|
|
|
|
|
|
একরত্তির ভবিষ্যৎ |
স্কুল পেরিয়ে কলেজ। ‘দামি’ ডিগ্রি। বিদেশ পাড়ি। বিয়েও। ছেলে-মেয়ের পিছনে
একের পর এক খরচ সামলানোর উপায় খুঁজলেন ইন্দ্রজিৎ অধিকারী |
যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে... তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখতে সঞ্চয়ের পরিকল্পনা শুরু করতে হবে পরের সকাল থেকেই!
তবে অনন্তকাল শুধু পরিকল্পনায় আটকে থাকলে চলবে না। বরং টাকা জমানোর কাজে নেমে পড়তে হবে কোমর কষে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কারণ, যা দিনকাল, চিকিৎসা-স্কুলের পড়াশোনা-উচ্চশিক্ষার যা আকাশছোঁয়া খরচ, তাতে ছেলে-মেয়েকে ভাল ভাবে মানুষ করতে হলে একেবারে প্রথম থেকেই সঞ্চয়ে মন দিতে হবে আপনাকে। একটু একটু করে তৈরি করতে হবে তহবিল। অনেকটা মেয়ের বিয়ের জন্য পাড়ার দোকানে সামান্য করে হলেও সোনা কিনে রাখার মতো।
আবার শুধু জমানোর জন্য জমালে হবে না। সেই সঞ্চয়কে অবশ্যই হতে হবে সুপরিকল্পিত। নিখুঁত হোমওয়ার্কের ছাপ থাকতে হবে সেখানে। যাতে
যে-লক্ষ্যে টাকা রাখা, মেয়াদ শেষে হাতে পাওয়া অঙ্ক সত্যিই তার জন্য পর্যাপ্ত হয়। সঞ্চয়ের মাধ্যম এবং প্রকল্পও বাছতে হবে এমন ভাবে, যেন সেই টাকা প্রয়োজনের সময়ে হাতে আসে। তবেই না তা সার্থক?
দ্বাদশ পেরিয়ে ছেলে/মেয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাইলে যে বিস্তর খরচ হতে পারে, তা বিলক্ষণ জানেন আপনি। হয়তো তা আঁচ করে টাকাও রাখছেন অনেক আগে থেকে। কিন্তু আসল সময়ে গিয়ে দেখলেন, গলদ রয়ে গিয়েছে গোড়াতেই। কারণ, আন্দাজে ভর করে ভর্তির জন্য যে-টাকা রেখেছেন, এখন দেখছেন প্রয়োজনের তুলনায় তা নগণ্য। কিংবা হয়তো দেখা গেল, পলিসির মেয়াদ যখন ফুরোচ্ছে, ভর্তির পাট তত দিনে সারা। তখন? |
|
তাই আসুন, আজ গল্পের ছলে এ নিয়ে দু’চার কথা আলোচনা করি। সন্তানের ভাল কে না চান? কে না ভাবেন একটু সচ্ছল আর মসৃণ হোক ছেলে-মেয়ের বেড়ে ওঠা? তাই দেখিই না, কী ভাবে একটা সুন্দর, সুরক্ষিত ভবিষ্যৎ উপহার দেওয়া যায় ওদের—
চাইল্ড পলিসি
সন্তানের জন্য সঞ্চয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই ‘চাইল্ড পলিসি’র কথা ভেবে ফেলি আমরা। হবে না-ই বা কেন? ছেলে/মেয়ে জন্মানো ইস্তক এই প্রকল্পের কথাই তো কানের কাছে আওড়াতে থাকেন পরিচিত বিমা-এজেন্ট। বলেন, এই প্রকল্প করা থাকলে, বিমাকারীর মৃত্যু হলেও সন্তানের পড়াশোনা আটকাবে না। কারণ, তখন তাঁর হয়ে প্রিমিয়াম মিটিয়ে দেবে বিমা সংস্থা। ফলে পড়ার খরচের সংস্থান করা সম্ভব হবে বিমার টাকা দিয়েই। বুঝিয়ে দেন, কী ভাবে এই প্রকল্পে লগ্নি করলে, তাঁর টাকা জীবনের অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ধাপে (যেমন, দশম, দ্বাদশ, স্নাতক পাশের সময়) হাতে পাবেন আপনি। মনে করিয়ে দেন করছাড়ের সুবিধার কথাও।
তাই সব শুনে আমরা অনেকেই মনে করি, সন্তানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে এটিই বুঝি একমাত্র পথ। নিদেনপক্ষে সেরা পথ তো বটেই!
