সৌরভের মুখে জীবনানন্দ, সুপ্রিয়ার ফুচকা
উনিশ জেলা। একশো তিন কৃতী বাঙালি। একটি মিউজিক ভিডিয়ো। লিখছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
সুপ্রিয়া দেবী, লিলি চক্রবর্তী আর মাধবী মুখোপাধ্যায় একসঙ্গে দাঁড়িয়ে কোনও দিন ফুচকা খেয়েছেন বলে শোনা যায়নি। টাউন হলের সামনে যখন তাঁদের দেখা হল, সেই সাধটুকু মিটিয়ে নিলেন তাঁরা।
সঞ্চালক হর্ষবর্ধন নেওটিয়া |
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় স্কুলে থাকাকালীন কোনও দিন বাংলা কবিতা পড়েননি। ব্যাট ছেড়ে সৌরভ তুলে নিলেন ডায়েরিতে লেখা জীবনানন্দ দাশের কবিতা। আবৃত্তি করলেন ‘হয়তো মানুষ নয়, হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে’।
দেশ-বিদেশে বহু কনসার্ট করেছেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। কিন্তু ধর্মতলার মোড়ে মিনিবাসের ভিড়ে আবার তানপুরা নিয়ে গান ধরা যায় নাকি? তাও হয়েছে। তিনি গেয়েছেন শ্রীজাত-র লেখা রাগ দেশ-এ আবদ্ধ একটি গান।
এই সবই ঘটেছে একটি ভিডিয়োর শ্যুটিংয়ে। নাম ‘দেখা হবে এই বাংলায়’। একশো তিন জন কৃতী বাঙালিকে নিয়ে এ রাজ্যের উনিশটি জেলায় ঘুরে ঘুরে শ্যুটিং করা হয়েছে ভিডিয়োটির। পরিকল্পনা আর পরিচালনা করেছেন সৌম্যজিৎ দাশ এবং সৌরেন্দ্র মল্লিক। উপস্থাপনায় হর্ষবর্ধন নেওটিয়া। মুক্তি পেতে চলেছে ১১ অগস্টে।
কেন এমন একটি ভিডিয়ো বানানোর পরিকল্পনা করলেন এই দুই শিল্পী? “আমাদের রাজ্যকে কেন্দ্র করে এমন কোনও ভিডিয়ো নেই যেখানে বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হয়েছে। এক সুরে বাঁধা হয়েছে বাংলা ঐতিহ্য, আবেশ আর পার্বণগুলোকে। রাজনীতি আর ব্যবসা এই দু’টো ক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য সব জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু করি। কনসেপ্টটা ভাল লাগাতে বিনা পারিশ্রমিকে তাঁরা শ্যুট করতেও রাজি হয়ে যান। মূল ভিডিয়োর গানের সুর আমরাই করেছিলাম,” প্রায় সমস্বরে বলেন সৌম্যজিৎ আর সৌরেন্দ্র।
হর্ষ বলছেন, “আমার কনসেপ্টটা বেশ পছন্দ হয়। ওরা চেয়েছিল এমন একটা ভিডিয়ো বানাতে যা দেখে আমাদের বাংলাকে নিয়ে গর্ব হবে। ভৌগোলিক পটভূমিকে মাথায় রেখে বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে এই ভিডিয়োটা শ্যুট করে। বিশিষ্ট লেখকদের কাজ তুলে ধরা ছাড়াও সঙ্গীতের বিভিন্ন ধরনের ঘরানাকেও একসুরে বেঁধেছে ওরা।” |
কিংবদন্তি তিন নায়িকার অসামান্য ফুচকা আউটিং। সুপ্রিয়া দেবী, লিলি চক্রবর্তী, মাধবী মুখোপাধ্যায় |
