এ যেন উলটপুরাণ!
একে একে গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদের আসনগুলি যখন সিপিএমের হাতছাড়া হল, সেখানে ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটল কয়েকটি গ্রাম পঞ্চায়েতে। কয়েকটি জায়গার মানুষ পাঁচ বছরের মধ্যেই তৃণমূলকে সরিয়ে পঞ্চায়েতের শাসন ক্ষমতা ফিরিয়ে দিল সিপিএমকে। রাজ্যে ক্ষমতায় তৃণমূল থাকা সত্ত্বেও পাঁচ বছরের মধ্যেই সোনামুখীর ধুলাই ও ডিহিপাড়া পঞ্চায়েতের মানুষ কেন এ বার শাসকদলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন? প্রশ্ন তুলেছেন রাজনীতির কারবারিরা।
শুধু পঞ্চায়েতে সিপিএম যেমন ফিরে এসেছে, তেমনি এই কঠিন সময়েও পিয়ারবেড়া পঞ্চায়েত নিজেদের হাতে ধরে রাখতে পেরেছে সিপিএম। তাদের প্রার্থীরা জোর লড়াই দেওয়ায় মানিকবাজার ও হামিরহাটি পঞ্চায়েতে ত্রিশঙ্কু অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তবে সিপিএম নেতৃত্ব দাবি করছেন, ওই দুই পঞ্চায়েতে জয়ী নির্দল প্রার্থীদের সাহায্য নিয়ে তাঁরাই বোর্ড গঠন করবেন। যদিও তাঁদের এই আশায় জল ঢালার চেষ্টায় নেমে পড়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব।
ধুলাই গ্রাম পঞ্চায়েতে ২০০৮-এর নির্বাচনে সিপিএমের আসন ছিল ৩। এ বার বেড়ে হয়েছে ১১। অন্য দিকে, ডিহিপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতে পাঁচ বছর আগে সিপিএমের ছিল ২ জন সদস্য। এ বার এক লাফে তা হয়েছে ১০ সদস্যে। এ রকম সাফল্যের কারণ হিসাবে গত পাঁচ বছরে তৃণমূলের অনুন্নয়নকেই দূষছেন সিপিএমের সোনামুখী জোনাল সম্পাদক শেখর ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “কাজ না করে ওরা পঞ্চায়েতের টাকা লুটেপুটে খেয়েছে। তাই মানুষ আমাদের প্রার্থীদেরই এ বার সমর্থন করেছেন।” এই দাবিকে নস্যাৎ করে তৃণমূল যুব সংগঠনের বাঁকুড়া জেলা সভাপতি সুরজিৎ মুখোপাধ্যায়ের দাবি, “পাঁচ বছরের মেয়াদের মধ্যে তিন বছর ওই পঞ্চায়েতগুলি বামফ্রন্ট রাজ্য সরকারের অধীনে ছিল। সিপিএমের বঞ্চনার জন্য তেমন উন্নয়নের কাজ করা যায়নি। ফলে কাজের সুযোগ তেমন মিলল কই?”
হামিরহাটি গ্রাম পঞ্চায়েতের ৯টি আসনের মধ্যে সিপিএম, তৃণমূল এবং নির্দল ৩টি করে আসন পেয়েছে। মানিকবাজার গ্রাম পঞ্চায়েতের ৭টি আসনের মধ্যে সিপিএম ৩, তৃণমূল ৩, নির্দল ১টি আসন পেয়েছে। কোচডি গ্রাম পঞ্চায়েতের ৮টি আসনের মধ্যে সিপিএম ৪, তৃণমূল ৩ ও নির্দল ১টি আসন পেয়েছে। হামীরহাটি ও মানিকবাজার গ্রাম পঞ্চায়েত পরিষ্কার ভাবে ত্রিশঙ্কু অবস্থার মধ্যে রয়েছে। নির্দল প্রার্থীদের মতিগতির উপরেই দু’পক্ষ নির্ভরশীল হয়ে রয়েছেন। আবার কোচডিতে নির্দল প্রার্থী কোনও পক্ষে না গেলে ওই পঞ্চায়েতটি সিপিএম পেতে পাচ্ছে। আবার তৃণমূল নির্দল প্রার্থীকে সঙ্গে টানলে পঞ্চায়েতে টাই হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্র টসের মাধ্যমে তৃণমূলের পঞ্চায়েত পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
