কী সেই কৌশল? ছোট ছোট ঠেলা ভ্যানে করে দীর্ঘদিন ধরে ময়লা আবর্জনা ফেলা হচ্ছে পুকুরে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জল কমে সেই সব পুকুরে কচুরিপানা হয়ে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত এক সময় ওই সব পুকুরের ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ হচ্ছে। তখন রমরমিয়ে সেখানে গড়ে উঠছে বহুতল। কোনও ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ ওই সব পুকুর বোজানো জমি কিনতে সংকোচ করেন আইনি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার ভয়ে। অবশ্য প্রমোটারদের ক্ষেত্রে আইন কোনও বাধা নয় বলে অভিযোগ। সে ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বোঝাপড়ায় প্রমোটারের বিরুদ্ধে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনও ব্যবস্থা নেন না পুর-কর্তৃপক্ষ।
গঙ্গা পাড়ের পুরসভা শহর উত্তরপাড়া থেকে শুরু করে বাঁশবেড়িয়া সর্বত্রই কমবেশি একই চিত্র। জেলার যে সব পুরসভায় প্রমোটারদের বেশি রমরমা সেই সব এলাকার পুকুরগুলির হাল সবথেকে করুণ। উত্তরপাড়া, কোন্নগর, রিষড়া, শ্রীরামপুর, বৈদ্যবাটি, চন্দননগর এবং হুগলি-চুঁচুড়া পুরসভার পুকুরগুলির হাল অত্যন্ত খারাপ। বহু ক্ষেত্রেই পুর-কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় পুকুর বোজানো হচ্ছে। ব্যবস্থা নেওয়ার লোক নেই।
উত্তরপাড়ার মালিকপাড়া এলাকায় একটি ঝিল অংশত বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে। অভিযোগ, নেপথ্যে রয়েছেন এলাকার এক প্রভাবশালী প্রোমোটার। একই ভাবে পুরসভার ভুতেরগলি এলাকায় একটি পুকুর কচুরি পানায় থিক থিক করছে। ওই পুকুরটিও অংশত বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে বলে অভিযোগ। পুরসভা পরিচালিত মনমোহন (সিএ মাঠ) উদ্যানের মধ্যে পুকুরটিও অবহেলিত। সেটি এলাকার মানুষ নিকাশি হিসেবে ব্যবহার করছেন। জেলা সদর হুগলি-চুঁচুড়া পুরসভায়ও পুকুরের বেহাল দশা। জেলা সদরে ফুলপুকুর গোরস্থান এলাকার একটি পুকুর কৌশলে বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ। প্রোমোটারদের থাবায় জেরবার এককালের ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগরেরও। সেখানেও অবাধে চলছে পুকুর-নিধন।
বস্তুত, জেলার পুরসভাগুলির হাতে সে ভাবে কোনও সার্বিক তথ্যই নেই এলাকার পুকুরগুলির বিষয়ে। প্রতিটি পুর এলাকার ম্যাপে চিহ্নিত থাকার কথা পুকুরের সম্বন্ধে। যা থেকে প্রয়োজনে এলাকার সার্বিক জলচিত্রের ছবিটি পাওয়া যায়।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক জেলার একটি পুরসভার সংশ্লিষ্ট দফতরের মেয়র-ইন-কাউন্সিল বলেন, “জন বিস্ফোরণে প্রতিটি পুরএলাকায় পুকুরের সংখ্যা কমছে। কারণ বসতির জন্য জমির প্রয়োজন। কিন্তু এত জমি কোথায়? পুকুর যে বুজে যাচ্ছে এটা বাস্তব। তবে এটাও ঠিক, পুরসভার হাতে কিন্তু জোরদার আইন নেই যা দিয়ে পুকুর বাঁচাতে পুর কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ করতে পারে।”
বৈদ্যবাটি পুরসভার চেয়ারম্যন অজয়প্রতাপ সিংহ, উত্তরপাড়া পুরসভার মেয়র-ইন-কাউন্সিল দিলীপ যাদব বা ইন্দ্রজিত্ ঘোষদের ব্যাখা অবশ্য এক।
তাঁদের ব্যক্তব্য, “বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুকুরের মালিকেরা অগ্রহী নন ব্যবস্থা নেওয়ায়। পুর-কর্তৃপক্ষ অভিযোগ পেলেই নোটিস পাঠান পুকুরের মালিকদের।” শ্রীরামপুরের মহকুমাশাসক জয়সি দাশগুপ্ত বলেন, “পুকুর বোজানোর অভিযোগ থাকলেই পুলিশ-প্রশাসনের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। তা না হলে আমি অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেব।”
পরিবেশ নিয়ে এখনও যাঁরা কিছুটা ভাবনাচিন্তা করেন তাঁদের অভিজ্ঞতা কিন্তু ভিন্ন। পুর-কর্তৃপক্ষকে বার বার অনুরোধ করেও নড়ানো যায়নি। হুগলিতে জলাভূমি, পরিবেশ নিয়ে কাজ করে চলেছেন গণউদ্যোগ সংস্থা। সংস্থার সম্পাদক সুব্রত হালদার বলেন, “পুর কর্তৃপক্ষ এলাকার জলাভূমি এবং পরিবেশ রক্ষায় বড় ভূমিকা নিতে পারতেন। কিন্তু কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া তাঁরা তা নেন না। অনুরোধেও কাজ হয় না। পুর-কর্তৃপক্ষের কাছে পুকুরের তালিকাই নেই। আমরা সে কাজে হাত দিয়েছি। অথচ পুকুরের রক্ষণাবেক্ষণে মালিককে নোটিস দেওয়ার আইন আছে। অন্যথায় জরিমানা হিসেবে তার খরচ নেওয়ায় আইন কিন্তু পুরসভার হাতে রয়েছে।”
পুর-কর্তৃপক্ষ তাঁদের কাজের স্বপক্ষে যাই ব্যাখ্যা দিন না কেন, এখন কিন্তু পুকুর বোজানোর ক্ষেত্রে আইন যথেষ্ট কঠোর। কিন্তু সেই আইনের সুযোগ নিচ্ছে কে? একান্তে কথা বললে, প্রশাসক থেকে পরিবেশবিদ সকলরেই মতামত এক। তাই পরিবেশের দফারফা করে পুকুর নিধন অবাধে চলছেই। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য।
|
জলাভূমি রক্ষায় পুরসভা কী করতে পারে? |
• পুকুর সংস্কার না করলে মালিককে নোটিস দিতে পারে।
• পুকুরের মালিক সংস্কার না করলে পুর কর্তৃপক্ষ তা করে দিতে পারেন। আইনে আছে, পুকুর সংস্কারের খরচের বিল মালিক মেটাতে বাধ্য।
•
খরচ না দিলে, তাঁকে আইনি নোটিস দেওয়া যেতে পারে।
•
জলাভূমি রক্ষায় প্রত্যেক পুর এলাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দিষ্ট তহবিল আছে। সেই তহবিল কাজে লাগাতে পারেন পুর কর্তৃপক্ষ। |
|