সন্তানের জন্য সঞ্চয়ের লক্ষ্যে এই রাস্তায় হাঁটা ঠিক কি-না, এককথায় তার উত্তর দেওয়া শক্ত। কারণ, তা নির্ভর করছে আপনি কী ধরনের পলিসিতে কত টাকা ঢালছেন, তার থেকে কেমন রিটার্ন পাবেন ইত্যাদির উপর। কিন্তু একটা কথা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি, ছেলে/মেয়ের জন্য সঞ্চয় করতে এই ধরনের পলিসি কেনা আর যা-ই হোক, অন্তত একমাত্র পথ নয়। যদি মনে করেন, কোনও ঝুঁকি না-নিয়ে ওই ধরনের প্রকল্পেই বেশি-বেশি বিনিয়োগ করে প্রয়োজনীয় টাকা জমিয়ে ফেলতে পারবেন, তা হলে অসুবিধা নেই। নইলে একটু অন্য ভাবেও ভাবতে পারেন।
বিমা কিন্তু সঞ্চয় নয়
দেখুন, বিমা আসলে ঝুঁকির রক্ষাকবচ। একে নিখাদ সঞ্চয় হিসেবে না-দেখাই ভাল। বিমা মূলত কাজে আসে বিপদের দিনে। কিন্তু যেহেতু তা ঝুঁকি ‘কভার’ করে, তাই এতে রিটার্ন তুলনায় কম হতে বাধ্য। তাই আজকাল অনেকেই মনে করেন, বিমার সুরক্ষার জন্য বরং টার্ম পলিসি ভাল। তাতে তুলনায় কম প্রিমিয়ামে মোটা কভারেজ পাওয়া যাবে। আবার বাকি টাকা লাগানো যাবে চড়া রিটার্নের প্রকল্পে। ছেলে/মেয়ের জন্য টাকা রাখার ক্ষেত্রেও এই সূত্র কতটা কার্যকর, তা নিয়েই এখানে এক দফা আলোচনা সেরে নেব আমরা। |
|
অন্য অঙ্ক
সঞ্চয়ের ঘুঁটি কী ভাবে সাজালে সব থেকে ভাল হবে, তা আদৌ একলপ্তে মুখস্থ করার ধারাপাত নয়। কারণ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমূল বদলে যাবে পরিস্থিতি। এক দিকে, সন্তান যত বড় হবে, তত বাড়বে তার পড়াশোনার খরচ। স্নাতক স্তর থেকে তা আবার অনেকটা নির্ভর করবে পড়ার বিষয় ও জায়গা বাছার উপর (সরকারি কলেজে অনার্স আর বেসরকারি কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার খরচ কিন্তু এক নয়)। তেমনই উল্টো দিকে, সব ঠিকঠাক চললে, বাড়বে আপনার আয়ও। সেই অনুসারে সঞ্চয় কিছুটা বাড়িয়ে নিতে পারবেন আপনি। ফলে এই দু’য়ের মধ্যে ভারসাম্য রেখে সঞ্চয়ের কৌশল ক্রমাগত বদলে যেতে হবে আপনাকে। কিন্তু এই সব কিছুর জন্য সবার প্রথমে লক্ষ্য স্থির করে ফেলা জরুরি।
পাখির চোখ
• গোড়াতেই হিসেব কষুন, মূলত কী কী কারণে কখন কখন মোটা টাকা প্রয়োজন হবে আপনার।
• এ ক্ষেত্রে অন্তত চারটি বিষয় শুরু থেকেই মাথায় রাখুন
(১) চিকিৎসা (২) বিমার সুরক্ষা
(৩) পড়াশোনা (৪) বিয়ে
