মিশরের পরিস্থিতি উত্তাল, হিংসাকীর্ণ। প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুর্সিকে সরাইয়া সেনাবাহিনী ক্ষমতার দখল লইবার পর একটি গোটা মাস অতিক্রান্ত, হিংসার অবিশ্রান্ত স্ফুরণে এতটুকুও ভাটা পড়ে নাই। বরং ক্ষমতার শীর্ষস্থল হইতে সেনা-নেতৃত্বের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অনুমোদন আসিতেছে, মুর্সি-বিরোধী ও মুর্সি-সমর্থক, দুই পক্ষের সরাসরি সংঘর্ষের প্রতি। যত দিন প্রেসিডেন্ট মুর্সিকে সরানো হয় নাই, তত দিন সেনার ভূমিকা ছিল দুই বিবদমান পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতার, কিন্তু যে মুহূর্তে সেনাবাহিনী মুর্সিকে সরাইয়া দেশের সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করিয়াছে, সেই মুহূর্তে তাহার মধ্যস্থতার ভূমিকা গিয়াছে। সমগ্র দেশ আড়াআড়ি দ্বিধাবিভক্ত হইয়া পড়িয়াছে। এই পরিস্থিতিতে সেনার হিসাব পরিষ্কার। প্রেসিডেন্ট মুর্সিকে তালাচাবিতে আটক রাখিয়া তাঁহারা এখন মুসলিম ব্রাদারহুডের অন্যান্য নেতাদের যত দ্রুত সম্ভব আটক করিতে চাহেন। সেই কারণেই জনগণ-হিংসার এমন ঢালাও অনুমোদন। এই সর্বব্যাপ্ত রক্তাক্ত অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে যাহার আশা দূর হইতে দূরান্তরে মিলাইতেছে, তাহার নাম গণতন্ত্র।
অবশ্য আরব বসন্তের পর মিশর গণতন্ত্রে অধ্যুষিত হইবে, এমন ভাবনায় মানসিক পরিণতির লক্ষণ ছিল না। স্বৈরতান্ত্রিক হোসনি মোবারককে গদিচ্যুত করিয়া স্বৈরতন্ত্রের প্রতি বিদ্বেষ জানানো হইয়াছিল, কিন্তু সেই বিদ্বেষের মধ্যে যাঁহারা গণতন্ত্র-প্রেমের অঙ্কুর দেখিতে পান নাই, তাঁহারাই নির্ভুল প্রমাণিত হইলেন। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও স্বার্থদ্বন্দ্বের পরিবেশে ইসলামি দলগুলি ডানা মেলিল। প্রথম ‘গণতান্ত্রিক’ নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুড জয়ী হইল, প্রবল আত্মাভিমানে ইসলামি কর্তৃত্বস্থাপনে উদ্যোগী হইল প্রেসিডেন্ট মুর্সির মাধ্যমে। অতঃপর মুর্সির ক্ষমতাচ্যুতি। মুর্সি-পরবর্তী মিশরও গণতন্ত্রের পাদদেশে পৌঁছাইতে পারিল না। সেনা-‘অভ্যুত্থান’ কিংবা নামান্তরে সেনা-‘বিপ্লব’ তাহাকে আবারও ছিনাইয়া লইয়া গেল কর্তৃত্ববাদী শাসনের আশ্রয়ে। বর্তমান অশান্তি কবে শেষ হইবে, এখন তাহার কোনও দিশা নাই। এবং অশান্তি শেষ হইলেও যে গণতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হওয়া যাইবে, এমন আশাও দুরাশা। হয় মুর্সি-বিরোধীদের জয় সামরিক শক্তির হাত শক্ত করিবে, নয়তো মুর্সি-সমর্থকদের জয় ইসলামি শক্তির সাফল্যের দুন্দুভি বাজাইবে। মাঝখান হইতে অনেকগুলি সম্ভাবনাময় মুহূর্ত হাতছাড়া হইয়া গেল।
কর্তৃত্ববাদের বিরোধিতা ছাড়াও গণতন্ত্রের উন্মেষের একটি পূর্বশর্ত রহিয়াছে। তাহার নাম বাকস্বাধীনতা, এবং মতামত প্রকাশ ও আলোচনার সংস্কৃতি। এই স্বাধীনতা কিংবা সংস্কৃতি আকাশ হইতে পড়ে না। তাহা অর্জন করিতে হয়। কর্তৃত্ববাদের শৃঙ্খলে অভ্যস্ত, কট্টর ইসলামের ছায়ায় লালিত মিশরীয় সমাজ বহু দশকের অব্যবহারে সেই স্বাধীনতা ও সংস্কৃতির স্বাদ সম্পূর্ণ ভুলিয়াছে। কেবল নির্বাচনটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সাধিত হইলেই তো গণতন্ত্র প্রাপ্য হয় না। তাহার জন্য গণতান্ত্রিক বিনিময়ের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হইতে হয়। তহরির স্কোয়ারে একাদিক্রমে যে মুর্সি-বিরোধী ও মুর্সি-সমর্থকদের মিছিল-সমাবেশ দেখা যাইতেছে, তাহাদের মধ্যে সেই গণতান্ত্রিক বিনিময়ের ইচ্ছা বা আস্থা কোথায়! ইসলামপন্থী কিংবা সামরিকপন্থী, কোনও নেতৃত্বের মধ্যেই সেই প্রবণতা সুলভ নহে। সেনা বনাম ব্রাদারহুড সংঘর্ষ মিটুক না মিটুক, মিশরে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা দৃষ্টির অগোচরেই। |