সোনামুখী পুরসভার বিরোধী দলনেতা তথা তৃণমূল যুব সংগঠনের বাঁকুড়া জেলা সভাপতি সুরজিৎ মুখোপাধ্যায়ের দাবি, “ওই তিন পঞ্চায়েতের জয়ী নির্দলরা তো আসলে আমাদেরই বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর। বোর্ড গঠনে ওরা আমাদের পাশেই থাকবে।” দলেরই একাংশ বলছেন, দেখা যাক, তাতে যদি মুখরক্ষা হয়! সিপিএমের সোনামুখী জোনাল কমিটির সম্পাদক শেখর ভট্টাচার্য অবশ্য পাল্টা দাবি করছেন, “যাঁরা তৃণমূলের টিকিট না পেয়ে বিরক্ত হয়ে নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন, আমরা তাঁদের সাহায্য নিয়ে ওই তিন পঞ্চায়েত দখল করব। তাঁরা আমাদের এ ব্যাপারে সম্মতিও জানিয়েছেন।” আর নির্দল প্রার্থীদের কেউ কেউ বলছেন, “এই মওকায় প্রধান হওয়ার একটা সুযোগ আছে। দেখিই না কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়!” টানা দশ বছর তৃণমূলের দখলে থাকা হিড়বাঁধ ব্লকের মশিয়াড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের ফলাফল এ বার উল্টে গিয়েছে। এই পঞ্চায়েতের ১০টি আসনের মধ্যে সিপিএম ৬টি, আরএসপি ৩টি এবং তৃণমূল একটি আসন পেয়েছে।
পুরুলিয়া জেলার রঘুনাথপুর ১, ২, পাড়া, মানবাজার ২, পুঞ্চা ব্লকে এমন কিছু ব্যতিক্রমী ছবি দেখা গিয়েছে। রঘুনাথপুর ১ ব্লকের শুধুমাত্র যে খাজুরা গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূল জিতেছিল, এ বার সেই পঞ্চায়েতই বড় ব্যবধানে তারা হারাল। ১১টির মধ্যে ৯টি আসনে জয়ী হয় সিপিএম। একইভাবে রঘুনাথপুর ২ ব্লকে এক মাত্র বড়দা নতুনডি গ্রাম পঞ্চায়েতে ক্ষমতায় ছিল তৃণমূল। এ বার এখানে ১০টির মধ্যে ৭টিতে জিতেছে বামেরা। পুঞ্চা ব্লকের ছিরুডি, পানিপাথর পঞ্চায়েতেও হারিয়েছে তৃণমূল। ওই ব্লকেরই লাখরা পঞ্চায়েতে গতবার তৃণমূল ছিল। এ বার ১০টির মধ্যে অর্ধেক আসনে তৃণমূল জেতায় টাই হয়েছে। মানবাজার ২ ব্লকের দিঘি গ্রাম পঞ্চায়েতও তৃণমূল হারিয়েছে। পাড়া ব্লকের দেউলি পঞ্চায়েতে প্রথমে ক্ষমতায় ছিল তৃণমূল। পরে সদস্যেরা কংগ্রেসে যোগ দেওয়ায় পঞ্চায়েতটি দখল করে কংগ্রেস। সেই পঞ্চায়েতও এ বার দখল করেছে সিপিএম।
রাজনীতির কারবারিরা অবশ্য দাবি করছেন, তৃণমূলের দখলে থাকা কিছু পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে অনুন্নয়নের সঙ্গে বারবার দুর্নীতি ও স্বজনপোষনের অভিযোগ উঠেছে। ঠিক যে কারণে ওই পঞ্চায়েতগুলিতে পাঁচ বছর আগে সিপিএমের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন ভোটাররা। সিপিএমের পুরুলিয়া জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য প্রদীপ রায় বলেন, “তৃণমূলের স্বরূপ ওই এলাকার মানুষ বুঝে গিয়েছেন। পাঁচ বছর পরে সারা রাজ্যেও তৃণমূলের একই হাল হবে।” তৃণমূলের জেলা কার্যকরী সভাপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করেছেন, “হেরে হাওয়া কিছু পঞ্চায়েতের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়ে আগেই আমরা ব্যবস্থআ নিয়েছিলাম। এই পরাজয় ওঁদের, দলের নয়।”
|
(সহ প্রতিবেদন: শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল)। |