এর সঙ্গে আরও একটা মোটা খরচও ধরে রাখা ভাল। হয়তো দেখা গেল, চাকরির বদলে নিজের ব্যবসা শুরু করতে চায় আপনার ছেলে/মেয়ে। সে ক্ষেত্রে শুরুর মূলধনের কিছুটা জোগাতে পারলে, নেহাত খারাপ লাগবে না। আবার সন্তান উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ পাড়ি দিতে চাইলেও কাজে লাগানো যেতে পারে সেই পুঁজি। সে ক্ষেত্রে নির্ভরতা কমবে শিক্ষা-ঋণের উপর। তাই কষ্ট করে এই বাড়তি অর্থের সংস্থান করে রাখতে পারলে, সুবিধা যথেষ্ট। তবে এই টাকা যদি জমাতে না-ও পারেন, প্রথম চার খাতে কিন্তু তা তুলে রাখতেই হবে আপনাকে।
মাথায় রাখুন মূল্যবৃদ্ধিও
সন্তানের জন্য টাকা রাখার আগে যেমন লক্ষ্য স্থির করছেন, তেমনই মাথায় রাখুন মূল্যবৃদ্ধিও। মনে রাখবেন, এ ক্ষেত্রে বেশ লম্বা সময়ের জন্য লগ্নি করছেন আপনি। তাই সেই দীর্ঘ সময় পরে হাতে আসা টাকা যেন পর্যাপ্ত হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে আপনাকে।
এমনিতেই বাজার আগুন। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে হু হু করে। লাফিয়ে বাড়ছে চিকিৎসা আর শিক্ষার খরচ। নামী বেসরকারি স্কুলে ভর্তির খরচ জোগাতেই নাভিশ্বাস উঠছে আমাদের। ফলে নিশ্চয়ই আঁচ করতে পারছেন, আজ থেকে ১০-১৫ বছর পর পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে!
মনে করুন, আজ একটি ১৫ বছরের বিমা প্রকল্পে টাকা রাখলেন। সংস্থা প্রতিশ্রুতি দিল, তখন বোনাস-সহ ৬ লক্ষ টাকা ফেরত দেওয়ার। আজ হয়তো মনে হবে সেই টাকা সন্তানকে স্নাতক স্তরে ভর্তি করার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু তখন দেখবেন, প্রয়োজনের তুলনায় তা নগণ্য। তাই যে-টাকা পাবেন, তাকে আজকের মাপকাঠিতে বিচার করে লাভ নেই। বরং ভাবুন, তখন ওই টাকা যথেষ্ট হবে কি না। |
|
এ বার আসুন, মূল্যবৃদ্ধির হার্ডল টপকে লক্ষ্য পূরণ কী ভাবে সম্ভব, তা নিয়ে আলোচনা সেরে নিই আমরা—
চিকিৎসার খরচ
• চিকিৎসার খরচ যে ভাবে বাড়ছে, তাতে স্বাস্থ্যবিমা না-করাটাই বিরাট ঝুঁকি। বেসরকারি হাসপাতালে এখন রুটিন অস্ত্রোপচারেও যে-পরিমাণ ‘বিল’ আসে, অনেক সময়েই পকেট থেকে নগদে তার সংস্থান করা শক্ত।
সুতরাং আগামী দিনে এই অঙ্ক কোথায় পৌঁছবে, তা সহজেই অনুমেয়। তাই—
• প্রথম থেকেই সন্তানকে চিকিৎসা বিমার আওতায় রাখুন।
• শুরু করুন ‘ফ্যামিলি ফ্লোটার পলিসি’তে তাকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে। অর্থাৎ ধরুন, আপনার এবং স্ত্রীর একটি তিন লক্ষ টাকার ফ্লোটার পলিসি রয়েছে। সেখানে এ বার সন্তানের নামও যোগ করুন। তাতে প্রিমিয়াম সামান্য বাড়বে। কিন্তু তেমনই ছেলে/মেয়ের চিকিৎসা নিয়ে অনেকটাই নিশ্চিন্ত হতে পারবেন আপনি।
