ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড অলিন্দের খবর যদি বিশ্বাস করতে হয়, আগামী মঙ্গলবার চিঠিটা পাঠানোর জন্য নাকি কম্পোজও হয়ে গিয়েছিল!
প্রেরক নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন। সম্ভাব্য প্রাপক জগমোহন ডালমিয়া। খসড়া চিঠিতে লেখা হয়েছিল, ভারতীয় বোর্ডের সঙ্কটকালীন সময়ে আপনি যে অন্তর্বর্তিকালীন নেতা হিসেবে হাল ধরতে সম্মত হয়েছিলেন, তার জন্য আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ।
ঘটনাচক্রে মঙ্গলবার বিসিসিআই চিঠিই তৈরি করছে। তবে সেটা ডালমিয়ার জন্য নয়। সুপ্রিম কোর্টে স্পেশ্যাল লিভ পিটিশন দাখিল করার জন্য। কৃতজ্ঞতার চিঠি লেখার প্ল্যান ঘুরে গিয়েছে একশো আশি ডিগ্রি। ডালমিয়াই এখনকার মতো থেকে যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে। আর বোর্ড উপর্যুপরি ঢেউয়ের আক্রমণ থেকে নোঙরে থিতু হওয়ার আশায় সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছে।
শুক্রবার রাত পর্যন্ত ভারতীয় ক্রিকেটমহলে বিস্তর আলোচনা চালু থাকল যে, দিনের স্কোরবোর্ড তা হলে কী? শ্রীনি হারলেন? না জিতলেন?
কারও কারও মনে হচ্ছে জিতলেন। কারণ, আইপিএল কাউন্সিলের বৈঠক তাঁর বিরুদ্ধে একটা কথাও বলল না। নতুন তদন্ত কমিশন গঠন করতে চাইল না। শ্রীনির গড়া পুরনো কমিশনেই ফের সিলমোহর দিয়ে বলল, আইন মেনেই এটা করা হয়েছে। শ্রীনির হয়েই সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হল। এটা তো তাঁর জয়।
ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকও টেকনিক্যাল কারণে ভেস্তে যাওয়ায় শ্রীনি সরাসরি কারও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেন না। সচিব সঞ্জয় পাটিল টিভি ক্যামেরার সামনে প্রকাশ্যেই তাঁর প্রতি আনুগত্য দেখালেন। সকাল থেকে রাত অবধি মৌর্য শেরাটন হোটেলে টন-টন মিডিয়ার উপস্থিতি সত্ত্বেও এক জনও এসে প্রকাশ্যে শ্রীনি-বিরোধিতা করেননি। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, টালমাটাল যতই তীব্র হোক, শীর্ষকর্তা দুলুনি ঠিক সামলে নিয়েছেন!
গরিষ্ঠ মত যদিও নিঃসন্দেহ, স্কোরবোর্ডে ফুটে উঠেছে শ্রীনি হেরেছেন। চরম মরিয়া হয়ে দিল্লিতে তিনি এসেছিলেন মসনদে বসে পড়বেন বলে। তাঁর ঘনিষ্ঠ শিবির থেকেই ডালমিয়ার জন্য ‘থ্যাঙ্কসগিভিং লেটার’ তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
তিনি এমনও ভেবেছিলেন, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ওয়ার্কিং কমিটিতে ফেলে এ দিনই পাশ করিয়ে নেবেন। সভাটাও চেয়ার করবেন। কোনও কিছুই হল না। বরঞ্চ রাত্তিরে তামিলনাড়ু বিমানবন্দরে তাঁর মুখের আশঙ্কাজনক রেখা এবং শরীরী ভাষাই বোধহয় বলে দিচ্ছিল, এমন দিন বোর্ডে আসবে তিনি কখনও ভাবেননি।
