তেলঙ্গানাকে পৃথক রাজ্যের কেন্দ্রীয় স্বীকৃতির পরক্ষণ হইতেই বিভিন্ন রাজ্যের জনগোষ্ঠীর মধ্যে জমিয়া থাকা পৃথক রাজ্যের দাবি নূতন করিয়া মাথা চাড়া দিবে, ইহা স্বাভাবিক। ইহাও অস্বাভাবিক নয় যে, এই সব দাবি আদায়ের আন্দোলন প্রথমাবধি হিংসাত্মক ও রক্তাক্ত হইয়া উঠিবে এবং তাহা দমন করিতে রাজ্য সরকারগুলিকে দমন নীতি অনুসরণ করিতে হইবে। কেননা পৃথক রাজ্যের দাবি অর্থাৎ একটি রাজ্যকে ভাঙিয়া দুই টুকরা করার দাবি যে রাজ্যের কণর্ধাররা কোনও মতেই শিরোধার্য করিবেন না, ইহা একপ্রকার স্বতঃসিদ্ধ। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য অসমের দিকে চাহিলে বিষয়টি স্পষ্টতর হয়, যদিও মহারাষ্ট্র, (বিদর্ভ), পশ্চিমবঙ্গ (গোর্খাল্যান্ড), উত্তরপ্রদেশ (বুন্দেলখণ্ড, হরিৎপ্রদেশ, অবধ ইত্যাদি) সহ অন্যান্য রাজ্যেও পৃথক রাজ্যের দাবিতে জনগোষ্ঠীর আন্দোলন কমবেশি তীব্র হইতেছে। অসমের বৈশিষ্ট্য তফাত একটাইউত্তর-পূর্বাঞ্চলের এই রাজ্যটি ইতিপূর্বেই বহু স্বতন্ত্র প্রদেশে বিভক্ত হইয়াছে।
তাহাতে যে বিভাজনের প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হয় নাই, বড়োল্যান্ড ও কার্বি-ডিমাসাদের পৃথক রাজ্যের দাবি তাহার প্রমাণ। এই সব স্থানে ইতিপূর্বে জনজাতীয় স্বায়ত্তশাসন মঞ্জুর হইয়াছে। স্বশাসিত ওই সব প্রশাসনিক পরিষদে জনজাতীয়রাই নির্বাচনের মধ্য দিয়া ক্ষমতাসীন, তাঁহারাই শাসনকার্য সঞ্চালন করিতেছেন। কিন্তু স্পষ্টতই এই সব পরিষদ জনজাতিগুলির আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করিতে সমর্থ হয় নাই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিষদের হাতে তত কিছু স্বশাসনের অধিকার বা তাহা প্রয়োগ করার উপযুক্ত তহবিল, কোনওটাই দেওয়া হয় নাই। ফলে পরিষদগুলি ‘ঠুঁটো জগন্নাথে’ পরিণত। জনজাতীয় গোষ্ঠীগুলির পশ্চাৎপদতা ঘুচাইয়া শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, পুষ্টিতে, কর্মসংস্থানে তাহাদের প্রাগ্রসর করিয়া তোলার যে আশ্বাস ছিল, তাহা পূরণ হয় নাই। ক্রমশ এই সকল অনগ্রসর জনজাতির মনে এই বিশ্বাস দানা বাঁধিয়াছে যে, পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা, সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং উপযুক্ত তহবিল পাইলেই নিজেদের দুর্দশা ঘুচাইয়া তাঁহারা অগ্রসর হইতে পারিবেন। তেলঙ্গানা রাজ্য গঠনের ঘোষণা তাঁহাদের সেই আশাকে আরও উজ্জীবিত করিয়া থাকিবে।
অসমে ব্রহ্মপুত্রের উত্তর-দক্ষিণ ব্যাপিয়া যে বিস্তীর্ণ ভূভাগকে এখন বড়োদের আঞ্চলিক স্বশাসনে রাখা হইয়াছে, সেই ২৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের বাহিরেও বড়ো-অধ্যুষিত বহু এলাকা রহিয়া গিয়াছে। প্রশাসনিক কাজকর্মের জন্য, উচ্চ শিক্ষার জন্য, গুরুতর রোগের চিকিৎসার জন্য এখনও বড়োদের অসমের রাজধানী গুয়াহাটিতেই যাইতে হয়, কোকরাঝাড়ে বসিয়া থাকিলে চলে না। একই কথা কার্বি আঙলং ও ডিমা হাসাও স্বশাসিত পরিষদের এলাকায় বসবাসকারী কার্বি ও ডিমাসা জনজাতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ডিফু কিংবা হাফলঙে না আছে কোনও হাসপাতাল, না কোনও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, না কোনও রাজ্য সরকারি দফতর। ১৮৩২ সালের আগে পর্যন্ত এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল কিন্তু স্বাধীন ডিমাসা-কাছাড়ি রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার ভ্রান্ত নীতির ফলেই এই সব জনজাতি উন্নয়নের রাজপথ হইতে অনগ্রসরতার কানাগলিতে নিক্ষেপিত হয়। স্বাধীন ভারতের সরকারও মোটের উপর পূর্বসূরির পদাঙ্ক অনুসরণ করায় জনজাতীয় উন্নয়নের কাজটি কার্যত অনারব্ধই থাকিয়া গিয়াছে। সত্য, পৃথক রাজ্যই এই অনুন্নয়নের একমাত্র সমাধান নয়। প্রমাণ— ঝাড়খণ্ড। নূতন করিয়া দেশকে অগণিত ছোট-ছোট প্রদেশে পুনর্বিভাজিত করার তাই যুক্তি নাই। কিন্তু স্বশাসিত আঞ্চলিক পরিষদের যে কাঠামোটি কেন্দ্রীয় সরকার জনজাতীয় উন্নয়নের বিকল্প মডেল হিসাবে খাড়া করিয়া রাখিয়াছে তাহা যথেষ্ট হইতে পারে না। প্রয়োজন যথার্থ স্বশাসন, যথার্থ বিকেন্দ্রীকরণ। |