রায়গঞ্জ জেলা হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তের সংকট মেটাতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে চিঠি পাঠিয়ে রক্তদান শিবির আয়োজন করার অনুরোধ করা হয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে রায়গঞ্জের ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তের সংকট চলছে বলে জানা গিয়েছে। নির্বাচনী আচরণ বিধি বলবৎ থাকার কারণে রাজনৈতিক দলের রক্তদান শিবির করা সমস্যা ছিল। পঞ্চায়েত ভোটের পরে সেই বিধি নিষেধ না থাকায় এবারে রাজনৈতিক দলগুলির দ্বারস্থ হয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত সুপার তথা ব্লাড ব্যাঙ্কের আধিকারিক প্রদীপ মণ্ডল বলেন, “নির্বাচনী আচরণবিধির জেরে গত দুমাস ধরে ব্লাডব্যাঙ্কে রক্তের তীব্র সঙ্কট চলছে। এখন রক্তের সংকট মেটাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে চিঠি দিয়ে রক্তদান শিবিরের আয়োজন করার অনুরোধ করেছি।”
ব্লাড ব্যাঙ্ক সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতিদিন অন্তত ৫০ ইউনিট রক্ত মজুত থাকে। তবে গত দুমাস ধরে ৩ থেকে ৫ ইউনিটের বেশি রক্ত মজুত থাকছে না। রক্তের অভাবে সমস্যায় পড়েছেন রোগী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা।
শুক্রবার দুপুরে ব্লাডব্যাঙ্কে দাঁড়িয়ে দেবীনগর এলাকার বাসিন্দা তোতন ঘোষ বলেন, “বৃহস্পতিবার রাতে হাসপাতালে আমার বোনের পুত্রসন্তান হয়েছে। চিকিৎসকেরা দু ইউনিট রক্ত যোগাড় করতে বলেছেন। ব্লাডব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ রক্তদাতা যোগাড় করে আনতে বলেছেন। এখনও রক্তদাতা খুঁজে পাইনি। জানি না কী হবে!” রায়গঞ্জের মহিপুর এলাকার বাসিন্দা সুকোমল দেবের ১২ বছরের ছেলে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত! চিকিৎসকদের পরামর্শে প্রতি তিন মাস অন্তর ছেলেকে রক্ত দিতে হয়। রক্তের গ্রুপ বি-পজিটিভ। এ দিন রায়গঞ্জ জেলা হাসপাতালের ব্লাডব্যাঙ্কে গিয়ে রক্ত পাননি তিনিও। সুকোমলবাবু বলেন, “ডোনার কার্ড নিয়ে গিয়েও ব্লাডব্যাঙ্কে রক্ত পাইনি। আমাকে রক্তদাতা জোগাড় করে আনার কথা বলা হয়েছে। আমার পরিবারের কারোর বি-পজিটিভ রক্ত নেই। সেই কথা ব্লাডব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। ব্লাড ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের তরফে আমাকে রবিবার যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। তবে এক সপ্তাহের মধ্যে ছেলেকে রক্ত দেওয়া না হলে ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।”
হেমতাবাদের বাসিন্দা গাড়িচালক টিকলু চক্রবর্তীর আত্মীয় মানব চক্রবর্তী বৃহস্পতিবার রাতে হেমতাবাদ এলাকায় মোটরবাইক উল্টে জখম হন। তাঁর ডানপায়ে ইটের টুকরো ঢুকে গিয়েছে। শুক্রবার রায়গঞ্জ জেলা হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করে তাঁর পা থেকে ইটের টুকরো বার করা হয়। টিকলুবাবু বলেন, “অস্ত্রোপচারের জন্য সকালে চিকিত্সক এক ইউনিট ও-পজিটিভ রক্ত জোগাড় করে আনতে বলেন। ব্লাডব্যাঙ্কে গিয়ে রক্ত পাইনি। ব্লাডব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ আমাকে রক্তদাতা জোগাড় করে আনতে বলেছিলেন। শেষে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহযোগিতায় এক ব্যক্তি ব্লাডব্যাঙ্কে হাজির হয়ে এক ইউনিট ও-পজিটিভ রক্ত দেন।” ব্লাড ব্যাঙ্কের মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট অনির্বাণ বেরা বলেন, “ব্লাডব্যাঙ্কে যদি রক্তই না থাকে তবে ডোনার কার্ড নিয়ে এসে কী লাভ?” তিনি জানান, পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকাকালীন প্রতিদিন রায়গঞ্জের ৫টি নার্সিংহোমে প্রায় ১০ ইউনিট করে রক্ত সরবরাহ করা হয়। কিন্তু রক্তের সঙ্কটের জেরে বর্তমানে নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন রোগীদের পরিবারের পরিজনেরা রক্তদাতা জোগাড় করে না আনলে রক্ত সরবরাহ করা হচ্ছে না।
রায়গঞ্জের একটি নার্সিংহোমের কর্ণধার তথা চিকিৎসক নারায়ণচন্দ্র পাল বলেন, “ব্লাডব্যাঙ্কে রক্তের অভাবের জেরে গত দু’মাস ধরে নার্সিংহোমে চিকিৎসা পরিষেবা দিতে প্রচণ্ড সমস্যা হচ্ছে। জরুরি অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে রোগীর পরিবারের লোকজনেরাই রক্তদাতা জোগাড় করে রক্ত দিচ্ছেন। কিন্তু যে সমস্ত রোগীদের অস্ত্রোপচার পরে করলেও হবে, সেই সব রোগীদের প্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়ে অস্ত্রোপচারের দিন পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”
উত্তর দিনাজপুরের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক রাসবিহারী দত্ত বলেন, “নির্বাচন আচরণবিধির জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের রক্তদান শিবির বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রক্তের সঙ্কট চলছিল। আচরণবিধি উঠে যাওয়ায় আশা করছি, খুব শীঘ্রই আগের মতো রক্তদান শিবির শুরু হয়ে যাবে, আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকেও চিঠি দিয়ে রক্তদান শিবির আয়োজন করার অনুরোধ করেছি। আপাতত রোগী পরিবারের লোকজনদের রক্তদাতা জোগাড় করে আনার অনুরোধ করা হচ্ছে।” |