সাধারণত বোর্ডের বৈঠকে তিনি আসেন, সরাসরি ঢুকে যান। সদস্যদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় ঘরের ভেতর। শুক্রবার সকাল ব্যতিক্রম। যে দিন সকাল ন’টা থেকে রিপোর্টাররা অবাক হয়ে দেখেন, তিনি হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে। আইপিএল কাউন্সিল সদস্য ও বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ মুখদের এমন ভাবে শ্রীনিবাসন অভ্যর্থনা করে নিয়ে যাচ্ছিলেন, যেন এঁরা এক-এক জন বরযাত্রী। অরুণ জেটলি আসামাত্র তাঁকে উষ্ণ করমর্দনে চেপে ধরে নিজের ঘরে নিয়ে যান। তখনও যে শ্রীনি আঁচ পাননি, উষ্ণ বিরোধিতার চোরাস্রোত তাঁর জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে।
ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক হলে এই বিরোধিতাগুলো আরও খুল্লমখুল্লা প্রকাশ্যে আসত। আর তখন দেখা যেত, হামাগুড়ি না দিয়ে যাঁরা বিদ্রোহীদের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন, তাঁরা কার্যত গ্ল্যামারাস
এক সেট-আপের কমন ম্যান। জেটলি বা শুক্লর মতো এঁদের কাগজে ছবি বেরোয় না। অত লোকেও চেনে না। এ রকমই কেউ কেউ পঞ্জাবের পাণ্ডব, বিদর্ভের সুদীপ দাভে, গুজরাতের নিরঞ্জন শাহ সকলে আজ এককাট্টা ছিলেন পদত্যাগপত্র জমা দিতে। নয়াদিল্লি আসার আগে শ্রীনিবাসন আঁচই পাননি, বোর্ডের এত কালের কমন ম্যানেরা তাঁর বিরুদ্ধে ফুঁসছেন। সচিব সঞ্জয় পাটিল সভা না হওয়ার কারণ হিসেবে বললেন, নোটিসে ‘ইমার্জেন্ট’ শব্দটা বাদ গেছে। ইমার্জেন্ট না থেকে স্বাভাবিক ওয়ার্কিং কমিটি হলে অন্তত সাত দিনের নোটিস দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সেটা দেওয়া হয়নি। এই টেকনিক্যাল কারণেই সভা করা গেল না।
উপস্থিত সাংবাদিকদের কেউ পাল্টা প্রশ্ন করেননি যে, একই ভাবে চেন্নাইয়ের ওয়ার্কিং কমিটি বৈঠক যখন ডালমিয়াকে অন্তর্বর্তিকালীন প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করেছিল, সে বারেও তো নোটিসে ইমার্জেন্ট কথাটা লেখা হয়নি। অথচ সভায় সদস্যরা বলেছিলেন, সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাঁরা সবাই একমত। আপদকালীন সভাটা যে না করলেই নয়, সে ব্যাপারেও ওই দিন কারও কোনও আপত্তি ছিল না। সেটাই নয়াদিল্লিতে করা হল না কেন? শ্রীনি-ভক্ত সচিব কী উত্তর দিতেন বলা শক্ত। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসন জানে, সেটা তখনই সম্ভব যদি সদস্যদের ওপর প্রেসিডেন্টের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকে। বিভক্ত ওয়ার্কিং কমিটিকে দিয়ে শুক্রবার একই কথা বলানো সম্ভব ছিল না। আর তাই সভা করা হয়নি।
শুধু বোর্ড সদস্যরাই নন, আইপিএলের কিছু কিছু ফ্র্যাঞ্চাইজিও খুব বিরক্ত বোর্ডের সাম্প্রতিক হালচালে। তাদের কারও কারও মনে হচ্ছে আইপিএলের মতো ব্র্যান্ডকে রক্ষার জন্য বোর্ডের আরও উদ্যোগী হওয়া উচিত। যা প্রচার আর লেখাপত্র হচ্ছে, সবই আইপিএল-বিরোধী। সবচেয়ে বড় কথা, দু’মাসেরও বেশি হয়ে গেল, সঙ্কট চলছে। বোর্ড এক বারও তাদের ডেকে আশ্বস্ত করেনি যে, আপনারা অক্ষত আছেন। কোনও চিন্তা করবেন না। কোনও কোনও ফ্র্যাঞ্চাইজি কর্তা ইতিমধ্যেই শ্রীনি-ঘনিষ্ঠ আইপিএল সিইও সুন্দর রামনকে নিজেদের অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন। অসন্তোষের কথা এ দিন প্রকাশ্যে বললেন কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহও। ক্রীড়ামন্ত্রী বলেছেন, ক্রিকেটের আজ রমরমা, কিন্তু জনতার বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারার জন্য। ক্রিকেট কর্তাদের আগে এই বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। তার পর না হয় প্রেসিডেন্ট পদে ফেরা নিয়ে ভাবা যাবে।
