|
|
|
|
|
|
|
আপনার সাহায্যে ১... |
|
ইচ্ছে হলেই মা
আর আপনাকে কেউ বন্ধ্যা বলে শাপশাপান্ত করতে পারবে না।
লিখছেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় |
স্বামী মারা যাওয়ার দেড় বছর পর তাঁর শুক্রাণু দিয়েই গর্ভবতী হয়েছিলেন কলকাতার এক সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নার্স! জন্ম দিয়েছেন ফুটফুটে মেয়ের।
সম্ভব।
জরায়ুতে ক্যানসার হয়েছিল আন্দুলের বাসিন্দা বছর সাতাশের মহিলার। তার মধ্যেই ন’মাস সন্তান ধারণের পর গত মে মাসে দিব্যি সুস্থ সন্তান হয়েছে তাঁর।
এ-ও সম্ভব।
হরমোন থেরাপিতে মেয়ে থেকে ছেলে হয়ে গিয়েছিলেন আমেরিকার অ্যারিজোনার বেটি এবং ক্যালিফোর্নিয়ার স্কট মুর। তবে রূপান্তরকামিতার মধ্যেও সুপ্ত ছিল মা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। তাই শরীরের মধ্যে ডিম্বাশয় আর জরায়ুটা রেখে দিয়েছিলেন। তার দৌলতে এই দুই ‘বাবা’ সুস্থ সন্তানের জন্ম দিয়ে খবরের শিরোনামে এসেছেন!
বিশ্বাস করুন, সম্ভব।
জটিলতার দিন শেষ
মাত্র আঠাশ বছর বয়সে মেনোপজ হয়ে গিয়েছিল দমদম পার্কের এক তরুণীর। গত জানুয়ারিতে তিনিও নিজের সন্তানের জন্ম দিতে পেরেছেন!
আসলে ‘রিপ্রোডাকটিভ সায়েন্স’ ব্যাপারটা এখন সারা বিশ্বের সঙ্গে এই কলকাতাতেও এতটা আলট্রা-আধুনিক হয়ে গিয়েছে যে, জটিলস্য জটিল শারীরিক সমস্যা নস্যি হয়ে যাচ্ছে। যেমন ধরুন
এক, এমন অনেক মহিলা রয়েছেন যাঁদের সন্তান উৎপাদনে সমস্যা হয় না, কিন্তু সন্তান ধারণে অসুবিধা হয়। কারণ তাঁদের জরায়ুতে ভ্রূণটি ঠিকমতো প্রতিস্থাপিত হয় না। একের পর এক গর্ভপাত ঘটে যায়। এখন এমন চিকিৎসা বার হয়েছে যাতে ভ্রূণ জরায়ুতে সঠিকভাবে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব।
দুই, মা বা বাবার কোনও জিনগত রোগ সন্তানের মধ্যে চলে যেতে পারে এমন ক্ষেত্রেও নিজের সন্তান নিতে তাঁরা ভয় পেতেন। সেই ভয়ও অনেকটা মুছে দেওয়া গিয়েছে। যেমন মা-বাবা থ্যালাসেমিয়ার কেরিয়ার হলে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এখন এই দম্পতিদের টেস্টটিউব পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে বলা হয়। তাতে ল্যাবরেটরিতেই ভ্রূণ তৈরি করে তার দেহরস পরীক্ষা করা হয়। রোগ পাওয়া গেলে দেহে প্রতিস্থাপনের আগেই তা নষ্ট করে ফেলা হয়। অসুস্থ শিশু হওয়ার ঝুঁকিও অনেক কমে।
তিন, এখন এমনকী এইচআইভি-আক্রান্ত মহিলাও মা হতে পারেন। শুধু দরকার একটা নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতির।
হাজার পথ, টেনশন যাক
সে একটা মান্ধাতার সময় ছিল যখন একটা বাচ্চার জন্য লোকে গাছের তলায় একটা পাথর পড়ে থাকতে দেখলেও তাতে মাথা ঠুকতেন। পান চিবিয়ে-চিবিয়ে ছেলেকে দ্বিতীয় বিয়ের নিদান দিতেন ডাকসাইটে মা। বাচ্চা হয়নি বলে বৌকে বাড়ির উৎসব-অনুষ্ঠানে ব্রাত্য রাখা হত।
ও সব এখন শুধু সাদা-কালো বাংলা সিনেমায় সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞানের হাতে এসে গিয়েছে হাজারো পথ, লক্ষ ‘অপশনস’। তাই বিজ্ঞাপনীয় ভাষায় বলাই যায়, ‘টেনশন যাক পেনশন নিতে’।
