প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর পুত্র চন্দন বসুর নির্মাণসংস্থাকে যাতে কোনও ছাড় না-দিয়ে বাণিজ্যিক দরে জমি দেওয়া হয়, রাজ্যের তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তই সে জন্য সওয়াল করেছিলেন। এর প্রামাণ্য নথি সিআইডি-র হাতে এসেছে। সরকারি সূত্রের দাবি, আবাসন-কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা অসীমবাবুর সই করা সেই নোট-শিটটি আবাসন দফতর থেকে বাজেয়াপ্ত করেছেন, যা এখন তাঁদের কাছে তুরুপের তাস। অসীমবাবুর সেই নোট-শিটটির উপরে তৎকালীন আবাসনমন্ত্রী গৌতম দেব যা লিখে দিয়েছিলেন তার নির্যাস: আবাসন দফতরই জমির দাম ঠিক করবে। অর্থ দফতরের কিছু করার নেই। এই বিবৃতিকেও অস্ত্র করছেন গোয়েন্দারা।
এবং এর সূত্র ধরে অর্থ দফতরের কাছে এই সংক্রান্ত আরও নথি চেয়ে পাঠানো হয়েছে। “সেগুলোর সাহায্যে সিআইডি আদালতে প্রমাণ করতে চায়, বসু-পুত্রকে সস্তায় জমি দিয়ে যে অনিয়ম হচ্ছে, তৎকালীন অর্থমন্ত্রীই তা লিখিত ভাবে নথিবদ্ধ করে গিয়েছেন।” জানাচ্ছেন মহাকরণের এক সূত্র।
সিআইডি’র তদন্তকারীদের অভিযোগ: অসীমবাবু বাজারদর মেনে জমির দাম স্থির করতে বললেও চন্দন বসুদের বেঙ্গল-গ্রিনফিল্ড হাউজিং ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি-কে কার্যত জলের দরে ৪৫ একর জমি দিয়েছিলেন তদানীন্তন আবাসনমন্ত্রী গৌতম দেব, যাতে সরকারের অন্তত কুড়ি কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। অর্থ দফতরের কাছে এ সংক্রান্ত যাবতীয় ফাইল তলব করেছে সিআইডি। তদন্তকারীরা চাইছেন আবাসন দফতর থেকে পাওয়া কুড়ি বছর আগের ফাইলগুলির সঙ্গে অর্থ দফতরের নথি মিলিয়ে দেখতে। অর্থ দফতরও ওই কাগজ খুঁজে বার করতে এক বিশেষ সচিবের নেতৃত্বে চার সদস্যের কমিটি গড়েছে বলে মহাকরণের খবর।
বছর বারো ধরে সরকারি প্রক্রিয়া ও টানাপোড়েনের পরে ২০০৫-এ দক্ষিণ ২৪ পরগনার চকজোত শিবরামপুরে পারুই মৌজার অন্তর্গত ৪৫.৬৯ একর জমি আবাসন দফতর দিয়েছিল বেঙ্গল-গ্রিনফিল্ড হাউজিং ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি নামে এক আবাসন নির্মাণ সংস্থাকে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য আবাসন পর্ষদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে গঠিত কোম্পানিটির সিংহভাগ মালিকানা চন্দন বসুর নামে। পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদলের পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ক্ষমতায় এসে সিদ্ধান্ত নেয়, যৌথ উদ্যোগের বিভিন্ন সংস্থায় বিশেষ অডিট করানো হবে। আর সেই স্পেশ্যাল অডিটেই গ্রিনফিল্ডের প্রকল্প ঘিরে ‘অনিয়মের’ অভিযোগ উঠে এসেছে। মূল অভিযোগ দু’টো। এক, বাজারদরের তুলনায় বহু সস্তায় জমি দেওয়া হয়েছে। দুই, আবাসন নির্মাণকারী সংস্থা নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনও নিয়ম মানা হয়নি। |
শেষ পর্যন্ত অভিযোগের তদন্তভার গিয়েছে সিআইডি’র হাতে। সরকারি সূত্রের খবর: গত ১০ জুলাই সিআইডি’র এডিজি শিবাজী ঘোষ রাজ্যের অর্থসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, তালতলা থানায় চলতি বছরে দায়ের হওয়া সংশ্লিষ্ট মামলাটির তদন্ত সিআইডি করছে। এই সূত্রে এডিজি অর্থ-সচিবের কাছে জানতে চেয়েছেন, গ্রিনফিল্ডের প্রকল্প সম্পর্কে তদানীন্তন অর্থমন্ত্রীর অবস্থান কী ছিল? পাশাপাশি আবাসন দফতরের ফাইল থেকে তাঁরা কী ইঙ্গিত পেয়েছেন, গোয়েন্দা-কর্তা তা-ও জানিয়েছেন অর্থ-কর্তাকে। কী রকম?
