মনোরঞ্জন...
এক যে ছিলেন কিশোর

• এক প্রযোজক একবার আদালত থেকে একটি ডিক্রি পাশ করিয়ে আনলেন। তাতে লেখা, কিশোরকুমারকে তার পরিচালকের কথা শুনতেই হবে। ঘটনাটি শুনে কিশোরকুমার ঠিক করেন, তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবেই পরিচালকের কথা মেনে চলবেন। এর পর একটি দৃশ্যে তিনি গাড়ি চালিয়ে মুম্বই ছাড়িয়ে খান্ডালা পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন। কারণ? পরিচালক ‘কাট’ বলতে ভুলে গিয়েছিলেন, তাই।

• ওয়ার্ডেন রোডের ফ্ল্যাটের দরজায় একটি ফলকে লিখে রাখা ছিল, ‘বিওয়্যার অব কিশোরকুমার’। পরিচালক এইচএস রাওয়াল সেই বাড়িতে এলেন একদিন। কিশোরকুমারকে কিছু টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ছিল তাঁর। টাকা ফেরত দেওয়া হল। এবার কাজের শেষে রাওয়াল হ্যান্ডশেক করতে হাত বাড়ালেন। তাঁর হাতটা নিয়ে সোজা মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে কামড়ে দিয়ে কিশোরকুমার বললেন, ‘দরজার বাইরে লেখাটা দেখেননি?’

• হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় তখন ‘আনন্দ’ করবেন ঠিক করেছেন। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, অভিনয় করার জন্য তিনি কিশোরকুমারকে নেবেন। প্রস্তাব নিয়ে কিশোরকুমারের বাড়ি গেলেন তিনি। কিন্তু বাড়ির দরজার কাছে পৌঁছতেই দারোয়ান সটান বিদায় করে দিলেন। কী ব্যাপার? না, তাঁকে বলে রাখা হয়েছিল, এক বাঙালি ভদ্রলোক আসবেন। তাঁকে দেখামাত্র যেন পত্রপাঠ বিদায় করে দেওয়া হয়। এর নেপথ্যের ঘটনাটি হল এইরকম এর ঠিক আগে কিশোরকুমারকে দিয়ে একটি স্টেজ-শো করান এক বাঙালি। কিন্তু পয়সাকড়ি ঝামেলা হয় তাঁর সঙ্গে। তাঁকেই ‘বিদায়’ করার কথা। দারোয়ান হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়কে ভুল করে সেই লোক ভেবে অমন কাণ্ডটি ঘটিয়ে ফেলেন।


এ রকম নানা গল্প শোনা যায় কিশোরকুমারের জীবন নিয়ে। কেউ বলেন, উনি গাছের সঙ্গে গল্প করতেন। কেউ বলেন, এক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে উনি বায়না ধরেছিলেন, গোরুর গাড়ি চেপে আসবেন! একবার নাকি এক প্রযোজক তাঁকে শ্যুটিং না করিয়ে পাঁচ দিন হোটেলবন্দি রেখেছিলেন, তাতে অধৈর্য হয়ে কিশোরকুমার এলোপাথাড়ি করে নিজেই নিজের চুল কেটে ফেলেন। শেষমেশ যখন সেটে পৌঁছন, তখন মাথায় চুল ছিল না বললেই চলে।
এমনই রঙিন এক মানুষ ছিলেন এই কিশোরকুমার। এক দিকে অসম্ভব বৈচিত্রময়, অন্য দিকে প্রচণ্ড একাকী। আর এরকম এক জীবন নিয়ে একটিও ‘বায়োপিক’ বানিয়ে উঠতে পারল না বলিউড! যেখানে ভগৎ সিংহ থেকে সুভাষচন্দ্র বোস, মিলখা সিংহ থেকে মেরি কম সবার জীবন যখন বড় পরদাতেও বেশ জনপ্রিয়, তখনও।
অন্তত চার জন নামী বলিউড পরিচালক গত চার-পাঁচ বছর ধরে কিশোরকুমারকে নিয়ে ছবি বানাবেন বলে খবরে এসেছিলেন। তবু আজ পর্যন্ত কাজ তেমন কিছুই এগোয়নি। কেন থমকে আছে কিশোরকুমারকে নিয়ে ‘বায়োপিক’?