• সামর্থ্য অনুযায়ী ক্রমশ বাড়াতে থাকুন কভারেজের অঙ্ক।
• সন্তান কিছুটা বড় হলে (ধরুন ১৮ বছর), তার জন্য আলাদা চিকিৎসা বিমার বন্দোবস্ত করুন। যাতে পরে স্বাবলম্বী হলে, সে নিজেই ওই বিমা চালিয়ে যেতে পারে।
• যে-পলিসিই করুন না কেন, তাতে ক্যাশলেস পরিষেবা থাকা বাঞ্ছনীয়। যাতে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করতে হলে, চট করে পকেটে হাত দেওয়ার প্রয়োজন না-পড়ে।
বিমার সুরক্ষা
• মনে রাখবেন, সন্তানের নামেই বিমা কিনছেন কি না, সেটা আদৌ বিচার্য বিষয় নয়। তার থেকে বরং অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেই পলিসি ঝুঁকির সুরক্ষা হিসেবে যথেষ্ট কি না।
• ছেলে/মেয়ের জন্য বিমা জরুরি কেন? যাতে, পরিবারের প্রধান উপার্জনকারীর (বাবা/মা) মৃত্যু হলেও তার বেড়ে ওঠা বা পড়াশোনায় টাকার সমস্যা না-হয়। তাই সবার আগে পরিবারের প্রধান উপার্জনকারীর উচিত নিজের নামে মোটা অঙ্কের বিমা করে রাখা। যাতে তাঁর অবর্তমানেও পরিবার অন্তত আর্থিক ভাবে সুরক্ষিত থাকে।
• মোটা টাকার এনডাওমেন্ট পলিসি করতেই পারেন। কিন্তু তাতে প্রিমিয়ামও গুনতে হবে মোটা অঙ্কের। তাই অনেক বিশেষজ্ঞই এখন পরামর্শ দেন, তার বদলে একটা বড়সড় কভারেজের টার্ম পলিসি করার। এ কথা ঠিকই যে, গ্রাহক মারা গেলে তবেই এই প্রকল্প থেকে টাকা পাওয়া যায়। নইলে মেয়াদ শেষে সাধারণত এক পয়সাও মেলে না। কিন্তু তেমনই এর বড় সুবিধা হল, কম টাকায় মোটা অঙ্কের কভারেজ।
ধরুন, কারও বয়স ৩৩ বছর হলে, ১৫ বছরের জন্য ৩০ লক্ষ টাকার এনডাওমেন্ট বিমা পলিসি করতে তাঁকে প্রতি বছর প্রিমিয়াম দিতে হবে দু’লক্ষ টাকারও বেশি। কিন্তু সেখানে যদি তিনি টার্ম পলিসি করেন, তা হলে প্রিমিয়াম পড়বে মাত্র ৪৯২৮ টাকা।
• এই কারণে এখন অনেকেই মনে করছেন শুধু শুধু বিমায় মোটা টাকা আটকে রাখা বোকামি। বরং কম টাকায় টার্ম পলিসি কিনে ঝুঁকি এড়ানোর বন্দোবস্ত করে বাকিটা মিউচুয়াল ফান্ড কিংবা অন্য কোনও চড়া রিটার্নের প্রকল্পে লগ্নি করা ভাল। |
|
পড়াশোনার বন্দোবস্ত
• উচ্চশিক্ষা তো ছেড়েই দিন, আজকাল বেসরকারি স্কুলে ভর্তিও বেশ খরচসাপেক্ষ। তাই একেবারে স্কুলে ভর্তির সময় থেকে পর পর সব ধাপের জন্য টাকা রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।
• ছেলে/মেয়ের কেরিয়ার গড়তে গেলে, কম ও বেশি দু’রকম মেয়াদেই টাকা রাখার কথা ভাবতে হবে।