ওই চিঠিতে (মেমো নম্বর ১২৭/এডিজি/সিআইডি/সিওএন) শিবাজীবাবু অর্থসচিবকে লিখেছেন, আবাসনের নথি ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, গ্রিনফিল্ড-কে সস্তায় জমি দিতে অসীমবাবুর আপত্তি ছিল। এ বিষয়ে ১৯৯৩-এর ২২ ডিসেম্বর এক নোট-শিটে তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী পরিষ্কার লিখেছিলেন, ‘সরকারি জমি কোনও যৌথ উদ্যোগের সংস্থাকে দিতে হলেও তার দাম ধরা উচিত বাণিজ্যিক হারে। এবং অর্থ দফতরের সঙ্গে কথা বলেই দাম নির্ধারিত হওয়া উচিত।’ চিঠিতে সিআইডি-কর্তার দাবি: প্রকল্পে অর্থমন্ত্রীর ছাড়পত্রের পরিবর্তে তাঁর এ হেন মতামত সংবলিত ফাইল যখন আবাসন দফতরে পৌঁছায়, তৎকালীন আবাসনমন্ত্রী তা মানেননি। উল্টে গৌতমবাবু অর্থমন্ত্রীর নোটের উপরে লিখে দেন, ‘এ জাতীয় যৌথ উদ্যোগের সংস্থাকে কোন শর্তে জমি দেওয়া হবে, বিশিষ্ট আইনজীবী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ও রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব তরুণ দত্ত তা ঠিক করেছেন। সেই নীতি মেনে আবাসন দফতরই জমির দাম ঠিক করবে। এখানে অর্থ দফতরের কিছু করার নেই।’
এর পরেই বেঙ্গল গ্রিনফিল্ড-কে সস্তায় জমি দেওয়া হয় বলে অর্থ-সচিবকে চিঠিতে জানিয়েছেন সিআইডি’র এডিজি। তাঁরা ইতিমধ্যে গৌতমবাবু, তাঁর আপ্ত সহায়ক ও গ্রিনফিল্ডের বেশ ক’জন কর্তাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। সিআইডি-সূত্রে বলা হচ্ছে, অর্থ দফতরের বক্তব্য জানা গেলেই গৌতম দেবের আবাসন কেলেঙ্কারি-মামলায় অসীমবাবুর বক্তব্য নথিভুক্ত করা হবে। এ জন্য প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীকে ডেকে পাঠানো হতে পারে। সিআইডি ঠিক কী করবে জানতে চাওয়া হলে এডিজি শিবাজীবাবুর জবাব, “তদন্তের গতি-প্রকৃতি নিয়ে মন্তব্য করব না। তদন্তে প্রয়োজনীয় কোনও নথি সম্পর্কেও আলোচনা করা যায় না। তবে বক্তব্য জানার জন্য কাউকে ডাকা হলে জানিয়ে দেওয়া হবে।”
যাঁর স্বাক্ষরিত নোটশিটকে আবাসন-কেলেঙ্কারির ‘প্রামাণ্য নথি’ হিসেবে সিআইডি কাজে লাগাতে চাইছে, সেই অসীমবাবুও এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে রাজি হননি। যদিও বাম জমানার অর্থ দফতর সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল এক কর্তা বলেছেন, “তৎকালীন অর্থমন্ত্রী নির্দিষ্ট নীতি মেনেই ওই নোট দিয়েছিলেন। জ্যোতি বসু তখন মুখ্যমন্ত্রী। তা সত্ত্বেও তাঁর ছেলের কোম্পানির প্রকল্প নিয়ে এমন মতামত দিতে অসীমবাবু পিছপা হননি!” চন্দনবাবুর কী বক্তব্য?
শুক্রবার ফোনে চন্দনবাবুর প্রতিক্রিয়া, “আমি ব্যবসায়ী। সরকারি নোটে কী আছে, তা নিয়ে আমি কী বলব?” তাঁর এ-ও দাবি, “যে জমি নিয়ে বিতর্ক, তার মালিক তো আমি নই। মালিকানা এখনও আবাসন পর্ষদের হাতে। আমাকে শুধু সেখানে নির্মাণের অধিকার দেওয়া হয়েছিল। সেই কাজ নিয়ম মেনেই হয়েছে।” আর চন্দনবাবুর সংস্থাকে সস্তায় জমি ‘পাইয়ে দেওয়ার’ জন্য মূলত যাঁর দিকে আঙুল উঠছে, সেই গৌতমবাবুর মন্তব্য, “এমন কোনও কাগজপত্র আছে কি না, জানা নেই। তবে আমাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে হেনস্থা করার জন্য সিআইডি-র বিরুদ্ধে মামলা করছি। ঠিক সময়ে ওদের বুঝে নেব।”
যে দুই ব্যক্তির মতামতের ভিত্তিতে যৌথ উদ্যোগের সংস্থাকে সস্তায় জমি দেওয়ার কথা আবাসনের নথিতে লেখা রয়েছে, তাঁদের মধ্যে প্রাক্তন মুখ্যসচিব তরুণবাবু প্রয়াত হয়েছেন। অন্য জন, অর্থাৎ লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার তথা আইনজীবী সোমনাথবাবু কী বলেন?
সোমনাথবাবুর ব্যাখ্যা, “ওই সময়ে সরকারের হাতে জমি ছিল, টাকা ছিল না। নিজস্ব বিবেচনায় আমার যা মনে হয়েছিল, পরামর্শ আকারে সরকারকে জানিয়েছিলাম। আর্থিক সঙ্কটের দরুণ নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের বাড়ি তৈরির সংস্থান হচ্ছিল না। আমি বলেছিলাম, যৌথ উদ্যোগের সংস্থা বানিয়ে গরিবের আবাসন-সমস্যা মেটানো হোক। জমির দামের চেয়েও সেখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল আবাসন-সমস্যা।”
কিন্তু সরকার তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করেছিল কি না, তা তিনি জানেন না বলে সোমনাথবাবুর দাবি। “গ্রহণ করতেই হবে, এমন বাধ্যবাধকতা তো ছিল না! তা ছাড়া কোনও সাংবিধানিক পদে থেকে আমি পরামর্শ দিইনি।” বলছেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়।
|