অনুরাগ বসু বেশ কয়েক বছর আগে ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর ‘কিশোর’ ছবিটি তৈরির কথা। কিশোরকুমারের ভূমিকায় রণবীর কপূর। চিত্রনাট্য সৌমিক সেনের। এই সৌমিক এর মধ্যে আবার মাধুরী দীক্ষিতকে নিয়ে ‘গুলাব গ্যাং’ নামে একটি ছবি পরিচালনাও করে ফেলেছেন। অনুরাগ বলেছিলেন, ‘কিশোর’ তৈরির জন্য কম করে সাত মাস সময় প্রয়োজন। “আমার ছবিটা থেমে যায়নি। আমাকে রণবীর সাত মাস ডেট দিলে আমি ফিল্মটা নিয়ে কাজ শুরু করতে পারব। এখন রণবীরের হাতে বেশ কয়েকটি প্রজেক্ট রয়েছে। অনুরাগ কাশ্যপের ‘বম্বে ভেলভেট’। ইমতিয়াজ আলির একটা ফিল্ম আছে। আমার নিজের দুটো কাজে রণবীরকে চাই। একটা ‘জাগা জাসুস’। সেটা অবশ্য বেশি সময় নেবে না। বড়জোর তিন মাস। কিন্তু কিশোরের জন্য সাত মাস লাগবেই। রণবীর যেটার জন্য আগে ‘ডেট’ দেবে আমি সেটাই আগে শুরু করব,” বললেন অনুরাগ।
এ দিকে মধুবালার বোন মধুর ভূষণ একবার বলেছিলেন যে, কিশোরকুমার-মধুবালার বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ে কোনও অসম্মানজনক কিছু ছবিতে থাকলে তিনি আপত্তি জানাবেন। “আমি এটা বলার পরে ফিল্মের দলটি থেকে কেউই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। আমি নিজে থেকে তো কারও সঙ্গে যোগাযোগ করব না। তবে ওরা যখনই কাজটা শুরু করবে, ওদের আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতেই হবে,” বললেন মধুর।
এক সময় সুজিত সরকারও ঠিক করেছিলেন কিশোরকুমারকে নিয়ে ফিল্ম তৈরির। ২০০৮-য়ে স্ক্রিপ্ট লিখতে শুরু করেছিলেন জুহি চতুর্বেদী। যিনি ‘ভিকি ডোনার’ও লিখেছিলেন। “কোনও টাইটেল রেজিস্ট্রেশন করিনি। তবে কাজ এগিয়েছিল। কিন্তু তার পর যখন শুনলাম, অনুরাগ আর ইউটিভি মিলে একটা বায়োপিক করছেন, আমি প্ল্যানটা বাতিল করে দিই,” বলছিলেন সুজিত।
কিন্তু কিশোরকুমারের জীবনে তো অনেক রং রয়েছে। যেখানে ভগৎ সিংকে নিয়ে তিনটি ‘বায়োপিক’ হয়েছে আর সূর্য সেনের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন নিয়ে দুটো, সেখানে পিছিয়ে যাওয়ার কারণ কি শুধুমাত্র অন্য একটা ফিল্ম হতে পারে? “এটা ঠিক যে কিশোরকুমার এমন এক ব্যক্তিত্ব যে তাঁকে নিয়ে নানা ভাবে সিনেমা বানানো সম্ভব। আমাদের স্ক্রিপ্টে কিশোরকুমারের ব্যক্তিগত জীবনটা ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলাম। যেখানে উঠে আসত রুমা গুহ ঠাকুরতার কথা। মধুবালা, যোগিতাবালি, এমনকী লীনা চন্দ্রভারকারের কথা। আমি নিজে লীনা চন্দ্রভারকারের কাছে গিয়ে অনেক কথা বলেছিলাম। টেপে রেকর্ড করে রেখেছিলাম ওঁর সাক্ষাৎকারগুলো। আমি ভেবেছিলাম কিশোরকুমারের পরিবার তো অনুরাগকে এক্সক্লুসিভ বাইটস দিয়েছে। তাই ২০১০ নাগাদ প্ল্যানটা বাতিল করে দিই,” বলছিলেন সুজিত। তার সঙ্গে এও বলছেন, হয়তো ‘ম্যাড্রাস ক্যাফে’ মুক্তি পেলে আবার ভেবে দেখবেন যদি কিশোরকুমারকে নিয়ে কাজ করা যায়।
