এ দেশে নির্বাচনের উপরই সমস্ত রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ নির্ভর করে। মানবাধিকার রক্ষার লড়াই সেই মূল স্রোতের রাজনীতিতে কোনও বিষয়ই হয়ে ওঠেনি। তাই না?
এ কথা ঠিক যে, মূল ধারার রাজনৈতিক চিন্তায় মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্নটি যতটা আসা উচিত ছিল ততটা আসেনি। কিন্তু আমাদের দেশে মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনের বয়স তো বেশি না। মূল ধারার রাজনীতিতে প্রশ্ন হয়ে ওঠার সময় এখনও যায়নি।
তা হলে কি মূল ধারার রাজনীতিতে বা নির্বাচনে যোগ দিতে হবে না? মেধাজিকেও (মেধা পটকর) এই প্রশ্ন আমি করেছিলাম।
তাই?
মেধাজি বলেছিলেন, সেটা করতে গেলে জোরালো সংগঠন দরকার। কিন্তু গোটা ব্যবস্থাটার বাইরে থেকে লড়াই বেশি দূর চালানো যাবে কি?
জোরদার সংগঠন না হলে এত বড় প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করা অসম্ভব। মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলন এখনও ততটা ক্ষমতা অর্জন করেনি, এটা মানতে হবে। কিন্তু এটা তো নিঃসন্দেহে ঠিক কথা যে, মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্ন মূল ধারার রাজনীতিতে ওঠাতে হবে। এই তো সোনি সোরির ঘটনাটা নিয়ে আমরা সমস্ত রাজনৈতিক দলকে বলেছিলাম যে, সংসদে যেন বিষয়টা তোলা হয়। লালুপ্রসাদ, কংগ্রেস, সি পি আই, সি পি এম সবাইকে বলেছিলাম, কিন্তু সি পি আই আর সি পি এম ছাড়া কেউ তোলেনি।
এই তোলানোটা কী ভাবে হবে?
রাজনৈতিক দলগুলি তখনই কোনও বিষয়কে গুরুত্ব দেয়, যখন তার উপর একটা সামাজিক চাপ থাকে। এই সামাজিক চাপটা তৈরির চেষ্টা করছি।আমাদের দেশ এখন এক অদ্ভুত অবস্থার সামনে দাঁড়িয়ে। এই নতুন অর্থনৈতিক নীতির ফলেদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ আত্মসাৎ করার একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে। সমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ এবং ক্ষমতাশালী অংশ হচ্ছে মধ্যবিত্ত। এখন একটা নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়েছে, যাঁরা জানেন এই ‘সম্পদ আত্মসাৎ’-এর বিষয়টি। কিন্তু তাঁরা নিজেরা অনেকটাই প্রিভিলেজড বলে এই বিষয়ে তাঁরা নীরব। এঁদের জাগাতে হবে। এখন সমাজের এমন একটা অবস্থা যে ‘সিভিল ওয়ার’ হওয়ার মতো। এক দিকে তাঁরাই ক্ষমতাশালী, যাঁরা উচ্চবর্ণ, উচ্চশ্রেণি, শহুরে, শিক্ষিত। অন্য দিকে, গ্রামীণ, লেবার, আর্টিজান। ‘কাম ধান্দা করনেওয়ালে’। এঁরা এখনও তাঁদের অধিকার সম্বন্ধেই সচেতন নয়। আমি এঁদেরই মধ্যে কাজ করি। এক ভাবে তাঁদের অধিকার আদায়ের লড়াইকে ইন্ধন জোগাই। বলতে পারেন, সচেতন করতে চাই, আইনি সুরক্ষার বিষয়ে তাঁদের অবহিত করতে চাই। মানবাধিকার যাঁরা ভঙ্গ করেন, তাঁরা এত ক্ষমতাশালী যে, লড়াইটা ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। এই তো সোনির (সোনি সোরি) ঘটনাটাই দেখুন না! সোনির ভাইপোকে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে ইনফরমার করতে চাইল। সে রাজি না হওয়াতে তাকে চার দিন পায়খানায় বন্ধ করে রাখল। খাবার, জল কিছু দিল না। তার পর অনেক কাণ্ড করে কোর্ট থেকে সোনি তাকে যখন ছাড়িয়ে আনল, শুধুমাত্র এই কারণে তাকে ধরা হল। তার উপর ওই রকম অকথ্য অত্যাচার চলল। তার গোপনাঙ্গ থেকে পাথর বের হল। কী অসম একটা লড়াই লড়তে হচ্ছে!