শুরু হয় এক এক করে শ্যুটিং করা। অল্প কয়েক জন কলাকুশলীকে নিয়ে টিম। জার্মানি থেকে এসেছিলেন চিত্রগ্রাহক সেবাস্টিয়ান নিহফ। মনে পড়ে ‘আগন্তুক’য়ের সেই দৃশ্য যেখানে ঝুমুরের সঙ্গে পা মিলিয়ে নেচে ওঠেন মমতা শঙ্কর? অনেকটা সেটা মাথায় রেখেই যাওয়া হয় পুরুলিয়ার গড়পঞ্চকোট মন্দিরে। “আসানসোলে নেমে সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে মমদি আর রাতুলকে নিয়ে পৌঁছে যাই এই মন্দিরে। কী স্নিগ্ধ একটা পরিবেশ। কিন্তু টু্যরিস্ট প্রায় নেই!” বলেন সৌম্যজিৎ। আগেই বলা হয়েছিল সুপ্রিয়া দেবী, লিলি চক্রবর্তী আর মাধবী মুখোপাধ্যায়ের শ্যুটিংয়ের গল্প। তিনজনে অন্তত পনেরোটা করে ফুচকা খেয়েছিলেন। কারও চাই বেশি টক, কারও বা নুন কম। শেষে সেবাস্টিয়ান অনুরোধ করেন যাতে ফুচকা খাওয়া বন্ধ করে শ্যুটিং শুরু করা যায়।
শর্মিলা ঠাকুর আসছেন ভিডিয়োটির লঞ্চে। দিল্লিতে নিজের বাড়িতে শ্যুটিং করেছিলেন তিনি। ভিডিয়োতে তাঁকে দেখা যাবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ভায়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ’ পাঠ করতে। “শর্মিলাদিকে প্রচুর মেসেজ পাঠিয়েও কোনও উত্তর পাইনি। একদিন ভাবলাম একবার শেষ চেষ্টা করি। সে দিন ছিল আমার জন্মদিন। একটা এসএমএস পাঠালাম এই লিখে, ‘আজ আমার জন্মদিন। আমি অনেকবার আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি...’ মেসেজটা পাঠানোর ঠিক দু’মিনিট পরে শর্মিলাদির ফোনটা এল,” হেসে বললেন সৌমেন্দ্র।
এত ছোট ইউনিট নিয়ে শ্যুটিং করাটা বেশ কঠিন ছিল। “আদিনা মসজিদে শ্যুটিং করেছি জয়া শীল ঘোষকে নিয়ে। সেখান থেকে গেলাম গৌর ফোর্টে। ওখানে পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদারকে নিয়ে শ্যুটিং। কাজ সেরে স্টেশনে এসে শুনি যে ব্রহ্মপুত্র মেলটি ধরে আমাদের যাওয়ার কথা ছিল সেটি আসছে না। স্টেশনমাস্টার বলেন, ‘গতকালের ট্রেনটাই তো এখনও আসেনি!’ আমি তখন মনে মনে ভাবছি এটা কি হ্যারি পটারের ট্রেনের মতো উধাও হয়ে গিয়েছিল বেশ কিছু ক্ষণের জন্য?” গল্পচ্ছলে জানান সৌম্যজিৎ। |
পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। শ্যুটিংয়ে ধর্মতলার মোড়ে। সঙ্গে পরিচালকদ্বয় সৌম্যজিৎ ও সৌরেন্দ্র |
রাত দু’টোর সময় একটা লোকাল ট্রেন ধরে গেলেন নিউ জলপাইগুড়ি। সেখান থেকে কোচবিহার। বেলা তিনটেতে কোচবিহার রাজবাড়িতে শ্রাবণী সেনের শ্যুটিং সেরে রাত আটটা নাগাদ শিলিগুড়িতে ফেরা। অত রাতে কোনও গাড়ি যায় না দার্জিলিংয়ে। অনেক অনুরোধ করে শেষ পর্যন্ত দার্জিলিং যখন পৌঁছলাম তখন রাত এগারোটা। পরের দিন আবার ভোর তিনটেতে টাইগার হিলে যাওয়া। দার্জিলিং চা খাওয়ার দৃশ্যটা অবশ্য শ্যুট করা হয়েছিল লিয়ান্ডার পেজের সঙ্গে মুম্বইয়ের একটি হোটেলের লনে।
ভিডিয়োটির প্রথম দৃশ্যে রয়েছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ভিক্টোরিয়ার সামনে পাঠ করছেন জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিব ফিরে...’। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের ছবি ভেসে আসে হাওড়া ব্রিজের পটভূমিতে। দেবকে দেখা যায় খোলা মাঠে ঘুড়ি ওড়াতে।