বেশ কয়েক বছর আগে শোনা গিয়েছিল যে নাগেশ কুকুনুর কিশোরকুমারের উপর ছবি করবেন। শোনা গিয়েছিল কলকাতার সঞ্জীব দত্ত ফিল্মটি এডিট করবেন। সঞ্জীব বললেন, “নাগেশ কিশোর বলতে পাগল। ওর সিনেমাতে প্রায়ই কিশোরের গান ব্যবহার করা হত। ‘মোড়’ ছবিতে তো রঘুবীর যাদবের চরিত্রটি কিশোরভক্ত ছিল। রীতিমতো কিশোরকুমারকে পুজো করত সে। নাসিরুদ্দিন শাহ ‘তিন দিওয়ারেঁ’-তে কিশোরকুমারের ‘আ চলকে তুঝে’ গানটি গেয়েছিলেন ব্যাঙ্ক লুঠ করার দৃশ্যে। নাগেশ ঠিক করেছিল শ্রেয়াস তালপাডে-কে নিয়ে কিশোরকুমারের ওপর বায়োপিক বানাবেন।”
কিন্তু কী হল সে ছবির?
নাগেশ এখন আমেরিকাতে। তাঁর ফিল্মের প্রযোজক এলাহে হেপতুল্লা বললেন, “আমরা ফিল্মের জন্য রিসার্চ শুরু করেছিলাম। কিন্তু তারপর হঠাৎ শুনলাম অনেকেই কিশোরদাকে নিয়ে ফিল্ম বানাচ্ছেন। কিশোরদার পরিবারের তরফ থেকে বোধহয় ছবিটির রাইটস দিয়ে দেওয়া হয়েছিল ইউটিভি-কে। এর জন্যই আমরা কাজটা বন্ধ করে দিই। নাগেশ চেয়েছিল একটা পিরিয়ড ফিল্ম বানাতে। আর তার স্টার হবেন কিশোরকুমার নিজে। এটা নয় যে ফিল্মের স্টার হলেন কোনও এক একশো কোটি ক্লাবের তারকা। আমাদের দেশে স্টারদের না দিয়ে ফিল্ম বানালে পিরিয়ড বানানোর বাজেট কোথায়?”
তবে এলাহে আশাবাদী। “হয়তো আমরা কখনও প্রজেক্টটা বিদেশি কোনও প্রযোজনায় করব। আমেরিকার রাস্তা দিয়ে ড্রাইভ করতে করতে আমি নাগেশকে দেখেছি ফুল ভলিউমে কিশোরদার গান শুনতে। ওর জীবনের সব থেকে বড় আফশোস হল, কিশোরদার সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। ওর প্ল্যান ছিল বায়োপিকটা এমন ভাবে বানাবে যাতে কিশোরদার জীবনের প্রত্যেকটা মোড়ে এসে ওর একটা গান ব্যবহার করা যায়। সেটা করতে গেলে ওরিজিনাল গানের স্বত্ব কিনতে হবে,” বলছেন এলাহে।
একটা সময় শোনা গিয়েছিল, যে সুধীর মিশ্রও ছবি করবেন কিশোরকুমারকে নিয়ে। গুজব রটেছিল যে কিশোর-পুত্র সুমিতকুমার অভিনয় করবেন কিশোরের চরিত্রে। “ওটা একেবারেই গুজব ছিল। আমার মামাবাড়ি খান্ডওয়াতে। সেখানেই কিশোরকুমারের জন্ম। ওঁর জীবনে এত কিছু ঘটেছে যে সেটা বেশ সিনেম্যাটিক। কেউ বলে উনি ছিলেন এক পাগল জিনিয়াস। ওঁর সম্পর্কগুলো, সরকারের সঙ্গে ওঁর বিরোধ, এ সব নিয়েই প্লট লেখা যায়। বাইশ বছর বয়সে যখন বলিউডে আমি আসি, তখন ইচ্ছে ছিল কিশোর কুমারকে দিয়ে আমার একটা ছবিতে অভিনয় করানোর। সে আর হয়নি। এখন শুনছি অনুরাগ ‘বায়োপিক’ করছে। আমি ছবিটা দেখার জন্য আগ্রহী।”
