সকাল দশটা। প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে কলকাতা থেকে আসা ডুয়ার্সগামী কাঞ্চকন্যা এক্সপ্রেস। ভিড় ঠেলে চলন্ত ট্রেনেই উঠে পড়ল শ্যাম, রাজু, হুসেন এবং রাকেশ। ট্রেনের কামড়া ঝাড় দিয়ে যাত্রীদের থেকে পয়সাও কিছু পেল ওদের। ট্রেন ছাড়তে ফের নেমে এল প্ল্যাটফর্মে। এবার ওদের এক হাতে ঝাঁটা অন্য হাতে প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ, তাতে কয়েক ফোঁটা নামী ব্র্যান্ডের আঠা। কয়েক মুহূর্ত নাকের সামনে ক্যারিব্যাগ ধরে রাখছে, নিশ্বাসে ক্যারিব্যাগ একবার ফুলছে, একবার চুপসে যাচ্ছে। ভিড়ে ঠাসা প্লাটফর্ম দিয়ে প্রকাশ্যে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ নাকে গুঁজে যাচ্ছে ওরা।
উপরের দৃশ্যটি উত্তরবঙ্গ তথা উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যতম ব্যস্ত নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে দিন-রাতের যে কোনও সময়ে দেখা যাবে। রাজু-হুসেনরদের সকলেরই বয়স দশ থেকে আঠারোর মধ্যে। শুধু রাজু-হুসেনদের চার জনের দলই নয়, স্টেশনের ছটি প্ল্যাটফর্ম মিলিয়ে অন্তত জনা ত্রিশেক শিশু কিশোরদের প্রকাশ্যে আঠার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতে দেখা যায় বলে নিত্যযাত্রীদের দাবি। রেল পুলিশ বা আরপিএফের কাছে ওরা ‘কাঙালি’, ‘চালানি’ এবং ‘লোকাল’ নামে পরিচিত। কোনও একসময়ে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে চলে আসা ‘অনাথ’ শিশু কিশোর, যারা দীর্ঘদিন ধরে এই স্টেশনেই রয়ে গিয়েছে, তারা ‘কাঙালি’। ভবঘুরে শিশু কিশোর, যারা এক স্টশন থেকে অন্য স্টশনে ঘোরাফেরা করে তারা রেল পুলিশ-আরপিএফের কাছে ‘চালানি’ এবং স্থানীয় বিভিন্ন বস্তির বাসিন্দারা ‘লোকাল’ হিসেবে পরিচিত।
দুরপাল্লার এবং প্যাসেঞ্জার ট্রেনে ঝাড়ু দিয়ে যাত্রীদের থেকে টাকা তুলে রোজগার করে এই শিশু কিশোররা। কেউ বা আবার স্টেশনে ফেলে দেওয়া জলের বোতল কুড়িয়ে খোলা বাজারে কেজি দরে বিক্রি করে, কেউ বা শুধুই ভিক্ষে করে। রাজু মালাকার (নাম পরিবর্তিত) নামে এক কিশোরের কথায়, “আগে হাওড়া স্টেশনে ছিলাম। ওখানে কড়াকড়ি বেশি। তাই দু’বছর হল এখানে চলে এসেছি। রাতে প্ল্যাটফর্মেই থাকি।” নেশা করিস কেন? বছর ১৪ থেকে মেরেকেটে ষোলোর শ্যাম “ওটাই তো আমাদের জান দাদা। সারাদিন বিন্দাস থাকি।” বছর পাঁচেক আগে উত্তরপ্রদেশের লালগোলা থেকে পালিয়ে দিল্লি স্টেশনে হয়ে নিউ জলপাইগুড়িতে এসেছে। প্ল্যাটফর্মে প্রকাশ্যে নেশা করতে দেখে কোনও যাত্রী বাধা দিলে ওই শিশু কিশোরদের মুখ থেকেই গালিগালাজ ভেসে আসে।
সম্প্রতি নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনকে ‘শিশু বান্ধব’ স্টেশন হিসেবে ঘোষণার তোড়জোর শুরু হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সহ রেল পুলিশ, আরপিএফের অফিসারদের নিয়ে তৈরি হয়েছে একটি শিশু রক্ষা কমিটিও। তবুও ব্যস্ত স্টেশনে শিশু-কিশোরদের প্রকাশ্যে নেশা করতে দেখা গেলেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না কেন? কেনই বা তাদের মুলস্রোতে ফিরিয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয় না?
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন শিশু রক্ষা কমিটিতে রয়েছেন রেল পুলিশের নিউ জলপাইগুড়ির ইন্সপেক্টর কোকিল রায়। তিনি বলেন, “স্টেশনের ২৫ জন শিশু-কিশোরকে চিহ্নিত করেছি। রেল পুলিশ নেশাগ্রস্তদের ধমক দেয়, কখনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাতে তুলে দেয়। কিন্তু আবার ওরা ফিরে আসে।” আরপিএফের নিউ জলপাইগুড়ির আইসি অরবিন্দ কুমার ঝাঁ বলেন, “কমিটি পুরদস্তুর কাজ শুরু করলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।” কমিটির আহ্বায়ক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মুখপাত্র তাপস কর্মকার বলেন, “ওদের নিয়মিত কাউন্সিলিং করা হয়। আমরা দু-একজনকে হোমে পাঠিয়ে মাদকাসক্তি ছাড়িয়েছি। তবে সমস্যা হল এরা হোমে গিয়ে অন্য আবাসিকদের মারধর করে। ওই শিশু কিশোরদের নেশা ছাড়িয়ে কী ভাবে মুলস্রোতে ফেরানো যায়, তাদের শিক্ষার বৃত্তে নিয়ে আসা যায়, তা আলোচনা করা হচ্ছে।” জলপাইগুড়ি জেলার সমাজকল্যাণ আধিকারিক বিজয় রায় বলেন, “নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাজ করে, তাদের সঙ্গে আলোচনা করব। ওই শিশুদেরও শিক্ষার অধিকার রয়েছে। আলোচনা করেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” |