মার্বেল প্যালেসে শ্যুটিং করেছেন গিরিজা দেবী আর কৌশিকী চক্রবর্তী। “চেয়েছিলাম আপ্পাজিকে (গিরিজা দেবী) একটা শাল দিতে। উনি তা শুনে পাশের ঘর থেকে তিন ব্যাগ ভর্তি শাল নিয়ে এসে বলেন, ‘এই ক’দিনে এতগুলো পেয়েছি। আর শাল চাই না...’ শানদা আবার চুনট করা ধুতি দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল। আমরাই ধুতিটা পরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু ওর পায়ে দেখি স্নিকার্স। পত্রপাঠ চটি কিনে আনা হল। শানদা শুধু বললেন, ‘ধুতি পাঞ্জাবি শেষ পরেছিলাম আমার বিয়েতে!’” বললেন সৌরেন্দ্র।
|
জীবনানন্দ দাশের কবিতা আবৃত্তি করছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় |
এ রকম আরও বহু ঘটনা। ঊষা উত্থুপ নিজেই বাউন্সারের কাজ করছিলেন পার্ক স্ট্রিটের ভিড় সামলানোর জন্য। ‘ভূমি’র সৌমিত্র রায়, ‘ক্যাকটাস’য়ের সিদ্ধার্থ রায়, ‘শহর’য়ের অনিন্দ্য বসু আর ‘চন্দ্রবিন্দু’র অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় এবং উপল সেনগুপ্তকে নিয়ে শ্যুটিং হয়েছিল শিয়ালদহ স্টেশনে। ডালহৌসি পাড়ার গির্জার সামনে শ্যুটিং করেছিলেন গৌতম ঘোষ। পড়ন্ত বেলায় চিৎপুরের নাখোদা মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে গান ধরেছিলেন উস্তাদ রাশিদ খান। লোপামুদ্রা মিত্র শ্যুট করেছিলেন বর্ধমানের একশো আট শিবমন্দিরে। বাবুল সুপ্রিয় গিয়েছিলেন দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে। ঝুলন গোস্বামী ট্রামে। আর বাপ্পি লাহিড়ি যুবভারতীতে। পণ্ডিত শঙ্কর ঘোষ পুত্র বিক্রমকে নিয়ে যুগলবন্দি করেছিলেন প্রিন্সেপ ঘাটে। ডালহৌসির মোড়ে ছৌ শিল্পীদের সঙ্গে তবলায় পণ্ডিত তন্ময় বসু। শুধু যে তারকারাই রয়েছেন তা নয়। বহুরূপীদের নিয়ে শ্যুট করা হয়েছে কালীঘাট, তারাপীঠ আর দক্ষিণেশ্বরের মা কালীর তিনটি রূপকে নিয়ে। |
ভিডিয়োতে পিকে-চুনী |
ভিডিয়োটির আর একটি মর্মস্পর্শী দৃশ্যে আছেন স্বয়ং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। মৃত্যুর পর হয়তো এই প্রথম তাঁকে কোনও ভিডিয়োতে দেখা যাবে। গত বছর ফেব্রুয়ারি নাগাদ নিজের বাড়িতেই শ্যুটিং করেছিলেন এটি। তখনও শরীর খুব একটা ভাল নয়। নিজের লেখা ‘উত্তরাধিকার’ কবিতা থেকে পাঠ করেছিলেন ‘তোমাকে আমার তোমার বয়সি সব কিছু দিতে বড় সাধ হয়’। অপর্ণা সেনের গলায় ভেসে ওঠে ‘উত্তরাধিকার’য়ের আর একটি পঙক্তি— ‘নবীন কিশোর তোমায় দিলাম ভুবনডাঙার মেঘলা আকাশ’। তারই রেশ ধরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পাঠ করেন ‘তোমায় দিলাম নবীন কিশোর, ইচ্ছে হয় তো অঙ্গে জড়াও’। এ ছাড়াও অন্যান্যরা পাঠ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার রায়ের কবিতা থেকে।
তবে একটিই আক্ষেপ। ঋতুপর্ণ ঘোষকে শেষ পর্যন্ত রাজি করানো যায়নি। সৌম্যজিৎ বলছেন, “ঋতুদা যে ভাবে এখানে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন, সেই শর্ত মানা সম্ভব হয়নি। তবে ভিডিয়োটা দেখে একটি মুখবন্ধ লিখে দিতে রাজি হয়েছিলেন।”
শেষ পর্যন্ত মুখবন্ধটা লেখা হয়নি। সব ইচ্ছে পূরণ হয়তো হয় না। এত কিছু পাওয়ার মধ্যে এই না-পাওয়াটুকুর আফশোস নিয়ে থাকার আর এক নামই বোধহয় জীবন। |
|