অনুরাগ এ দিকে দাবি করেছেন যে তাঁর বায়োপিকে ‘দ্য রিয়েল কিশোর কুমার’কে দেখতে পাবেন দর্শক। কিন্তু কে সেই রিয়েল কিশোরকুমার? অনুরাগ বলছেন ওটাই তাঁর ফিল্মের ট্রাম্প কার্ড। তাই এর থেকে বেশি কিছুই এখন বলবেন না। এটা তো ঠিক যে যাঁর চরিত্রে এত রকমের বৈপরীত্য ছিল, তাঁকে ধরতে পারাটা যথেষ্ট কঠিন কাজ। কেউ বলতেন টাকাপয়সা নিয়ে তিনি এতই খুঁতখুঁতে ছিলেন যে প্রযোজক পুরো টাকা না দিলে হাফ মেক আপ করে সেটে চলে যেতেন। আবার সেই একই মানুষ ‘পথের পাঁচালি’ বানানোর সময় সত্যজিৎ রায়কে পাঁচ হাজার টাকা ধার দিয়েছিলেন।
প্রীতীশ নন্দী একবার কিশোর কুমারের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারে কিশোরকুমার বলেছিলেন যে ‘পরশ পাথর’ বানানোর আগে সত্যজিৎ রায় তাঁকেই ছবিতে অভিনয় করতে বলেছিলেন, কিন্তু কিশোর কুমার নাকি এত ভয় পেয়েছিলেন যে রাজি হননি। তার পর সেই রোলটা করেন তুলসী চক্রবর্তী। প্রীতীশ বললেন, “কিশোর কুমারকে নিয়ে একটা বায়োপিক বানানো আমাদের দেশে অনেক আগেই উচিত ছিল। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে অনেকগুলো সত্তা ছিল কিশোরকুমারের মধ্যে। দক্ষতা দরকার এটা বোঝার জন্য যে, কোন কিশোরকুমারকে নিয়ে বায়োপিক বানানো উচিত। ওঁর সত্যিকারের সত্তাটা ধরা খুবই জরুরি।”
প্রীতীশ-এর বন্ধুত্ব ছিল কিশোরের সঙ্গে। তাঁর চোখে মানুষ কিশোর কুমার কেমন ছিলেন? নিজেই তো এই প্রশ্ন এক সময় ছুড়ে দিয়েছিলেন কিশোরকুমারকে। জিজ্ঞাসা করেছিলেন তিনি কি এক জন ক্লাউন যিনি সারা ক্ষণ অভিনয় করে চলেন কিন্তু আসলে একেবার তালে ঠিক? নাকি আসলে এক জন ধূর্ত মানুষ যিনি টাকা মাত্রই পাগল? উত্তরে প্রীতীশ বললেন, “আমাকে সেদিন বলেছিলেন আমি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রোলে অভিনয় করে যাই। ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয় প্রথম বর্ণনাটাই ঠিক। দ্য লোনার, দ্য লাভার অ্যান্ড দ্য ডিলাইটফুল ক্র্যাকপট আর ওয়ান অ্যান্ড দ্য সেম। অসম্ভব একাকী, প্রেমিক মানুষ। তার সঙ্গে প্রাণবন্ত, উচ্ছল খ্যাপাটেও।”
এক দিন চাইব এই আসল কিশোরকে নিয়ে ছবি বানাতে। তবে কী জানেন? বন্ধুদের নিয়ে ছবি বানানো বেশ কঠিন। অমায়িক ছিলেন কিশোর। তার সঙ্গে ছিল একটা দুষ্টু রসবোধ। ভীষণ সূক্ষ্ম। ফিল্মি দুনিয়ার লোক একদম পছন্দ করতেন না। ওঁর চরিত্রের মধ্যে ছিল একটা অদ্ভুত বৈপরীত্য। আর সেটাই ছিল ওঁর ম্যাজিক।”
বায়োপিকেরই ধুম জ্বরে সেটাও হয়তো এক দিন ফুটে উঠবে বলিউডের বড় পর্দায়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.