দীর্ঘ ছয় সপ্তাহের টানাপড়েনের পর রাশিয়ায় আশ্রয় পাইলেন প্রাক্তন মার্কিন গুপ্তচর এডোয়ার্ড স্নোডেন। ফোন ও ইন্টারনেটে মার্কিন গোয়েন্দাদের আড়ি-পাতা ও ব্যাপক নজরদারি চালানো বিষয়ে গোপন তথ্য ফাঁস করিয়া মার্কিন প্রশাসনের বিরাগভাজন স্নোডেন মস্কো আসিয়াছিলেন। তদবধি তাঁহার হদিশ পাইতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বর্গ-মর্ত এক করিয়া ফেলে। এমনকী বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস সহ একাধিক লাতিন আমেরিকান দেশ স্নোডেনকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে চাহিলে মোরালেসের বিমানকে ইউরোপীয় দেশগুলিতে নামিতে পর্যন্ত দেওয়া হয় নাই। অস্ট্রিয়ায় তাঁহার বিমান জ্বালানি ভরিবার জন্য নামিলে তাহাতে স্নোডেন আছেন কি না, কূটনৈতিক সৌজন্য লঙ্ঘন করিয়া তাহাও তল্লাশি করিয়া দেখা হয়। আমেরিকার ইউরোপীয় মিত্রদের এই আচরণ লাতিন আমেরিকার সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলিকে যৎপরোনাস্তি ক্ষুব্ধও করে।
এত দিনে স্পষ্ট, স্নোডেন মস্কোর বিমানবন্দরেই গত ৪০ দিন ধরিয়া বহাল তবিয়তে ছিলেন। রাশিয়া তাঁহাকে এক বছরের জন্য রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে সম্মত হওয়ায় তিনি আত্মগোপনের নিরাপদ রুশ ঠিকানায় চলিয়া গিয়াছেন। ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগে বহু রুশ গুপ্তচর ‘দ্রোহী’ হইয়া মার্কিন মুলুকে নিরাপত্তা পাইতেন। এ বার রাশিয়া পাল্টা দিল। ওয়াশিংটন বিস্তর চটিয়াছে। এতটাই যে, আগামী সেপ্টেম্বরে ভ্লাদিমির পুতিনের সহিত নির্ধারিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শীর্ষ বৈঠকের নির্ঘণ্টও নাকি অনিশ্চিত হইয়া পড়িয়াছে। তবে এই সকলই রাশিয়ার উপর চাপ সৃষ্টির কৌশল হওয়া সম্ভব। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের পর এডোয়ার্ড স্নোডেন মার্কিন প্রশাসনের কাছে আর একটি মোক্ষম ‘গলার কাঁটা’। অ্যাসাঞ্জ বর্তমানে লাতিন আমেরিকার দেশ ইকুয়েডর-এর ব্রিটেনস্থ দূতাবাসে আশ্রিত। স্নোডেন আশ্রয় পাইলেন খোদ রাশিয়ায়। বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ। ঠান্ডা যুদ্ধের কাল ফুরাইয়াছে, রাশিয়া এখন বহু বিষয়েই মার্কিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আনুকূল্য-প্রত্যাশী। কিন্তু তাহার অর্থ যে এই নয় যে, মস্কো সর্ব বিষয়ে ওয়াশিংটনের প্রতিধ্বনি করিয়া চলিতে দায়বদ্ধ। যেমন, রাষ্ট্রপুঞ্জে সিরিয়া বিষয়ে মার্কিন-ইউরোপীয় অবস্থান মস্কোর অনুমোদন পায় নাই। স্নোডেনকে আশ্রয়দানের সিদ্ধান্ত লইয়া প্রেসিডেন্ট পুতিন বুঝাইয়া দিলেন, নেটো-মার্কিন একচেটিয়া আধিপত্য তিনি সুনজরে দেখিতেছেন না।
বিশ্বরাজনীতিতে এই ধরনের প্রতিবাদী ভূমিকার প্রয়োজনও আছে। মার্কিন আধিপত্যকামিতায় গণপ্রজাতন্ত্রী চিন বেশ কিছু কাল ধরিয়াই অন্তর্ঘাত হানিতেছে। সেই অন্তর্ঘাত যেমন অর্থনৈতিক, তেমনই সামরিক, এমনকী মহাকাশ-গবেষণার মতো সমুচ্চ বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিষয়েও। ব্রাজিল-রাশিয়া-চিন-ভারত কিংবা সাংহাই গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক জোটও নানা ক্ষেত্রে মার্কিন-ইউরোপীয় জোটের প্রতিস্পর্ধী হওয়ার খোয়াব দেখে। রাজনৈতিক অবস্থানের ক্ষেত্রে পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চিন ও রাশিয়া মোটেই মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করিয়া চলিতেছে না। স্নোডেনকে আশ্রয় দিবার মধ্য দিয়া রাশিয়া জানাইয়া দিতে চায়, ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসান মানেই একমেরু বিশ্ব নয়। ভারত-সহ একুশটি দেশ স্নোডেনকে আশ্রয় দিবার আর্জি খারিজ করিয়াছে। কিন্তু মস্কো এখনও আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ওয়াশিংটনকে খুশি করিয়া চলার দায় বোধ করিতেছে না। |