ইনফার্টিলিটির সমস্যায় ভোগা ১০০ শতাংশ দম্পতির স্বপ্নপূরণের গ্যারান্টি চিকিৎসাশাস্ত্র না-দিলেও অন্তত ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে দিতে পারছে। সমাধানের জন্য দরকার শুধু একটু ধৈর্য, আস্থা, সঠিক ডাক্তারের পরামর্শ আর বেশ কিছু টাকা।
এক চিকিৎসক বলছিলেন, “আসলে ইনফার্টিলিটি সায়েন্স হল চিকিৎসাশাস্ত্রের সবচেয়ে সৃজনশীল বিষয়গুলোর একটা। এখানে মগজের সঙ্গে মনের যুক্ত হওয়া খুব দরকার। একটা মানুষের অনুভূতি বা আবেগকে বুঝতে না-পারলে এতে সাফল্য পাওয়া যায় না।”
বাচ্চা ব্যাপারটাই এত স্পর্শকাতর যে, তাতে পারিবারিক জীবনে উথালপাথাল শুরু হয়। ফলে একটা পরোক্ষ সামাজিক চাপ বৈজ্ঞানিক গবেষণার উপরেও চলে আসে। একটা দায় তৈরি হয়। তা না-হলে মাত্র গত ১০-১২ বছরে ইনফার্টিলিটি বিজ্ঞানে এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এত অগ্রগতি বোধহয় সম্ভব ছিল না।
অগ্রগতি এতটাই যে, ‘ইন্ট্রা ইউটেরাইন ইনসেমিনেশন’ (আইইউআই) এবং ‘ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন’ (যা টেস্টটিউব পদ্ধতি হিসাবে বেশি প্রচলিত)-এর মতো পদ্ধতিও এখন পুরনোর দলে চলে গিয়েছে। |
|
মডেল: প্রিয়াঙ্কা
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল |
রূপকথার জন্ম
ইনফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ সুদর্শন ঘোষদস্তিদার গল্প করছিলেন, এক ফরাসি মহিলা কয়েক মাস আগে কলকাতার ক্লিনিকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। ভদ্রমহিলার বয়স তেত্রিশ। বিয়ে হয়েছে ছ’ বছর আগে। তাঁর স্বামী আমেরিকান। বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত। গত দু’বছর ধরে তিব্বতে ধ্যান করছেন।
সেখানে যাওয়ার আগে ল্যাবরেটরিতে নিজের শুক্রাণু সংরক্ষণ করে গিয়েছেন। আগামী তিন বছর তিনি ধর্মচর্চায় ব্যস্ত থাকবেন বলে স্বাভাবিক মিলনে সক্ষম হবেন না। তাঁর ইচ্ছা, এই শুক্রাণুর সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর ডিম্বাণু মিশিয়ে ভ্রূণ তৈরি করে যেন ভারতে তাঁর স্ত্রী-র গর্ভে প্রতিস্থাপন করা হয়। কারণ, ভারত তাঁর কাছে ‘পবিত্র ভূমি।’ যেমন ইচ্ছা তেমন উপায়। সংরক্ষিত সেই শুক্রাণু আমেরিকা থেকে এল প্যারিস, প্যারিস থেকে দিল্লি, সেখান থেকে কলকাতা। এখানেই গর্ভবতী হলেন ওই আমেরিকান ভদ্রলোকের স্ত্রী।
সুদর্শনবাবু হেসে বলেন, “বিজ্ঞান নিয়ে তো এখন প্রায় রূপকথা তৈরি করা যাচ্ছে।” রূপকথাই বটে।
মা যখন রূপান্তরকামীরাও
আমেরিকার দুই রূপান্তরকামী হরমোন থেরাপিতে পুরুষ হওয়ার পরেও সন্তানের জন্ম দিলেন।
প্রশ্ন উঠেছে তাঁদের শরীরের মধ্যে জরায়ু-ডিম্বাশয় থাকলেও হরমোন থেরাপি-র কোনও প্রভাব কি সেখানে পড়েনি? চিকিৎসকেরা তার উত্তরে বলেছেন, “হরমোনের প্রভাবে জরায়ু এবং ডিম্বাশয় নিশ্চয়ই নিস্ক্রিয় হয়ে শুকিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে অন্য হরমোন থেরাপিতে আবার তাদের সক্রিয় করা গিয়েছে এবং তাঁদের ডিম্বাণু নিয়ে ল্যাবরেটরিতে দাতার শুক্রাণুর সঙ্গে মিলিয়ে ভ্রূণ তৈরি করে ওই ‘বাবা’দের শরীরের ভিতরে জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।” ব্যাস, তাতেই কেল্লা ফতে!