• প্রথমে লম্বা সময়ের লগ্নির কথায় আসি। ভেবে দেখুন, ঠিক কোন কোন সময়ে (দ্বাদশে ভর্তি, স্নাতক স্তরে ইঞ্জিনিয়ারিং/ডাক্তারি পড়া, স্নাতকোত্তরে ম্যানেজমেন্টের পাঠ ইত্যাদি) থোক টাকার প্রয়োজন হতে পারে। সেই অনুসারে মেয়াদ বুঝে প্রকল্প বাছুন।
• দীর্ঘ মেয়াদে যে-টাকা বিনিয়োগ করছেন, তাতে ঝুঁকি নিয়ে বেশি রিটার্ন আর ঝুঁকি ছেঁটে কম রিটার্ন দু’য়েরই ভারসাম্য থাকা জরুরি।
• যদি আপনি মনে করেন, কোনও ঝুঁকি না-নিয়ে শুধুমাত্র ফিক্সড ডিপোজিট (স্থায়ী আমানত) কিংবা এনএসসি-র মতো প্রকল্পে লগ্নি করবেন, তা হলে মূল্যবৃদ্ধির অসুরকে টেক্কা দেওয়া শক্ত। অর্থাৎ, সে ক্ষেত্রে আপনার লগ্নি হয়তো সুরক্ষিত থাকবে। কিন্তু সুদের হার মূল্যবৃদ্ধিকে সে ভাবে টেক্কা দিতে পারবে না। ফলে মেয়াদ শেষে যে-টাকা হাতে পাবেন, দেখবেন তা হয়তো যথেষ্ট নয়। তাই চড়া রিটার্ন পেতে কিছুটা ঝুঁকি নিতেই হবে আপনাকে।
এই ধরনের লগ্নির অন্যতম মাধ্যম হতে পারে মিউচুয়াল ফান্ড। বিশেষত এসআইপি (সিস্টেম্যাটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান)। ভাল ভাবে খোঁজ-খবর নিয়ে ফান্ড বাছাইয়ের পর একটা লম্বা সময় সেখানে নিয়ম করে মাসে-মাসে টাকা রাখুন। শেয়ার বাজারের উত্থান-পতনের সঙ্গে সঙ্গে ফান্ডের ন্যাভ (যার উপর রিটার্ন নির্ভর করে) ওঠা-নামা করবে ঠিকই। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে লগ্নি চালিয়ে যেতে পারলে, রিটার্নের অঙ্ক সাধারণত হতাশ করে না।
বাজার সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা স্পষ্ট থাকলে, কিনতে পারেন শেয়ারও। তবে সেখানেও টাকা রাখতে হবে দীর্ঘ মেয়াদে। মনে রাখবেন, শেয়ার বাজার বা মিউচুয়াল ফান্ড কিন্তু চটজলদি লাভের জায়গা নয়।
• অবশ্য চড়া রিটার্নের আশায় সঞ্চয়ের পুরোটা বাজারে খাটানোও তেমন বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়। বিশেষত যখন সন্তানের পড়াশোনা নির্ভর করছে ওই টাকার উপর। তাই ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখা টাকার একটা অংশ লগ্নি করুন পিপিএফ, ব্যাঙ্কের স্থায়ী আমানত ইত্যাদির মতো প্রকল্পেও। যেখানে সুদ হয়তো তুলনায় কম, কিন্তু পুঁজির নিরাপত্তা বেশি।
মনে করুন, ছেলে/মেয়ের বয়স যখন তিন, তখন পিপিএফে টাকা রাখতে শুরু করলেন আপনি। ওই প্রকল্পে প্রতি বছর এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত রাখা যায়। তাই পরের ১৫ বছর ধরে সেখানে প্রতি বার একটা মোটা টাকা জমা করতে পারলে যে-তহবিল তৈরি হবে, তা নেহাত মন্দ নয়। এবং খেয়াল করে দেখুন, ওই টাকা আপনার হাতে আসছে সন্তানের বয়স ঠিক আঠারো ছোঁয়ার সময়ে। ফলে স্নাতক স্তরে তার ভর্তির জন্য ওই টাকা দিব্যি কাজে লাগানো যেতে পারে। তা ছাড়া করছাড়ের সুবিধা তো আছেই।
