শ্রীনির কপালে টিভি ক্যামেরার গুঁতো
দিল্লিতে আজ হামাগুড়ি বেশি, বিদ্রোহ কম
ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের পঁচাশি বছরের ইতিহাসে অজস্র রংবাহারি দিনের মধ্যেও শুক্রবার নয়াদিল্লির দোসরা অগস্টের মতো বৈচিত্রময় পরিস্থিতি কখনও আসেনি। বিসিসিআই তার ইতিহাসে অনেক একগুঁয়ে আর স্বেচ্ছাচারি প্রেসিডেন্টের দেখা পেয়েছে। কিন্তু এমন কেউ কখনও আসেননি যিনি আদালতের পরিষ্কার নির্দেশ অমান্য করেও সভাপতিত্ব করার মনোভাবে এককাট্টা! ওয়ার্কিং কমিটির বাকি তেইশ সদস্যের ওপরেও সর্বগ্রাসী প্রচারের আলো এ ভাবে কখনও আসেনি যে, ঐতিহাসিক প্রশাসনিক সঙ্কটে কোন পথে হাঁটবেন তাঁরা? বিবেকের ডাক মেনে যেমন হামাগুড়ি চলছে, সেটাই কি চলবে? নাকি একাধিক বিদ্রোহী মুখ উঠে আসবে দক্ষিণী প্রেসিডেন্টের আধিপত্যকে পাত্তা না দিয়ে?
নাটক শুরু হয়ে গেল আগের দিন রাত্তিরে নয়াদিল্লি বিমানবন্দর থেকেই। যখন ভিড়ের মধ্যে টিভি ক্যামেরার গুঁতো খেয়ে উত্তেজিত নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন জানিয়ে দিলেন তিনি একটা কথাও বলবেন না। মিডিয়া বিমানবন্দরে ভিড় করেছিল তিনি দিল্লি নামার পর কথা বলবে বলে। জটলার মধ্যে সাংবাদিকদের তাঁর কাছে যাওয়ার চেষ্টায় একটা ক্যামেরার কোনা লেগে যায় শ্রীনির কপালে। শ্রীনি চিৎকার করে বলতে থাকেন, “এই ক্যামেরাতে আমি চোট পেয়েছি। আপনারা ক্যামেরা দিয়ে মারতে পারেন না আমাকে। এটা আমি একদমই মানব না।” সাংবাদিকরা তখনও কথা বলতে চাইছেন দেখে আরও রেগে বলেন, “আমাকে এ বার গাড়িতে উঠতে দেবেন? আমার নিজের গাড়িতে ওঠার অধিকার আছে। আমাকে যেতে দিন। একটা প্রশ্নেরও উত্তর দেব না।”
তার আগেই অবশ্য বোর্ড সচিব সঞ্জয় পাটিল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নয়াদিল্লির হোটেলে প্রতীক্ষারত সাংবাদিকদের খুব সহজ ভাবে দু’লাইনে জানিয়ে দেন সেই প্রশ্নের উত্তর, যা জেনেও সরকারি ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করে ছিল গোটা ক্রিকেট ভারতবর্ষ। হালফিল ভারতের অধিনায়ক নির্বাচনের আগেও এত জল্পনা তৈরি হয়নি যে কে হবেন ক্যাপ্টেন? যে পরিমাণ জল্পনা গোটা দিন ধরে চলল যে শ্রীনিবাসন কি সত্যিই ঢুকে পড়বেন দিল্লির বৈঠকে? যদি পড়েন, গোটা ওয়ার্কিং কমিটি তো আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত হতে পারে। কোনও এক ব্যক্তির খাতিরে কি গোটা বোর্ডকে উচ্ছন্নে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে যেতে দেওয়া যায়? পাটিল অবশ্য খুব সহজ ভাবেই জানিয়ে দিলেন, শ্রীনিবাসন আমাদের প্রেসিডেন্ট। ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে উনিই সভাপতিত্ব করবেন। শুনে পাল্টা তড়পালেন বিহার ক্রিকেট সংস্থার সচিব আদিত্য বর্মা। “এক বার সভাপতিত্ব করে উনি দেখুন না। সঙ্গে সঙ্গে আমরা আদালতে চলে যাব।”