সারোগেট মাদার, ডিভোর্সিও মা
স্বামী পৃথিবীর এক প্রান্তে কাজে ব্যস্ত রয়েছেন, স্ত্রী আর এক প্রান্তে। তাঁরা নিজের-নিজের সময়মতো ল্যাবরেটরিতে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু সংরক্ষণ করে গিয়েছেন। তা থেকে ভ্রূণ তৈরি করে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে কোনও সারোগেট মায়ের গর্ভে। যথার্থ সময়ে চলে আসবে সন্তান। সামর্থ্য থাকলে এ পথে গিয়ে সন্তান ‘কোলে’ পাওয়া দম্পতির সংখ্যা এখন প্রতিদিন বাড়ছে। বলিউডের আমির-শাহরুখরাও এখন এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি-পথের পথিক। অল্পবয়সে মেনোপজ হয়ে গিয়েছে বা বেশি বয়সে সন্তান হারিয়ে আবার মা হতে চাইছেন, সংখ্যা তারও কম নয়। এমন মহিলাদের ক্ষেত্রেও ওষুধ প্রয়োগ করে ডিম্বাশয়কে নতুন ভাবে সক্রিয় করে ডিম্বাণু উৎপাদন সম্ভব বলে জানিয়েছেন ইনফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়।
এখন তো রীতিমতো নগদ টাকা দিয়ে দাতা-র শুক্রাণু কিনে অবিবাহিতা বা ডিভোর্সি মহিলারা মা হচ্ছেন। উল্টো দিকে ডিম্বাণুদাত্রীর থেকে ডিম্বাণু কিনে বাবা হচ্ছেন অবিবাহিত পুরুষ।
আগে ডিম্বাণু ল্যাবরেটরিতে সংরক্ষণ করা যেত না। যেহেতু এটি মানবদেহের বৃহত্তম কোষ, এর সংরক্ষণের উপায় সহজে বার করা যায়নি। এখন সেটাও অনায়াসে করা যাচ্ছে বলে মা বা বাবা হওয়ার পথ আরও মসৃণ হয়েছে। পত্রিকার এই লেখার জন্য মডেল হয়েছেন টলিউডের নায়িকা প্রিয়ঙ্কা। এই মুহূর্তে মাসের গর্ভবতী তিনি। তাঁকে অবশ্য বাচ্চার জন্য কোনও ইনফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হতে হয়নি। তার জন্য নিজেকে ভাগ্যবতীও মনে করেন, বলেন, “বন্ধুবান্ধবদের অনেককেই তো দেখছি একটা বাচ্চার জন্য ডাক্তারের কাছে হত্যে দিতে হচ্ছে। অনেকের আবার সিস্ট বা নানারকমের সমস্যা হচ্ছে। আমি অবশ্যই সে দিক থেকে লাকি।” |
আজকের দিনে সমস্যা
নিয়েও মা হওয়া সম্ভব |
• মায়ের ডিম্বাণু না থাকলে
• বাবার শুক্রাণু না থাকলে
• শুক্রাণু থাকলেও তা বীর্যের সঙ্গে বার না হলে
• মায়ের মেনোপজ হয়ে গেলে
• বাবা বা মায়ের ক্যানসার থাকলে
• মা ও বাবা থ্যালাসেমিয়া কেরিয়ার হলে
• মা ও বাবা এইচআইভি আক্রান্ত হলে
• মায়ের জরায়ু বাদ গেলে বা জরায়ুতে ভ্রূণ স্বাভাবিক ভাবে প্রতিস্থাপিত না-হলে
• হবু মা ও বাবা পৃথিবীর দু’টি ভিন্ন প্রান্তে রয়েছেন, দেখা হচ্ছে না
• বাবা বা মায়ের মৃত্যু হলে |
তথ্যসূত্র: চিকিৎসক গৌতম খাস্তগীর ও চিকিৎসক সুদর্শন ঘোষদস্তিদার |
|
ইচ্ছেপূরণ
লেখার শুরুটা যে নার্সের কথা দিয়ে করেছি তিনি বলছিলেন, বছর চারেক আগে তাঁর স্বামীর দুরারোগ্য অসুখ হয়েছিল। মৃত্যু অনিবার্য জেনে চিকিৎসককে অনুরোধ করেছিলেন শুক্রাণু সংরক্ষণের। কারণ, তাঁরা দু’জনেই সন্তান চেয়েছিলেন।
ভদ্রমহিলার কথায়, “আমি ওঁর সন্তানের জন্ম দিতে চেয়েছিলাম, যাকে আঁকড়ে বাঁচতে পারি। তা হলে মনে হবে, ও আমার সঙ্গে আছে।”