টাকা এক-দু’বছর আগে ম্যাচিওর করলেও অসুবিধা নেই। বরং কিছু দিনের জন্য কোনও সুরক্ষিত প্রকল্পে (স্বল্প বা মাঝারি মেয়াদের আমানত) তা তুলে রাখলে, সুদ মিলবে।
• এখন পড়াশোনার ধাঁচ বদলেছে। উৎসব-অনুষ্ঠানে লেগেই রয়েছে স্কুলের নানা ফরমায়েশ। প্রতিযোগিতার দৌড়ে এগিয়ে রাখতে ছেলে/মেয়েকে কখনও শেখাতে হচ্ছে কম্পিউটার। কখনও আবার তাকে ভর্তি করতে হচ্ছে সাঁতার কিংবা ক্যারাটের ক্লাসে। এ সব খাতেও খরচ নেহাত কম নয়।
আর তার থেকেও বড় কথা হল, এই সব প্রয়োজন হানা দেবে আচমকা। আগাম প্রস্তুতির সময় না-দিয়েই। তাই পুরো টাকা লম্বা সময়ের জন্য লগ্নি করলে চলবে না। তা রাখতে হবে স্বল্প মেয়াদেও। এমন ভাবে, যাতে চাইলেই তা হাতে পাওয়া যায়। এ জন্য নির্ভর করা যেতে পারে একেবারে স্বল্প মেয়াদি আমানত, লিক্যুইড ফান্ড, সেভিংস অ্যাকাউন্ট ইত্যাদির উপর।
বিয়ের ব্যবস্থা
• উচ্চশিক্ষার মতো বিয়ের জন্য টাকা রাখাও বেশ দীর্ঘ মেয়াদি বিনিয়োগ। এর জন্যও অনেক আগে থেকে পরিকল্পনা করে সঞ্চয় করা যায়। কিন্তু কাজের সময়ে প্রয়োজন হয় মোটা অঙ্কের অর্থ। তাই পড়াশোনার (বিশেষত উচ্চশিক্ষা) জন্য লম্বা সময় ধরে যে-ভাবে টাকা রাখবেন, বিয়ের বেলাতেও তাই। মিউচুয়াল ফান্ডে এসআইপি-র মাধ্যমে লগ্নি এ ক্ষেত্রেও করা যেতে পারে। বাকি টাকা জমানো যেতে পারে পিপিএফের মতো কম ঝুঁকির প্রকল্পে।
• বিয়েতে যে-জিনিসটা বাড়তি লাগবে, তা হল গয়না। তাই সোনা কেনার টাকার বন্দোবস্ত করে রাখতে হবে আপনাকে। অনেকেই এ জন্য মাসিক কিস্তিতে সোনা কেনেন। তার পাশাপাশি চল বাড়ছে গোল্ড-ইটিএফে (গোল্ড এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড) লগ্নিরও। কাগুজে সোনা থেকে মোটা টাকা হাতে এলে, গয়নার সোনা কিনে ফেলা যাবে তা দিয়েই। আলাদা করে অর্থ সংস্থানের প্রয়োজন আর পড়বে না।
জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাট
• জমি-বাড়ির দাম বাড়ছে হু হু করে। গত পাঁচ-সাত বছরে অত্যন্ত ভাল লাভের সন্ধান দিয়েছে রিয়েল এস্টেটে লগ্নি। তাই বাস করতে নয়, পরে বেচবেন বলেও এখন জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাট কিনছেন অনেকে।
