বর্ধমানে প্রদীপ তা খুন, ধনেখালি-কাণ্ড বা গুড়াপের হোম-হত্যা পুলিশি তদন্তে গাফিলতি নিয়ে আদালতের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ সাম্প্রতিক কালে একাধিক বার দেখেছে এ রাজ্য। সেই তালিকায় নবতম সংযোজন আমিনুল-কাণ্ড। কড়েয়ার যুবক আমিনুল ইসলামের অপমৃত্যুর তদন্ত পুলিশ ঠিক ভাবে করেনি, আপাতত এমনই মনে করছে কলকাতা হাইকোর্ট।
আদালতের এ হেন মনোভাবের কারণ, স্থানীয় এক দুষ্কৃতী যে দুই নাবালিকাকে ধর্ষণ করেছিল বলে আমিনুল পুলিশে অভিযোগ করেছিলেন, তাদের কারও ডাক্তারি পরীক্ষা পুলিশ করায়নি। বৃহস্পতিবার শুনানির সময়ে বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ায় হাইকোর্ট ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। শুধু তা-ই নয়, এ ব্যাপারে খোদ কলকাতার পুলিশ
|
আমিনুল ইসলাম |
কমিশনারের কৈফিয়ৎ তলব করেছেন বিচারপতি। তাঁর নির্দেশ: গুরুত্বপূর্ণ এমন একটি মামলার তদন্ত পুলিশ কেন ঠিক ভাবে করল না, পুলিশ কমিশনারকে আদালতের কাছে তার কারণ দর্শাতে হবে।
পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে গত বছরের ৩ ডিসেম্বর কড়েয়া থানার সামনে গায়ে আগুন দিয়েছিলেন পাম অ্যাভিনিউয়ের বাসিন্দা মির আমিনুল ইসলাম। এক মাস চিকিৎসাধীন থাকার পরে সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতালে তিনি মারা যান। আত্মাহুতির আগে ‘সুইসাইড নোটে’ আমিনুল জানিয়েছিলেন, শাহজাদা বক্স নামে স্থানীয় এক ‘প্রভাবশালী’ ব্যক্তি দুই নাবালিকার উপরে যৌন নির্যাতন চালাচ্ছে এই মর্মে তিনি থানায় নালিশ দায়ের করা ইস্তক শাহজাদার সঙ্গে হাত মিলিয়ে পুলিশ তাঁকে নানা ভাবে হেনস্থা করছে। সুইসাইড নোটে আমিনুল এ-ও অভিযোগ করেন, ডাকাতির মিথ্যে মামলায় পুলিশ তাঁকে গ্রেফতারের হুমকি দিচ্ছে! এবং এ সবের প্রতিবাদেই তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন বলে সুইসাইড নোটে জানিয়েছিলেন আমিনুল। আত্মহত্যায় ‘পুলিশি-প্ররোচনা’র অভিযোগ এনে পুরো ঘটনার সিবিআই-তদন্ত চেয়ে পরবর্তীকালে কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলা রুজু হয়। এ দিন বিচারপতি সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদালতে যার শুনানি চলাকালীন দেখা যায়, ‘নির্যাতিতা’ দুই নাবালিকার ডাক্তারি পরীক্ষাই করায়নি কড়েয়া থানায় পুলিশ! ক্ষুব্ধ বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারি কৌঁসুলির কাছে জানতে চান, “এটা কী হল! অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে কাজটা করার কথা, সেটাই করা হয়নি!”
সরকারি কৌঁসুলি জবাব দেন, “দু’জনের মধ্যে এক জনের মা মেয়ের ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে চাননি।” এই ব্যাখ্যা শুনে বিচারপতি বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারি কৌঁসুলিকে ভর্ৎসনা করে বলেন, “একেই ডাক্তারি পরীক্ষা করাননি। সেটা আবার আদালতে জোর গলায় বলছেন?”
