|
|
|
|
|
|
|
সিইও-র টেবিল থেকে |
সচেতন হলে কেউ ঠকাতে পারবে না
ভুল বুঝিয়ে পলিসি বিক্রি, বাজারের বিস্তার, প্রযুক্তির প্রয়োগ বিমার
সমস্যা-সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রজ্ঞানন্দ চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায়
এসবিআই লাইফের এমডি-সিইও অতনু সেন |
|
ভারতে বিমার বাজার কতটা সম্ভাবনাময়?
এ দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১২৫ কোটি। এ পর্যন্ত জীবনবিমার আওতায় এসেছেন মাত্র ৩.৮ শতাংশ মানুষ। সাধারণ বিমার ক্ষেত্রে সেটা আরও কম, ০.৫৭ শতাংশ। অথচ বিশ্বের উন্নত দেশগুলি এর কয়েকগুণ বেশি মানুষকে বিমার আওতায় আনতে পেরেছে। তবে আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থার ক্রমশ উন্নতি হচ্ছে। কাজেই বিমার বাজার বাড়ানোর বিশাল সুযোগ যে রয়েছে, সে কথা তো বলাই যায়।
কিন্তু সেই অনুপাতে এখানে বাজার বাড়েনি কেন? সম্প্রসারণের পথে অন্তরায় কী?
সচেতনতা। বিমা নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতার খুব অভাব। জীবনবিমার মাধ্যমে এক দিকে যেমন নিজের বা পরিবারের সুরক্ষার বন্দোবস্ত করা যায়, তেমনই আবার লগ্নি করে নিজের তহবিল বাড়িয়ে নেওয়া এবং করছাড়ের সুযোগও রয়েছে। তবে আমার মতে, এ ক্ষেত্রে যে কোনও পলিসি কেনার প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। দ্বিতীয় স্থানে আসা উচিত লগ্নির ভাবনা। এবং তার পরে করছাড়। আমাদের দেশে এই তিনটি বিষয়কে বেশির ভাগ সময়েই গুলিয়ে ফেলা হয়।
আমাদের দেশে বিমা ব্যবস্থাটি কতটা পরিণত?
অনেকগুলি বিষয় আছে। ওই যে আপনাকে আগেই বললাম সচেতনতার অভাব। এবং তার সঙ্গে রয়েছে উপযুক্ত শিক্ষার অভাব। জানেন তো, এই শিক্ষার অভাবের জন্যই বিমা পলিসি সঠিক ভাবে বুঝতে পারেন না সব গ্রাহক। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই ভুল বুঝিয়ে পলিসি বিক্রি বা ‘মিস সেলিং’-এর মতো অভিযোগ পাওয়া যায়।
আজকের বিমা ও সঞ্চয়ের একটা বড় সমস্যা কিন্তু এই ‘মিস সেলিং’। আপনার একটা বিশেষ চাহিদার জন্য আপনি বিমা করতে চাইছেন। কিন্তু এজেন্ট এমন একটা প্রকল্প আপনাকে বিক্রি করলেন, যাতে আপনার চাহিদা মিটবে না। এই সমস্যাটা আমরা জানি। এর সমাধানেরও চেষ্টা চলছে। বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থাও এটা ঠেকানোর জন্য নানা বিধিনিষেধ তৈরি করছে। তবে এতে আবার অন্য দিকে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। বিমা সংস্থাগুলির স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে। তবে এই ধরনের সমস্যা তৈরি হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সব ক্ষেত্রেই বিধিনিষেধ তৈরি করে। আর এক দিকে ‘মিস সেলিং’ ও অন্য দিকে তা ঠেকাতে কঠোর আইন এটা সব সময়েই শাঁখের করাতের মতো কাটে।
তা ছাড়া, আর একটি বিষয় হল বিমা নিয়ে গবেষণা। ভারতে কিন্তু এটা নিয়ে ভাবার, গবেষণা করার প্রচুর সুযোগ আছে। বিমা প্রকল্পগুলি নিয়ে ভাবা দরকার। আমাদের দেশে এত মানুষ, এত রকম তাঁদের চাহিদা। বিভিন্ন আয় ও ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক অবস্থান তাঁদের। একজনের সঙ্গে অন্য জনের প্রয়োজনের কত তারতম্য। আমার তো মনে হয়, এ দেশে সেই সব সংস্থাই ভাল ব্যবসা করতে পারবে, যারা প্রকল্প তৈরির ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিতে সক্ষম হবে। জরুরি হল, এই সমস্ত চাহিদা, প্রয়োজন, তারতম্য বুঝে প্রকল্প তৈরি করা।
যেমন, আমার নিজের মনে হয় একই পলিসির মাধ্যমে যদি জীবনবিমা, শস্যবিমা, স্বাস্থ্যবিমা-সহ আরও কিছু বিমার সুবিধা একসঙ্গে দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করা যায়! এ রকম প্রকল্প কিন্তু আমাদের দেশে জনপ্রিয় হবে। এসবিআই লাইফ এই ধরনের প্রকল্প চালু করার কথা ভাবছেও। |
|
ইউলিপ নিয়ে আপনার মত কী?