দিনভর নানান চেষ্টার পরেও রাতে দফায় দফায় বোর্ডের মাথাদের বৈঠক চলল। তখনও কোনও সমাধানের খোঁজ নেই। জগমোহন ডালমিয়ার মতো কেউ কেউ এমন একটা সম্ভাবনার কথা ভাবছিলেন যদি সভাটাকেই মুলতুবি করে দেওয়া যায়। আর তার পর ঠান্ডা মাথায় আদালত অবমাননার ঝুঁকি না নিয়ে বোর্ড পরের রাস্তা ঠিক করতে পারে। শ্রীনিবাসন এ সব শান্তিকামী কথাবার্তা শুনতেই নারাজ। তিনি ব্যাট করতে চান ফ্রন্টফুটে। প্রয়োজনে হুক, পুল সব করতে রাজি। দিল্লিতে এসেছি তো মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করেই ছাড়ব এই হচ্ছে তাঁর মনোভাব। বিহার ক্রিকেট সংস্থার বার করে আনা কোর্টের নির্দেশকে পাত্তা দিতেই রাজি নন।
অভিজ্ঞ মাথাদের কেউ কেউ বোঝাবার চেষ্টা করেছেন, বিহার আমাদের অনুমোদিত সংস্থা নয় বলে তাদের বার করে আনা রায় আমাদের ওপর বর্তায় না এটা ভুল ধারণা। এঁদের মতে আদিত্য বর্মা যদি কোর্টে রিট পিটিশন করতেন, সেটা তবু উপেক্ষার জায়গা ছিল। কিন্তু তিনি, হয় নিজের সিদ্ধান্তে বা ধূর্ত কারও মদতে জনস্বার্থ মামলা করেছেন। জনস্বার্থ মামলার রায় সেই সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানের ওপর বর্তাতে বাধ্য। আর রিপোর্টে পরিষ্কার বলাই আছে যে, বিসিসিআইয়ের প্রচলিত নিয়ম চরম উপেক্ষা করে এই দু’সদস্যের কমিটি তৈরি হয়েছিল। রিপোর্টের ৬১ নম্বর পরিচ্ছেদ অনুযায়ী এক জন সদস্যের থাকার কথা আইপিএলের ‘কোড অব বিহেভিয়ার’ কমিটি থেকে। কাউকে রাখা হয়নি। দ্বিতীয়ত, বিসিসিআই প্রমাণ করতে পারেনি যে তদন্ত কমিটি গঠনের ব্যাপারে তার প্রেসিডেন্ট কোনও ভাবে জড়িত ছিলেন না।
রাতে কলকাতা থেকে ভাইরাল জ্বর নিয়ে যাওয়া অসুস্থ বিষেণ সিংহ বেদি নয়াদিল্লি থেকে ফোনে বললেন, “এ তো জোর জুলুমবাজি চলছে দেখছি যে, কোনও কথা শুনব না। জোর করে বৈঠক অ্যাটেন্ড করবই।” বেদির দ্বিতীয় প্রশ্নের সঙ্গে কিন্তু ক্রিকেটমহল সম্পূর্ণ সহানুভূতিশীল। তা হল, শ্রীনি না হয় বুঝলাম। বাকিরা কী করছে?
সার্বিক বক্তব্যও তাই। শ্রীনিবাসন মরিয়া হয়ে পুরনো সাম্রাজ্যে ফেরার চেষ্টা করতেই পারেন। বোর্ডের বাকি হেভিওয়েটরা কী করছেন? ডালমিয়া, তাঁর মুখে কোনও কথা নেই। যেন রাজস্থান ক্লাব থেকে এই প্রথম বোর্ডে গেলেন। রাজীব শুক্ল তাঁর চিরপ্রিয় সঙ্গী টিভি ক্যামেরার দিকে তাকাচ্ছেন না পর্যন্ত। ললিত মোদীর সময়ে বোর্ডের ‘ন্যায়ের মুখ’ হিসেবে যিনি প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন, সেই অরুণ জেটলি এতই চুপচাপ, যেন কারও মৃত্যুতে নীরবতা পালন করছেন। শশাঙ্ক মনোহর সহ একাধিক বোর্ডকর্তা জেটলিকে ফোন করেও শ্রীনির ব্যাপারে তাঁর ক্রিকেট মননকে সক্রিয় করাতে পারেননি। ঠিক যে সময় ভারতীয় ক্রিকেটের পরিস্থিতি তাঁর কাছে সবচেয়ে সরব হওয়া প্রত্যাশা করেছিল, সেই সময় সভার আগের রাত পর্যন্ত জেটলি আশ্চর্য নিষ্ক্রিয়। তাঁর ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ বলছিলেন, উনি ঠিক তাস ফেলবেন সভার আগে। গরিষ্ঠদের তেমন আশা নেই।
