ক্লাস আপাতত বন্ধ। এখন হস্টেলই ওদের জীবন। খাওয়া সেখানে। পড়া সেখানে। অল্পবিস্তর খেলাধুলো যা হচ্ছে, সেটাও সেখানে।
এ-ও এক ধরনের ছুটি। তবে, বাড়ি গিয়ে ছুটি কাটানোর সুযোগ এখনও মেলেনি। সকালে ঘুম ভাঙা থেকে রাতে শুতে যাওয়া ইস্তক, হস্টেলেই বন্দি তাদের জীবন। সহপাঠীদের অনেকেই চলে গিয়েছে যে যার বাড়িতে। কিন্তু, দার্জিলিং পাহাড়ের অধিকাংশ আবাসিক স্কুলে এখনও রয়ে গিয়েছে প্রচুর পড়ুয়া। অনেকেই থাকে বিদেশে। অনেকে ভিন্ রাজ্যে। কিছু ছাত্রছাত্রীর বাড়ি আবার কলকাতায় হলেও মোর্চার লাগাতার বন্ধের
জেরে তাদের অভিভাবকেরা ঢুকতে পারেননি পাহাড়ে। |
দার্জিলিঙের নর্থ পয়েন্ট স্কুলে গুটি কয়েক পড়ুয়া। ছবি: রবিন রাই। |
বস্তুত, আলাদা রাজ্যের দাবি, তার সমর্থনে বন্ধএই রাজনীতি থেকে তাদের ঠাঁই অনেক দূরে। তারা এসেছে পড়াশোনা করতে। ভাল স্কুলে থেকে লেখাপড়া করে কেরিয়ার গড়তে। রাজনীতির আঁচ তবু তাদের
ছুঁয়ে যাচ্ছে। গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে মোর্চার বন্ধ উঠে যাওয়ার কোনও আশু লক্ষ্মণ নেই। এই অবস্থায় ওই পড়ুয়াদের নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন স্কুলগুলির কর্তৃপক্ষ। আশঙ্কার কারণ প্রথমত, মজুত করা খাবারে বেশি দিন চালানো সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, বন্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে তার জেরে স্কুল বন্ধ রাখতে হবে। তাতে বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষের ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যক্রম সময়ে শেষ করা মুশকিল হবে। |
ফাঁকা ৩১এ জাতীয় সড়কে চলছে ফুটবল খেলা। সিকিমের পথে ২৯ মাইলে বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি। |
পাহাড়ে এমন অন্তত ২৮টি আবাসিক স্কুল রয়েছে। যেখানে আশেপাশের জেলাগুলির পড়ুয়ারাই শুধু নয়, দেশ-বিদেশের ছাত্রছাত্রীরাও পড়ে। মোর্চার তরফে পর্যটক-বাসিন্দাদের পাশাপাশি বহিরাগত স্কুলপড়ুয়ারা বাড়ি চলে যাওয়ার জন্য দু’দিনের সময় দেওয়া হয়েছিল। গত ১-২ অগস্ট বন্ধ শিথিল করেছিল তারা। কিছু অভিভাবক এসে ছেলেনেয়েদের নিয়ে যান সেই সময়ে। কিন্তু, দূরের পড়ুয়াদের সেই সুযোগ হয়নি। দার্জিলিঙের নর্থ পয়েন্ট
স্কুলের কথাই ধরা যাক। এই স্কুলের হস্টেলে ৫২০ জন ছাত্র থাকে।
তাদের মধ্যে ৩৭৫ জনকেই নিয়ে যেতে পারেননি পরিবারের লোকেরা। ফলে দিনভর হস্টেলেই কাটাতে হচ্ছে ওই পড়ুয়াদের।
নর্থ পয়েন্ট স্কুলের অধ্যক্ষ শান্তি ম্যাথিউ বলেন, “হস্টেলে যারা রয়ে গিয়েছেন, তাদের অধিকাংশই ভুটান, স্পেন, হংকং, ইন্দোনেশিয়ার মতো অন্য দেশ থেকে এখানে পড়তে এসেছে। বন্ধ শিথিল থাকা ওই দু’দিনের মধ্যে তাদের অভিভাবকদের ডেকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া কোনও ভাবেই সম্ভব ছিল না।” তিনি জানান, পাহাড় লাগোয়া সিকিম, জয়গাঁ, শিলিগুড়ি থেকেও অনেক পড়ুয়া
