদের সংগঠন চাঙ্গা হবে? পায়ের তলায় তো মাটিই নেই। বিজেপিকে সঙ্গে নিয়ে বোর্ড দখল করতে হল। ছ’মাস পর আমরাও অনাস্থা আনব। এই বোর্ড চলতে দেব না। আমার নেত্রী টাকা পাঠাবেন, আর ওরা চুরি করবে তা হতে দেব না।”
বোঝা যাচ্ছে, আগামীতেও কাজিয়া চলবে। ক্ষমতার রদবদলও অপ্রত্যাশিত নয়। এ দিন শপথবাক্য পাঠ করার পর নবনির্বাচিত পুরপ্রধান যখন পুরসভা থেকে বেরোচ্ছেন, বাইরে তখন দলের কর্মী-সমর্থকেরা বিজয়োৎসবে মাতোয়ারা। শুরু হয়েছে অকাল হোলি। অদূরে একা দাঁড়িয়ে তৃণমূলের জহরলাল পাল। রেলশহরের প্রাক্তন পুরপ্রধান।
|
ছবি: রামপ্রসাদ সাউ
|
পালাবদল |
১৮ জুন, ২০১০: পুরবোর্ড গঠন তৃণমূলের। বাইরে থেকে সমর্থন কংগ্রেসের।
২২ অগস্ট, ২০১১: সিপিএমের দুই কাউন্সিলর কংগ্রেসে যোগ দিলেন।
২৭ জানুয়ারি, ২০১২: পুরবোর্ডের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে সমর্থন প্রত্যাহার করল কংগ্রেস।
৩১ মার্চ, ২০১২: অনাস্থা আনতে চেয়ে প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বের কাছে দরবার।
৬ অগস্ট, ২০১২: পুরপ্রধানকে ‘চরমপত্র’ কংগ্রেসের।
১৪ অগস্ট, ২০১২: তৃণমূল পরিচালিত পুরবোর্ডের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব।
২৭ অগস্ট, ২০১২: বোর্ড মিটিং। সভাপতি নির্বাচনে হেরে অনাস্থার ভোটাভুটি এড়াল তৃণমূল।
৫ সেপ্টেম্বর, ২০১২: পুর-দফতর জানাল, অনাস্থা নিয়ে তারা মতামত না জানানো পর্যন্ত আগের পুরপ্রধানই কাজ চালাবেন।
৭ সেপ্টেম্বর, ২০১২: সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা কংগ্রেসের।
১ অক্টোবর, ২০১২: আদালতের নির্দেশে ভারপ্রাপ্ত পুরপ্রধানের দায়িত্ব নিলেন উপপুরপ্রধান।
১৫ জুলাই, ২০১৩: তিন সপ্তাহের মধ্যে বোর্ড মিটিং ডেকে পুরপ্রধান নির্বাচন করতে বলল হাইকোর্ট।
৫ অগস্ট, ২০১৩: পরাজিত তৃণমূল। পুরপ্রধান হিসেবে শপথ নিলেন কংগ্রেসের রবিশঙ্কর পাণ্ডে। |
|
|
|
|
|
|