খাদ্য নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স জারি হয়েছে। কিন্তু এতে লাভটা হল কার? গরিবের না সরকারের?
এটা বলার আগে অপুষ্টির বিষয়টি বোঝার দরকার। ভারতে যখনই অপুষ্টির প্রসঙ্গ ওঠে, তখনই শিশুদের অপুষ্টি নিয়ে কথা হয়। মোটামুটি ভাবে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ৪৫ শতাংশই অপুষ্টির শিকার। প্রায় প্রতি দু’টি শিশুর মধ্যে এক জন অপুষ্টিতে ভোগে। পাঁচ বছরের কম বয়সী যত শিশু মারা যায় তার অর্ধেকই মারা যায় অপুষ্টিজনিত কারণে। দেশের সর্বত্র এই পরিস্থিতি নয়, কয়েকটি অঞ্চলে এই ছবিটা স্পষ্ট। এর সঙ্গে শুধু খাদ্য নয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বিষয়টিও জড়িত।
কেরলে তো সাক্ষরতার হার অত্যন্ত বেশি। সেখানেও তো...
পালাক্কাডের আট্টাপাডিতে অনেক আদিবাসী শিশু অপুষ্টিতে মারা গেছে।
গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৩৫টি আদিবাসী শিশু মারা গিয়েছে। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ৫৫।
হ্যাঁ। ওখানে সরকার থেকে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্যকর্মী-সহ একটা গোটা ইউনিট পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল যে শিশুদের বাঁচানো যায়নি। গোটা দেশে যত শিশু জন্মায় তার মধ্যে ২৩ শতাংশ শিশুর ওজন আড়াই কিলোগ্রামেরও কম। এটা মারাত্মক।
সে ক্ষেত্রে এই খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি তো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গুরুত্বপূর্ণ। তবে তা কতটা কাজের হবে এখনই বলা যাচ্ছে না। একটা সমীক্ষার কথা বলছি। হায়দরাবাদের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউট্রিশন-এর একটি সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৯-এ। তাতে বলা হয়েছে, দেশে আদিবাসী এলাকায় পুরুষদের মধ্যে ৪০ শতাংশ এবং মহিলাদের মধ্যে ৪৯ শতাংশ অপুষ্টিতে ভুগছেন। আর গোটা দেশে অপুষ্টির হার ৩৬ শতাংশেরও বেশি। তফসিলি জাতির মধ্যে এই হার ৩৯ শতাংশের বেশি। সাচার কমিটির এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সংখ্যালঘুদের মধ্যেও অপুষ্টির হার বেশি। অপুষ্টির সঙ্গে বডি মাস ইনডেক্স-এর (বিএমআই) অত্যন্ত জরুরি সম্পর্ক আছে। এটি উচ্চতার সমানুপাতে মাপা হয়। অপুষ্টিতে মানুষের দেহের উচ্চতা কমে যায়।
ধরেই নেওয়া যায়, এই অর্ডিনান্স পাশ হয়ে যাবে। কোনও দলই গরিব-বিরোধী বলে চিহ্নিত হতে চাইবে না। কিন্তু অভাবী মানুষগুলোর কাছে সেই খাদ্য সুষ্ঠু ভাবে পৌঁছে দেওয়ার রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকবে তো?