আরও বলেন, “আমার স্বামী মারা যাওয়ার দেড় বছর পরে ল্যাবরেটরিতে সংরক্ষিত তাঁর শুক্রাণু আমার শরীরে প্রবেশ করানো হয়। তাতে আমি গর্ভবতী হই। যেহেতু বাবা মারা যাওয়ার পর সন্তান গর্ভে এসেছে তাই আমার মেয়ের সম্পত্তির অধিকারের ব্যাপারে আমাকে আইনি পরামর্শ নিতে হয়েছিল। আমার মেয়েকে অন্য কেউ ভুল বোঝানোর আগে আমি পুরো ব্যাপারটা ওকে বলে রাখব ঠিক করেছি।”
অসুস্থ বা মরণাপন্ন মানুষের মধ্যে শুক্রাণু বা ডিম্বাণু সংরক্ষণ করার প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন ইনফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ গৌতম খাস্তগীর-ও। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার কারণ, মৃত্যুর আগে অনাস্বাদিত মাতৃত্ব বা পিতৃত্বের স্বাদ পাওয়া এবং প্রিয়জনের জন্য নিজের একটা অংশ পৃথিবীতে রেখে যাওয়ার ইচ্ছে। গৌতমবাবুর কাছে টাটা ক্যানসার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন একাধিক ক্যানসার রোগী শুক্রাণু বা ডিম্বাণু সংরক্ষণ করিয়েছেন। চিকিৎসকেরা ক্যানসারে রেডিয়েশন শুরুর আগেই শুক্রাণু বা ডিম্বাণু সংগ্রহ করে রাখতে বলেন। কারণ রেডিয়েশনে সেগুলি মারা যায়।
দিল্লির এক পঞ্জাবি মহিলার কথা বলি। বিয়ে হয়েছিল কলকাতায়। বিয়ের পরে পেটে ক্যানসার ধরা পড়ে। রেডিয়েশনে তাঁর ডিম্বাশয়ের ডিম্বাণু উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেত। তাই চিকিৎসকেরা রেডিয়েশন চালুর আগে তাঁর ডিম্বাশয় দু’টি একটু উপরের দিকে তুলে মুড়ে সেলাই করে দেন। তার পর রেডিয়েশন দেওয়া হয়। এতে মহিলার ডিম্বাশয় বেঁচে যায় কিন্তু ফ্যালোপাইন টিউব দু’টি বন্ধ হয়ে যায়। রেডিয়েশনের পর ডিম্বাশয়ের সেলাই খুলে দেওয়া হয়। এবং ল্যাপরোস্কোপিক অস্ত্রোপচারে ফ্যালোপাইন টিউব দু’টি খোলা যায়। এতেই ভদ্রমহিলা স্বাভাবিক উপায়ে মা হতে পারেন। এখন আবার অনেক চিকিৎসক রেডিয়েশন চালুর আগে মহিলা রোগীর ডিম্বাশয় বা পুরুষ রোগীর টেস্টিস-এর একটা অংশ কেটে ল্যাবরেটরিতে সংরক্ষণ করে রাখছেন। রেডিয়েশনের পরে সেটা দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়। তার থেকে ফের স্বাভাবিক উপায়ে ডিম্বাণু এবং শুক্রাণু তৈরি হয়। তাঁরা সন্তান পেতে পারেন।
বেহালার বাসিন্দা ক্যানসার-আক্রান্ত এক তরুণ আর তাঁর বাগ্দত্তার গল্প শোনাচ্ছিলেন গৌতম খাস্তগীর। তাঁদের বিয়ে হওয়ার কথা আগামী বছর। মাস কয়েক আগে ক্যানসার ধরা পড়েছে তরুণের। চিকিৎসায় কী হবে এখনও বলা যাচ্ছে না। ওই তরুণ-তরুণীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁদের শুক্রাণু ও ডিম্বাণু মিলিয়ে ভ্রূণ তৈরি করে ল্যাবরেটরিতে সংরক্ষিত করা হয়েছে। যদি চিকিৎসার পর ওই তরুণ সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা হারান বা দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁর মৃত্যু হয় তা হলেও সংরক্ষিত ভ্রূণের মাধ্যমে তরুণীর গর্ভসঞ্চারিত হবে।