জেটলিকে যদি বা শুক্রবার সামান্য সক্রিয় দেখায়, সম্পূর্ণ অন্য কারণে দেখাবে। তাঁর মধ্যে কেউ কেউ আশঙ্কা ছড়ানোর চেষ্টা করছেন, আপনি যদি এখন প্রতিবাদ না করেন তা হলে ললিত মোদী বোর্ডে ফিরে চলে আসতে পারে। মোদী দীর্ঘ চার বছর বাদে সোমবার ফোন করেছিলেন পশ্চিমাঞ্চলের প্রাক্তন প্রভাবশালী প্রেসিডেন্টকে। ফোনে বলেছেন, “আমার জন্য যা নিয়ম ছিল, শ্রীনিবাসনের জন্য দু’রকম হচ্ছে কেন? আমিও কিন্তু লোক বাড়াচ্ছি। আমাকে শাস্তি দেওয়া এত সহজ হবে না।” লন্ডনে বসে মোদী দিনভর টুইট করে গেছেন শ্রীনির বিরুদ্ধে। ভারতীয় ক্রিকেটে অভূতপূর্ব ভাবে আবার সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে শ্রীনিবাসনকে মিটিংয়ে যেতে না দেওয়ার জন্য পিটিশন ক্যাম্পেন শুরু হয়ে গেছে। যা রিটুইট করেছেন মোদী।
জেটলির নেতৃত্বে শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি সুপারিশ করেছে মোদীকে বিসিসিআই থেকে চিরতরে বহিষ্কারের। তার জন্য সেপ্টেম্বরের বার্ষিক সাধারণ সভায় দুই-তৃতীয়াংশ ভোট দরকার। অর্থাৎ ২৪। প্রস্তাবের বিরোধিতা করে যদি ৮ জন দাঁড়িয়ে যায়, তা হলেই মোদীর বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। মোদী হুমকি দেওয়ার পর বোর্ড চাপে পড়ে গেছে যে যদি ৮ জন তিনি জোগাড় করে ফেলেন, বোর্ড বেইজ্জত হয়ে যাবে। কারণ ভেতরে একটা চোরাস্রোত সত্যিই মনে করছে দু’জনের বেলা আলাদা নিয়ম হয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন হল চোরাস্রোত আদৌ বাইরে আসবে কি না? অর্ধেকেরই বাইরে এসে বলার সাহস নেই। বোর্ডের ব্যালট বাক্সে যে শ্রীনি এখনও সবার আগে, সভাপূর্ব হালচাল দেখলেই বোঝা সম্ভব। শরদ পওয়ার কৌশলগত কারণে এখনও সামনে আসছেন না। সেটা না হয় বোঝা গেল। ওয়ার্কিং কমিটিতে তিনি নেইও। কিন্তু বাকিরা বহু প্ররোচনাতেও বিবৃতি দিতে এ দিন রাজি হননি। বিরোধীরা খুঁজে পান প্রাক্তন বোর্ড কোষাধ্যক্ষ অজয় শিরকে-কে। কিন্তু শিরকে তো এখন প্রাক্তন। তাঁর কথা শুনছে কে?
বরঞ্চ শশাঙ্ক মনোহর পেছন থেকে অনেক সক্রিয়। নাগপুরবাসী প্রাক্তন বোর্ড প্রেসিডেন্ট ঠোঁটকাটা চরমপন্থী হিসেবে বরাবরই পরিচিত। শশাঙ্ক মনে করেন বোর্ডের ভাবমূর্তির সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে তাঁর উদ্যোগেই এ দিন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নিরঞ্জন শাহ নতুন প্যানেলের দাবি তোলার সাহস পেলেন। নিরঞ্জন একই সঙ্গে প্রশাসক হিসেবে নতুন রেকর্ড করলেন। গত দু’সপ্তাহে এটা তাঁর তৃতীয় রেকর্ডেড ডিগবাজি। যেখানে ‘আমি বলিনি’-রও কোনও অবকাশ নেই। স্পট-ফিক্সিং বিতর্কের সময় প্রথম ক্যামেরার সামনে বলেছিলেন শ্রীনিকে সরিয়ে নতুন লোক আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। কলকাতায় গত রবিবার বলেছেন, কেন দেরি করছি? এখনই শ্রীনিকে ফিরিয়ে আনা উচিত। সেই মর্মে প্রেস বিবৃতি দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার আবার কিনা বললেন, “বোর্ডের ভাবমূর্তির ক্ষতি হচ্ছে। শ্রীনিকে অমান্য করে নতুন স্বাধীন প্যানেল হোক। যা স্পট-ফিক্সিং তদন্ত নতুন করে করবে।”
এমনই প্রভূত ভাবী রঙ্গরস শুক্রবারের নয়াদিল্লিতে অপেক্ষা করে থাকা উচিত। আর তা হলে বিনোদনে ভরা টি-টোয়েন্টি ম্যাচের শেষ ওভারও প্রতিদ্বন্দ্বিতার সামনে পড়বে!

পুরনো খবর:




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.