এই অসম লড়াইতে কি জেতা যাবে?
চেষ্টা তো ছেড়ে দিতে পারি না। আর আমরা যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তাদের কাছে এই ভাবে লড়াই করা ছাড়া তো পথও নেই।
কোথাও কি কিছু আশা দেখা যাচ্ছে? আপনার কী মনে হয়?
কিছু কিছু সুফল নিশ্চয়ই পাওয়া যাচ্ছে। যেমন ধরুন এ বারে ভার্মা কমিশনে ধর্ষণ বিষয়ে সরকার যে সুপারিশ পাঠিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে যে, যদি গোপনাঙ্গ থেকে পাথর বা অন্য কিছু পাওয়া যায়, তা হলে সেটাকেও ‘ধর্ষণ’ হিসেবে গণ্য করতে হবে। সোনির নাম কোথাও নেয়নি। কিন্তু সোনির ঘটনাটার পরই তো এই পদক্ষেপ। এই রকম কিছু কিছু জায়গায় নিশ্চয়ই কাজ হচ্ছে।
গুজরাতে ২০০২-এ আমরা একটি ক্যাম্পে এক জন বয়স্ক মহিলার দেখা পেয়েছিলাম। তিনি বিয়াল্লিশের আন্দোলনে গাঁধীজির সঙ্গে ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ওই ক্যাম্পে এমন অনেক মুসলিম মেয়েকে আনা হয়েছিল, যাঁদের গোপনাঙ্গে কাঠের টুকরো গোঁজা ছিল, আর তারা যন্ত্রণায় চিৎকার করছিল। তিনি নিজের হাতে সেই সব কাঠের টুকরো বের করেছেন।
এ ভাবে বহু অত্যাচার হয়। পুরনো পদ্ধতি। এটা তো একটা দিক। আর প্রতি দিন যে ভাবে এই সব আদিবাসী মানুষ জীবনযাপন করেন, সেটাও তো ভয়ংকর। এক একটা অঞ্চলে সব রকম সরকারি ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। স্কুল বন্ধ। স্বাস্থ্যকেন্দ্র তুলে দিচ্ছে। ওষুধ পর্যন্ত পাওয়া যাবে না।
ঠিক এই ভাবে ওড়িশার কলিঙ্গনগরে দেখেছি সরকারি পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এই রকম পরিষেবা বন্ধ হয়ে যাওয়া কয়েকটি গ্রামে আমি আর আমার স্ত্রী কিছু ওষুধপত্র নিয়ে গেছি। সেখানে গিয়ে দেখি, ছোট ছোট দশ-এগারো বছরের বাচ্চারা পাহারার কাজ করছে। তারা যদি দেখে, পুলিশ আসছে, তা হলে বাঁশি বাজিয়ে বা মুখে শব্দ করে জানান দেয়। আর তখন বাড়ির অন্যরা বাড়ি ছেড়ে আরও গভীর জঙ্গলে চলে যায়। এদের বলা হচ্ছে মাওবাদী।
উত্তর-পূর্ব ভারতেও তো এই রকম। কাশ্মীরেও।
গোটা ভারত জুড়ে অত্যাচারিত মানুষ যে যার নিজের মতো করে লড়ছে। দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘুরা সবাই নিজের নিজের জায়গায় লড়ছে। এই সমস্ত টুকরো টুকরো লড়াইকে একসঙ্গে সংগঠিত করা খুব দরকার। সেই চেষ্টাই করছি। আর চেষ্টা করছি মধ্যবিত্ত সমাজটাকে সরব করতে। এই দুটো কাজ যদি ঠিকঠাক করা যায়, রাজনৈতিক ভাবেও মানবাধিকার রক্ষার লড়াই গৃহীত হবে। আপনি যেটা বলছেন, নির্বাচনের বিষয় হবে। সমাজের চাপটা এই কারণেই খুব জরুরি। মানবাধিকার যারা লঙ্ঘন করছে, তারা এতটাই শক্তিশালী যে, মানবাধিকার রক্ষার লড়াইয়ের বিশ্বাসযোগ্যতাকেই তারা আক্রমণ করতে চায়। এই তো, আমার দান্তেওয়াড়া আশ্রম ওরা ভেঙে দিয়েছে। আমি অপেক্ষা করে আছি যে আবার আশ্রম গড়ব। ফিরে যাব নিজের জায়গায়। এ সবই তো লড়াইয়ের অঙ্গ। |