ওই স্কুলের হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। তাদের অভিভাবকেরা
অবশ্য ছাত্রদের বাড়ি নিয়ে গিয়েছেন। যারা রয়ে গিয়েছে, তাদের জন্য
অবশ্য বিনোদনের ব্যবস্থা করছেন স্কুল-কর্তৃপক্ষ। কিছু ছাত্র জানাল, এমনিতে মাসে একবার সিনেমা দেখার সুযোগ মেলে। এখন প্রতিদিন বিকেলে সেই সুযোগ হচ্ছে। সকালে উঠে একপ্রস্ত পড়া। তারপর খেলা।
ফের পড়া। তার খাওয়া। এই এখন তাদের রুটিন।
পাহাড়ের তিন মহকুমা মিলিয়ে স্কুলের সংখ্যা প্রায় ৮০০। সব স্কুলগুলিতেই শুক্রবার অনির্দিষ্টকাল বন্ধ থাকার নোটিস ঝুলেছে। কার্শিয়াঙের হিমালি বোর্ডিং স্কুলের হস্টেলে ৪৬০ জন থাকে। এখনও তাদের হস্টেলে ২৫০ জন পড়ুয়া রয়ে গিয়েছে। তাদের অনেকের কথায়, “এমনিতে বাইরে যা হচ্ছে, তার আঁচ আমরা ভিতরে পাচ্ছি না। হস্টেলে খুব যে অসুবিধা হচ্ছে, তা-ও নয়। তবে, ক্লাস ছাড়া সারাদিন হস্টেলে কাটাতে কারই বা ভাল লাগে?” তবে, উদ্বিগ্ন বাবা-মায়েরা প্রায় রোজই হস্টেলে ফোন করছেন বলে তারা জানাল। পাহাড়েরই একটি আবাসিক স্কুলের কিছু ছাত্রছাত্রী আবার বলছে, “অধিকাংশ স্কুলে সেপ্টেম্বরেই পরীক্ষা। এখন টানা ক্লাস না হলে সিলেবাস শেষ করতে প্রচণ্ড সমস্যায় পড়ব। সে ক্ষেত্রে অন্য ছুটি হয়তো স্কুল কাটছাঁট করবে।” একই উদ্বেগ স্কুলগুলির শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও।
অনেক স্কুল কর্তৃপক্ষই জানিয়েছেন, হস্টেলের পড়ুয়াদের খাবারের জন্য খাদ্যশস্য (চাল-ডাল-আটা) এক মাসের মতো মজুত করা রয়েছে। শাকসব্জি বা মাছ, মাংস নিয়েই সমস্যা। মজুত যা রয়েছে, তাতে মেরেকেটে এক বা দুই সপ্তাহ চালানো সম্ভব। বন্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে কচিকাঁচাদের ভাত, ডাল আর আলুর সব্জি ছাড়া অন্য কিছু দেওয়া সম্ভব হবে না। সে ক্ষেত্রে প্রশাসন এমনকী প্রয়োজনে আন্দোলনকারীদের কাছেই সাহায্য চাইতে হতে পারে বলে জানাচ্ছেন স্কুল-কর্তৃপক্ষ। শান্তি ম্যাথিউ বলেন, “আমাদের হস্টেলের ছাত্রদের প্রায় প্রতিদিনই মাংস দেওয়া হয়। কিন্তু বন্ধ লাগাতার চলতে থাকলে হস্টেলে রয়ে যাওয়া পড়ুয়াদের তা দেওয়া সম্ভব হবে না। শুধু সব্জি-ভাত-ডাল দিতে হবে।” একই বক্তব্য হিমালি বোর্ডিং স্কুল কর্তৃপক্ষেরও। ওই স্কুলের ডিরেক্টর রবীন্দ্রনাথ সুব্বার কথায়, “তেমন
হলে মোর্চার কিছু নেতা-কর্মী আমাদের সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন। তবে, সেটাই তো একমাত্র বিষয় নয়।
বন্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে পড়ুয়াদের পড়াশোনার ক্ষতি হবে। সেটা নিয়েই উদ্বেগে রয়েছি।” বন্ধ না উঠলে? শান্তি ম্যাথিউ বলছেন, “আমরা বড়জোড় ১১ তারিখ অবধি দেখব। তার পর কিছু একটা তো করতেই হবে!” সেই কিছুটা কীতাঁদের কাছেও স্পষ্ট নয়। তবে, শীতের ছুটি কমিয়ে সিলেবাস ‘মেক-আপ’ করার আপ্রাণ চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছেন কিছু স্কুলের অধ্যক্ষ। যদি অবশ্য শীতেও পাহাড় শান্ত থাকে! |