এর পরেই বিচারপতি এ ব্যাপারে পুলিশ কমিশনারের ব্যাখ্যা তলব করেন। এ দিন শুনানিতে আবেদনকারীর তরফে পুলিশি তদন্ত নিয়ে একাধিক প্রশ্ন তোলা হয়। বাদীপক্ষের কৌঁসুলি প্রদীপ তরফদার সওয়ালে অভিযোগ করেন, “আমিনুল কেন আত্মহত্যা করলেন, তা নিয়ে কোনও তদন্ত হচ্ছে না। যা কিছু তদন্ত হচ্ছে, সব ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে।” কেন তাঁরা সিবিআই-তদন্ত চাইছেন, সে প্রসঙ্গে আদালতের সামনে প্রদীপবাবুর যুক্তি, “আমিনুল সুইসাইড নোটে স্পষ্ট লিখেছেন যে, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই তিনি নিজেকে শেষ করে দিচ্ছেন। সেই পুলিশই কী ভাবে তদন্ত করবে?” প্রদীপবাবুর দাবি, রাজ্যের সংখ্যালঘু কমিশন আমিনুলের আত্মহত্যা সম্পর্কে পুলিশের রিপোর্ট চাইলেও পুলিশ রিপোর্ট পাঠায়নি। উপরন্তু কলকাতা পুলিশের এক ডেপুটি কমিশনার আমিনুলকে থানায় এফআইআর দাখিল করতে বলার পরেই কড়েয়া থানা আমিনুলের উপরে নানা ভাবে চাপ তৈরি করেছিল বলে অভিযোগ তুলেছেন আবেদনকারীর কৌঁসুলি।
অন্য দিকে প্রশাসন কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা জানাতে গিয়ে সরকারি কৌঁসুলি আদালতকে বলেন, “ওই ঘটনায় তিন পুলিশ অফিসারকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও চলছে।” যা শুনে বাদী কৌঁসুলির দাবি, “এ সবই হয়েছে এক ধর্ষিতার নালিশের ভিত্তিতে। আমিনুলের অভিযোগ নিয়ে কোনও তদন্ত হয়নি। তদন্ত হয়নি তাঁর আত্মহত্যা নিয়েও।” ২০১২-র ৩১ অক্টোবর আমিনুল কড়েয়া থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন বলে জানান প্রদীপবাবু।
থানায় আমিনুল ঠিক কী অভিযোগ করেছিলেন?
ওঁঁর নালিশ ছিল, এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুই নাবালিকাকে এক বছর ধরে ধর্ষণের অভিযোগ থাকলেও কড়েয়া থানার পুলিশ কোনও ব্যবস্থা তো নেয়ইনি, বরং তিনি বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হওয়ায় পুলিশ ডাকাতির মিথ্যে মামলা খাড়া করে করে তাঁকে হেনস্থা করছে। পরিবারের দাবি: কয়েক জন পুলিশ অফিসার যে ধর্ষণের মামলা প্রত্যাহারের জন্য তাঁকে চাপ দিচ্ছিলেন, মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে আমিনুল শুধু তা-ই জানিয়ে যাননি, সেই অফিসারদের নামও বলেছেন।
তবু লালবাজারের কর্তারা সংশ্লিষ্ট অফিসারদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেননি বলে অভিযোগ ওঠে। পাশাপাশি অভিযোগ ওঠে, নাবালিকা ধর্ষণের জন্য যাঁর দিকে আমিনুল আঙুল তুলেছিলেন, সেই শেখ শাহজাদা বক্সকে পুলিশ আগাগোড়া আড়াল করে এসেছে। আমিনুলের পরিজনদের মতে, এক দিকে শাহাজাদার ক্রমাগত হুমকি, অন্য দিকে ডাকাতির ‘কেস’ দেখিয়ে কড়েয়া থানার রক্তচক্ষু দুই সাঁড়াশি চাপে মানসিক স্থিরতা হারিয়ে ফেলেছিলেন আমিনুল। সেটাই তাঁর আত্মহত্যার কারণ।
তবে এ দিন হাইকোর্টের মনোভাব দেখে আমিনুলের পরিবার সন্তোষ প্রকাশ করেছে। “কোর্ট যে সব মন্তব্য করেছে, তাতে আমরা খুশি। তবে আমরা চাই, সিবিআই তদন্ত করুক। তাতেই সত্য প্রকাশ পাবে। দোষীদের সাজা হবে। দাদার আত্মাও শান্তি পাবে।” বলেন আমিনুলের ভাই আনোয়ার। |