অবশ্যই থাকা উচিত। এটা একটা মহৎ কাজ। তবে এর উপরে সামাজিক নজরদারির প্রয়োজন। শুধু প্রশাসনিক উদ্যোগে এটা হবে না। পঞ্চায়েত স্তরে দেখভালের প্রয়োজন। সাধারণ মানুষকে, বিশেষত মহিলাদের এগিয়ে এসে তাঁদের খাদ্য সুরক্ষার দিকটি নিশ্চিত করতে হবে। তাঁদের সন্তানের স্বাস্থ্যও এর সঙ্গে জড়িত। |
ছাপরায় মিড ডে মিল নিয়ে যা ঘটল, সেটা তো আসলে মানসিকতার প্রশ্ন। গোটা ঘটনা রাজনৈতিক ও সামাজিক উদাসীনতার দিকে ইঙ্গিত করে।
ঠিক তাই। এটা খাদ্য সুরক্ষার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এই ঘটনা জাতীয় মর্যাদায় ঘা দিচ্ছে। এই ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়, দুর্ঘটনাও নয়। সাধারণত, সরকারি স্কুলে গরিবের বাচ্চারা যায়। তাই তাদের প্রতি অমনোযোগী হওয়া যায়— এই মানসিকতার বদল দরকার। সামাজিক নজরদারি চালাতে হবে। জানতে চাইতে হবে, আমাদের বাচ্চাদের তোমরা কী খাওয়াচ্ছ? কিন্তু মিড ডে মিল বন্ধ করা অন্যায়। ১১ কোটি শিশু স্কুলে গিয়ে খেতে পাচ্ছে।
খাদ্য সুরক্ষা বিলের কথায় ফিরি। এর সুফল প্রান্তিক মানুষ পাবে কি?
এখানে আমি ভিন্ন এক পরিপ্রেক্ষিতের কথা বলতে চাই। এর সঙ্গে আরও অনেকগুলি বিষয় জড়িত। যাঁরা বনবাসী, যাঁরা প্রান্তিক, তাঁদের নাগালের মধ্যে যে প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল, সেগুলি রাষ্ট্র কেড়ে নিচ্ছে। নিজের হাতে নিয়ে নিচ্ছে। এটা মানুষের উচ্ছেদ হওয়ার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর সঙ্গে মানুষের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত। মানুষ মনে করেছেন, তাঁরা কমন প্রপার্টি রিসোর্স-এর নাগাল পাচ্ছেন না। বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী বড় বড় পাম্প বসিয়ে ভূগর্ভের জল তুলে নিচ্ছে। বনবাসীরা জল পাচ্ছেন না। গ্রামের পর গ্রাম উচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু সেখানকার মানুষগুলো প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য পাননি। যাঁরা প্রান্তিক মানুষ, যাঁরা প্রাকৃতিক সম্পদের উপরে নির্ভরশীল, এই প্রক্রিয়ায় তাঁরা বিপন্ন হয়ে পড়ছেন। তাঁদের অস্তিত্বের সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছে।
কিন্তু এটা তো এক ভিন্ন প্রতিরোধেরও জন্ম দেয়...
এ প্রসঙ্গে বলি, বি ডি শর্মা বলেছেন, বস্তারের কমিশনার থাকার সময় তিনি গরিব মানুষ দেখেননি। এখন অসংখ্য দরিদ্র সেখানে। কেন জানেন? বহু জায়গায় বহুজাতিক বা দেশীয় সংস্থার হাতে প্রাকৃতিক সম্পদ তুলে দেওয়া হয়েছে। ভূমিপুত্ররা আজন্মের বনজ বা প্রাকৃতিক সম্পদের নাগাল পাচ্ছেন না। যাঁদের অস্তিত্ব বিপন্ন, তাঁদের প্রতিরোধের অধিকার আছে। অথচ সেই সব বিরুদ্ধ স্বর নানা ভাবে, নানা প্রক্রিয়ায় দমিয়ে রাখা হচ্ছে। মাওবাদী তকমা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
অমর্ত্য সেন কিন্তু ছত্তীসগঢ়ের খাদ্য নিরাপত্তা মডেলের প্রশংসা করেন।
অনেকেই এর প্রশংসা করেন। তামিলনাড়ুতেও অনেক আগে থেকে গণবণ্টন ব্যবস্থা চালু আছে, ওখানে অপুষ্টিও আছে। গোটা দেশে এবং ছত্তীসগঢ়ে সে ধরনের তুলনামূলক বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা হয়নি। আমাদের সামনে এমন কোনও প্রমাণ নেই যাতে এটা বলা যায়। বরং ছত্তীসগঢ়ে স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে। |