ইতিমধ্যেই বোর্ডের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, সুপ্রিম কোর্টে গেলে কী কী পরিস্থিতি হতে পারে? আর তাতে কত দিনই বা লাগবে? |
ললিত মোদীর টুইট |
বিতর্ক যখন তুঙ্গে আইপিএল চেয়ারম্যান হিসেবে পদত্যাগ করে রাজীব শুক্ল। কিন্তু গত সপ্তাহে লন্ডনেই তো ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ টি-টোয়েন্টি বৈঠকে এসেছিল। বিপদের গন্ধ পেলেই ও ল্যাজ গুটিয়ে পালায়। আবার ফিক্সারটা ফিরে এসেছে। |
|
আইন-ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত কেউ কেউ বোর্ডকে পরামর্শ দিয়েছেন, এমন হতেই পারে যে, সুপ্রিম কোর্ট মামলাটা নিল না। ফিরিয়ে দিল বম্বে হাইকোর্টের কাছে। সেই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আর একটা হতে পারে, কোর্ট মামলা নিল, কিন্তু সময় নিল অনেক। আর এটা হলেই শ্রীনিবাসনের কাছে তা সমস্যা নয়, যন্ত্রণা। কারণ সেপ্টেম্বরে তিনি খুব বেশি ভাবেই পুনর্নির্বাচিত হতে চান। সেপ্টেম্বরের আগে রায় না এলে তো শ্রীনি পুরো আটকে গেলেন। গুজব রটেছে আরও একটা আইনের ধারা নিয়েও। বম্বে হাইকোর্ট তাদের রায়ে বলেছিল, আইপিএল কোড অফ বিহেভিয়ার কমিটি থেকে এক জন সদস্যের কমিশনে থাকার কথা ছিল। সেটা না রেখে বিসিসিআই সংবিধান অমান্য করেছে। বোর্ড সদস্যরা কেউ কেউ এ দিন বলাবলি করছিলেন, সুপ্রিম কোর্টেও তো এই অসঙ্গতির কথা উঠতে পারে।
কেউ কেউ আবার বলছেন, বোর্ড নাকি হলফনামা দিয়ে বলবে, তারা সংবিধানের এই ধারা বদলেছে। সেটা নাকি হয়েছে জুনে। প্রশ্ন উঠেছে, জুনেই যদি ওই বদল হয়ে থাকে, তা হলে বোর্ড তা হাইকোর্টকে জানাল না কেন? আর সংবিধান যে বদলাল, কাকে জানিয়ে বদলানো হল?
বিহার ক্রিকেট সংস্থার সচিব আদিত্যপ্রতাপ বর্মা সভা চলাকালীন দিল্লিতেই বসে ছিলেন। তিনি ফের হুঙ্কার ছেড়েছেন, “আমার ক্যাভিয়েট সুপ্রিম কোর্টে দেওয়া আছে। বোর্ডকে সুপ্রিম কোর্ট ডাকলে আমাকেও সঙ্গে ডাকতে হবে। তা ছাড়া, সুপ্রিম কোর্ট ওদের অবধারিত বলবে, ভারতের দু’টো রাজ্যের পুলিশ গুরুনাথের কেসটার তদন্ত করছে। ওদের শেষ করতে দাও, এত তাড়াহুড়ো কীসের তোমাদের?”
বোঝাই যাচ্ছে তামিলনাড়ুর ক্রিকেট কর্তার পক্ষে নানা দিক থেকে জট ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, শ্রীনি সেপ্টেম্বরে ফিরতে পারুন বা না পারুন, ভারতীয় বোর্ডের একক কর্তৃত্ব যে তিনি হারিয়েছেন, নয়াদিল্লির শুক্রবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। এর পর সেপ্টেম্বরে যদি তাঁকে ফের ক্ষমতা দখল করতে হয়, সেটা আর নিরঙ্কুশ হবে না।
আজ শ্রীনি হারলেন না জিতলেন তা নিয়ে যতই সংশয় থাক, বহু বছর বাদে সেপ্টেম্বরে যে তীব্র কামড়াকামড়ির বিসিসিআই নির্বাচন হচ্ছেই, নিশ্চিন্তে বলে দেওয়া যায়।
|