বেশ কিছু দিন আগে পর্যন্ত ডিম্বাশয়, জরায়ু বা জরায়ুমুখ ক্যানসারে আক্রান্ত মহিলা কোনও দিন মা হতে পারবেন এটা অকল্পনীয় ছিল। এখন হরবখত তা হচ্ছে। কথা হচ্ছিল বেহালা ম্যান্টনের বাসিন্দা বছর তিরিশের এক মহিলার সঙ্গে। জরায়ুতে ক্যানসার হয়েছে তাঁর। চিকিৎসা পরিভাষায় ‘এন্ডোমেট্রিয়াল কারসিনোমা।’ কিন্তু মা হওয়ার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে চাননি এই অবস্থাতেও। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন চিকিৎসকেরাও। প্রথমে তিনটে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। তাতে ক্যানসার নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল। কেমো-র প্রভাব কমার জন্য এক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল তাঁকে। তার পর তিনি গর্ভবতী হন। সন্তানের জন্মের পর তাঁর জরায়ু অস্ত্রোপচারে বাদ দেওয়া হয়। ক্যানসার বিশেষজ্ঞ আশিস মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “কেমোর পরে একবছর-দেড়বছরের গ্যাপটা খুব দরকারি। এটা না দিয়ে গর্ভসঞ্চার হলে কিন্তু সন্তান বিকলাঙ্গ হতে পারে।”
ম্যাজিকের মতো
আমাদের পুরুষ-শাসিত সমাজে একটা সময় পর্যন্ত সন্তানহীনতার জন্য মহিলাটিকেই কাঠগড়ায় তোলা হত। এখন সেই ধারণা প্রায় নির্মূল। পুরুষের ইনফার্টিলিটি চিকিৎসাতেও ব্যাপক পটপরিবর্তন হয়েছে। অদ্ভুত সমস্যার ম্যাজিকের মতো সমাধান হচ্ছে।
বাগবাজারের বাসিন্দা এক ব্যাঙ্ক অফিসারের কথাই ধরা যাক। ছোটবেলায় অন্ত্রের এক অস্ত্রোপচারের ত্রুটিতে তাঁর তলপেটের অনেক স্নায়ু নষ্ট হয়ে যায়। ফলে পরবর্তী কালে সহবাসের সময় তাঁর শুক্রাণুগুলি বীর্য দিয়ে বার হত না। সেগুলি মূত্রথলিতে চলে যেত। আর যেহেতু মূত্রে ক্ষার থাকে, তাতে শুক্রাণুগুলি মারা যেত। চিকিৎসকেরা ল্যাবরেটারিতে সেই মূত্র থেকে শুক্রাণুগুলিকে সংগ্রহ করে বাঁচিয়ে সংরক্ষণ করেছিলেন। বাবা হতে পেরেছিলেন ভদ্রলোক।
কলকাতারই বাগুইআটির এক বাড়িতে যমজ ছেলে-মেয়ে নিয়ে জমিয়ে সংসার করছেন এক বাঙালি দম্পতি। তাঁদের যমজ ছেলেমেয়ের জন্মের সময়ের ব্যবধান পাঁচ বছরের! ঠিকই পড়ছেন। পাঁ-আ-আ-চ বছর! টেস্টটিউব পদ্ধতিতে সন্তান হয়েছিল ওই দম্পতির। প্রথমে বাইরে থেকে ওষুধ প্রয়োগ করে মহিলার ডিম্বাশয়ে একই সঙ্গে একাধিক ডিম্বাণু তৈরি করা হয়।
তার পর সেগুলি বার করে ল্যাবরেটরিতে শুক্রাণুর সঙ্গে মিলন ঘটিয়ে ছ’টি ভ্রূণ তৈরি হল। এর মধ্যে গর্ভে প্রতিস্থাপিত হল তিনটি ভ্রূণ। তার মধ্যে একটি থেকে সন্তান হল। বাকি তিনটি ভ্রূণ সংরক্ষিত ছিল। পাঁচ বছর পর তার মধ্যে থেকে আবার একটি প্রতিস্থাপিত হয় মহিলার গর্ভে। তার থেকে দ্বিতীয় সন্তান হয়। পাঁচ বছর পরে হলেও আগের ভ্রূণ আর এই ভ্রূণের উৎপত্তি তো একই সময়। তাই জিনগত ভাবে তারা যমজ।
অতএব, আধুনিক বিজ্ঞানটাই যেন এখন পাগলা জগাই। হঠাৎ করে ফেলতে পারে যা খুশি তাই। ইচ্ছে হাওয়ায় ইনফার্টিলিটি দুনিয়ার অনেক কিছুই তাই এখন সম্ভব, ভীষণ ভাবে সম্ভব। |
|
|
|
|
|