সমীক্ষা অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গ-সহ পূর্বাঞ্চলে যত বাড়ি বা ফ্ল্যাট বিক্রি হয়, তার ২৫-৩০ শতাংশই কেনা হয় সঞ্চয়ের হাতিয়ার হিসেবে। মাথার উপর ছাদ মনে করে নয়। সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য এই পথে টাকা রাখার কথা ভাবতে পারেন আপনিও।
• নিখাদ সঞ্চয়ের জন্য (যেখানে আপনি বাস করবেন না) যদি অনেক আগে থেকে একখানা জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনে রাখতে পারেন, তা হলে অন্তত তিন দিক দিয়ে সুবিধা
(১) সন্তানের উচ্চশিক্ষা কিংবা বিয়ের জন্য টাকার প্রয়োজন হলে, তখন কেনা দামের থেকে অনেক বেশি দরে ওই সম্পত্তি বিক্রি করে দিতে পারবেন আপনি। সেই টাকা কাজে লাগাতে পারবেন সন্তানের প্রয়োজনে।
(২) বিক্রি যদি না-করেন, তা হলেও একটি সম্পদ তৈরি হয়ে থাকল সন্তানের নামে। পরে সে সেখানে বাস করতে পারে। আবার বিক্রি করে মেটাতে পারে অর্থের প্রয়োজনও।
(৩) বিক্রি বা সন্তানের হাতে তুলে দেওয়ার আগে পর্যন্ত বাড়ি বা ফ্ল্যাট ফেলে না-রেখে তা অনায়াসে ভাড়া দিতে পারবেন আপনি। হয়তো দেখা যাবে, গৃহঋণের মাসিক কিস্তির অনেকটাই শোধ হয়ে যাচ্ছে সেখান থেকে। কিংবা হাতে চলে আসছে এক-দু’টি এসআইপি-তে লগ্নির অর্থ।
• মনে রাখবেন, কোথায় সম্পত্তি কিনছেন, তা কিন্তু অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, পরে দাম কতটা বাড়বে, তা নির্ভর করে মূলত জায়গার উপরেই। তাই জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাট কিনুন সম্ভাবনাময় জায়গায়। যেখানে দাম এখনও তুলনায় কম, কিন্তু পরে বাড়ার সম্ভাবনা ষোলো আনা। যেমন ধরুন, কলকাতার উপকণ্ঠে কোথাও মেট্রো রেল এখনও আসেনি, কিন্তু এসে পড়বে বছর কয়েকের মধ্যে। কিংবা কোথাও হয়তো বাস-যোগাযোগ এখনও তেমন সুবিধার নয়। কিন্তু রাস্তা আর ফ্লাইওভারের কাজ শুরু হয়েছে। বাজার-দোকান-শপিং মল মিলিয়ে কোনও জায়গা হয়তো আর কিছু দিনের মধ্যেই জমজমাট হয়ে যাবে। লগ্নির জন্য এই সমস্ত জায়গায় সম্পত্তি কেনাই কিন্তু আপনার সেরা বাজি।
• তবে সম্পত্তি বিক্রি করে যদি টাকার সংস্থান করতে চান, তা হলে একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ফেলে রাখবেন না। কারণ, ক্রেতা পেতে, দরদস্তুর হতে কিছুটা সময় তো লাগেই। তাই বুদ্ধিমানের কাজ হল, যখন টাকা প্রয়োজন হবে, তার অন্তত বছর খানেক আগে সম্পত্তি বিক্রি করে কোনও নিরাপদ জায়গায় (যেমন, সেভিংস অ্যাকাউন্ট) ওই অর্থ তুলে রাখা।
নইলে দরকারের সময়ে টাকা পেতে অসুবিধা হতে পারে। |
|
|
|
|
|