ইউলিপে ঝুঁকি বেশি, এটা বলতে পারি। কারণ খুব সোজা। ওই প্রকল্পের টাকা শেয়ার বাজারে লগ্নি করা হয়। গ্রাহক মারা গেলে তাঁর পরিবার বিমাকৃত অঙ্কের টাকা পুরোটা পাবে ঠিকই। কিন্তু সব দিকই ভাবতে হবে। একটা হতে পারে, পলিসি ম্যাচিওর করলে সাধারণ পলিসির থেকে বেশি টাকা পাওয়া গেল। আবার উল্টো দিকে তেমনই, শেয়ার বাজারের অবস্থা খারাপ হলে উবে যেতে পারে লগ্নির সিংহভাগ টাকাই। কাজেই এ ক্ষেত্রে ঝুঁকির বিষয়টি সব সময়ে মাথায় রেখেই এগোতে হবে। এ সব ক্ষেত্রে কোনও সাধারণ নিয়ম তৈরি করা সম্ভব নয়। মানে কোনওটিকে খারাপ বা ভাল বলা যাবে না। বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন রকম চাহিদা। আবার একই বয়সের দু’টি মানুষের মধ্যেও চাহিদার পার্থক্য থাকবে আর্থ-সামাজিক প্রভেদের কারণে।
বিমা হোক বা সঞ্চয় আমি সব সময়েই মনে করি, একজন তরুণের যতটা ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা থাকবে, আর একজন যিনি ততটা তরুণ নন, তাঁর সেটা থাকবে না। আর এখানেই একজন উপদেষ্টার ভূমিকা তৈরি হয়। বিমা সংস্থার একটা বড় ভূমিকাও অস্বীকার করা যায় না। যিনি বিমা করতে চাইছেন তাঁর ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা বুঝে, সঠিক বিনিয়োগের রাস্তা দেখানোর একটা দায় এখানে থাকেই। তাঁর চাহিদা বুঝে কোন প্রকল্পে তিনি টাকা ঢালতে পারেন ও কেন, সেটা বুঝিয়ে বলে তাঁকে নিজের মতো পছন্দ করতে দিতে হবে। তবে পছন্দের আগে কেন, কোন প্রকল্প তিনি পছন্দ করবেন সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়ার দায়ও উপদেষ্টার।
ওই যে ‘সচেতনতা’, ‘শিক্ষা’, এই কথাগুলো সব সময় খুব জরুরি। প্রকল্প যে-ধরনেরই বাছুন, এই বিষয়গুলি না-থাকলে ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা।
বিমার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় আপনার?
এটা খুব জরুরি ব্যাপার। আজকের দিনে প্রযুক্তির হাত ধরেই তো বিমার বাজার বাড়ানো সম্ভব। চটজলদি পলিসি করতে পারবেন আপনি প্রযুক্তি ব্যবহার করে। অকারণ সময় নষ্ট হবে না। জানবেন, ইন্টারনেটের ব্যবহার যত বাড়বে, বিমার বাজারও তত প্রসারিত হবে। বিশেষ করে মোবাইল পরিষেবার সুযোগ নিতে হবে আমাদের। মোবাইল ফোন এখন গ্রামে-গঞ্জেও বহু লোক ব্যবহার করে। মোবাইল পরিষেবা সংস্থাগুলির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে এগোলে এ ক্ষেত্রে ভাল ফল পাওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
এ ছাড়া, বিমা বিপণনের ক্ষেত্রে এজেন্টদের পাশাপাশি এনজিও, স্বনির্ভর গোষ্ঠী, ব্যাঙ্কিং করেসপনডেন্ট এবং ডাকঘরের মতো মাধ্যম ব্যবহারের কথাও বিমা সংস্থাগুলির ভেবে দেখা উচিত। ব্যাঙ্কও ইনশিওরেন্স বিপণনের মাধ্যম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। তবে নগদ টাকার জোগানে টান পড়লে ব্যাঙ্ক বিমা পলিসি বিক্রির থেকে আমানত সংগ্রহের উপর জোর দিচ্ছে, এটাই সাধারণত দেখা যায়।
বিমা ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে কী মনে করেন?
অবশ্যই এই প্রস্তাব দ্রুত কার্যকর করা জরুরি। বিমা পলিসি কেনা হয় দীর্ঘমেয়াদে, ১০, ১৫, ২০, ২৫ বছর, এই রকম। তাই এই ব্যবসায় মূলধনের প্রয়োজন বেশি। তা ছাড়া আরও একটি বিষয় সরকারের ভেবে দেখা উচিত। সেটা হল, আজ যে-টাকা প্রিমিয়াম হিসাবে বিমা সংস্থার কাছে এল, তা বোনাস-সহ মেটাতে হবে দীর্ঘকাল পরে। তাই ওই টাকা লগ্নি করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প বাজারে থাকা অত্যন্ত জরুরি। কিন্ত আমাদের দেশে সেটার অভাব আছে। পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিমার টাকাকে খাটানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি লগ্নি-প্রকল্প চালু করার কথা কেন্দ্রীয় সরকারের ভেবে দেখা জরুরি বলে আমি মনে করি। |
|
|
|
|
|