পাহাড় থেকে নেমে আসা সবুজ, নীল, মেরুনহরেক রঙের স্কুলের পোশাক পরা চেহারাগুলোর ভিড় শিলিগুড়ি শহরের উপকণ্ঠে দার্জিলিং মোড়ে। সঙ্গে ব্যাগ। এবং অভিভাবক।
দিন পনেরোর মধ্যে দার্জিলিং পাহাড় অচলাবস্থা কেটে আবার স্কুল খুলবেএই আশা নিয়ে শুক্রবার পাহাড় ছাড়ল মনীশ, ঋতু, রিচারা। কেউ পড়ে সপ্তম শ্রেণিতে, কেউ অষ্টম, আবার কেউ একাদশ।
এই স্কুলপড়ুয়ারা গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা বোঝে না। গোর্খাল্যান্ড বোঝে না। আচমকা ছুটি পেতে তাদের ভালও লাগে। কিন্তু তাদের অনেকেই বোঝে, মোর্চার ডাকা অনির্দিষ্ট কালের বনধের দৌলতে এখন স্কুল বন্ধ থাকলে পরে ‘সিলেবাস’ শেষ করার চাপ বাড়বে। অন্য অনেক প্রাপ্য ছুটিও কাটছাঁট হতে পারে। মোটের উপরে পাহাড় বনধের জেরে স্কুল বন্ধের ব্যাপারটা খুব ভাল ঠেকছে না তাদের। “খুব খারাপ হচ্ছে এটা”, বলেছেন পাহাড়বাসীর একাংশও, যাঁরা কালিম্পং, কার্শিয়াং বা দার্জিলিঙের স্কুলগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িত। কেউ শ্রমিক, কেউ রাঁধুনি, কেউ স্কুলে-স্কুলে খাবার সরবরাহ করেন, কেউ ঠিকা-পরিবহণকর্মী। এক দিন বনধ মানে যাঁদের এক দিন রোজগার বন্ধ। |
পাহাড়ের তিন মহকুমা মিলিয়ে স্কুলের সংখ্যা প্রায় ৮০০। সব স্কুলগুলিতেই শুক্রবার অনির্দিষ্টকাল বন্ধ থাকার নোটিস ঝুলেছে।
দাদুর হাত ধরে এ দিন বাগডোগরা বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল দার্জিলিং সেন্ট পলস স্কুলের মনীশ মিনি। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রটির বাড়ি কলকাতার সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে। মনীশ বলল, “স্কুল থেকে আপাতত ১৫ দিনের ছুটি দেওয়া হয়েছে। তবে বলা হয়েছে, নিয়মিত খোঁজ নিতে। ১৫ দিনের বেশি স্কুল বন্ধ থাকলে শীতের ছুটি কমিয়ে দেওয়া হতে পারে।” “তেমন হবে না বলুন?”, জানতে চায় ছাত্রটি। তার দাদু দীপক দাস বলেন, “জিটিএ (গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) গঠনের পরে ভেবেছিলাম, পাহাড়ের অশান্তি মিটল। ফের কেন যে এমন হচ্ছে, কে জানে? দু’সপ্তাহ দেখি।”
কালিম্পঙের গ্রাহামস হোমও আপাতত ছুটি ঘোষণা করেছে। ওই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ঋতু শেরিং ভাই ইয়াং এবং বোন লেমের সঙ্গে যাচ্ছে বাগডোগরা। শিলঙের বাসিন্দা শেরিং ভাই-বোনদের বক্তব্য, “ছুটি পেতে ভালই লাগে। কিন্তু স্কুলে আমাদের যে ভাবে পড়ানো হয়, বাড়িতে তো তা হবে না।”
কার্শিয়াঙের ডাউহিল স্কুলের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী রিচা এবং তার বাবা সঞ্জীব গোয়েলের সঙ্গে দেখা দার্জিলিং মোড়ে। দিল্লির প্রকাশনগরের বাসিন্দা সঞ্জীববাবুর বক্তব্য, “স্কুল থেকে বলা হয়েছে, পাহাড়ে এখন যা পরিস্থিতি তাতে যে কোনও সমস্যা হতে পারে। বলে, সে জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবেন না। মেয়েকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।”
সেন্ট পলস স্কুলের রেক্টর জয় হালদার বলেন, “আমাদের স্কুলে নেপাল, ভুটান, কানাডা-সহ বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীরা রয়েছে। পড়ুয়ারা যাতে সমস্যায় না পড়ে তাই আমরা ঝুঁকি নিতে চাইছি না। সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। আমরা পরিস্থিতি শোধরানোর অপেক্ষা করব।” কালিম্পঙের রকভিল অ্যকাডেমির অধ্যক্ষ প্রকাশমণি প্রধান বলেন, “রাজনীতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নেই। তবু আমাদের ভুগতে হচ্ছে। এখন স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। এ জন্য পরে পড়ুয়াদের উপরে বাড়তি ক্লাসের চাপ পড়বে।” একই ধরনের উদ্বেগ ডাউহিল স্কুলের অধ্যক্ষ স্বপন ভট্টাচার্যের। তাঁর কথায়, “আপাতত আমাদের কিছু করার নেই। বাইরের ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকেরা পরিস্থিতির জন্য আতঙ্কে ভোগেন। সেটা স্বাভাবিকও।”
তবে শুধু পড়ুয়া বা অভিভাবকেরা নয়, দুশ্চিন্তায় পাহাড়ের স্কুলগুলির সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভাবে জড়িত প্রায় ৫০ হাজার স্থানীয় বাসিন্দাও। যাঁদের অনেকেরই রুজি-রুটি বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়েছে। পড়ুয়াদের মতো তাঁদের অনেককেও বলতে শোনা গেল, “স্কুল তো দিন পনেরো পর থেকেই খোঁজ নিতে বলেছে। নিশ্চয়, তার আগে সব ঝামেলা মিটে যাবে। যাবে না?” |