|
|
|
|
মানছে বিরোধীরাও |
জঙ্গলমহলে শান্তির পক্ষে জনতার রায় |
কিংশুক গুপ্ত • ঝাড়গ্রাম |
‘তৃণমূল থাকলে জঙ্গলমহলে শান্তি থাকবে। না হলে মাওবাদীরা ঢুকে ফের খুন-সন্ত্রাস করবে।’ জঙ্গলমহলে পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে এসে বারবার এই কথা বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যেই জঙ্গলমহলে তৃণমূল বাজিমাত করেছে বলে মনে করছে সিপিএম-সহ বিরোধী দলগুলি। সিপিএম, কংগ্রেস ও ঝাড়খণ্ডী নেতা-কর্মীরা বলছেন, গবির মানুষকে সস্তায় চাল, পুলিশে চাকরি তো আছেই। কিন্তু তা ছাপিয়ে ‘মাওবাদী মুক্ত’ শান্তির পরিবেশ ‘উপহার’ দেওয়ার জন্যই জঙ্গলমহলে ‘অপ্রত্যাশিত’ জনসমর্থন পেয়েছে তৃণমূল।
রাজ্যে ক্ষমতায় আসার দু’বছরের মাথায় এ বারের পঞ্চায়েত ভোট তৃণমূলের কাছে কার্যত অগ্নিপরীক্ষা ছিল। গত দু’বছরে জঙ্গলমহলে বার বার এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একের পর এক প্রকল্পের ঘোষণা করেছেন। বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ চলছে। তবুও সাংগঠনিক ভাবে অগোছালো তৃণমূলকে পিছনে ফেলে সিপিএম তথা বামেরা জঙ্গলমহলে ‘প্রত্যাশিত’ ফলের আশায় ছিল। সিপিএমের সঙ্গে সমঝোতা করে কয়েকটা গ্রাম পঞ্চায়েত আর অন্তত একটা পঞ্চায়েত সমিতির ক্ষমতা পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী ছিল ঝাড়খণ্ডীরাও। সে গুড়ে বালি! পঞ্চায়েত ভোটের ফলে জঙ্গলমহলের কেন্দ্রভূমি ঝাড়গ্রাম মহকুমার ৮টি পঞ্চায়েত সমিতিই তৃণমূল দখল করে নিয়েছে (গতবার সিপিএম তথা বামফ্রন্ট ৭টি এবং ঝাড়খণ্ডীরা ১টি দখল করেছিল)। জেলা পরিষদের ১৬টি আসনও এবার তৃণমূলের দখলে (গতবার সিপিএম তথা বামফ্রন্ট ১২টি ও ঝাড়খণ্ড পার্টি ২টি)। ৮টি ব্লকের ৭৯টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৭৩টি জোড়াফুলের কব্জায় (গতবার সিপিএম ৫৩টি, ঝাড়খণ্ড পার্টি ২৫টি ও তৃণমূল ১টি)। ভোটের ফলে চোখে সর্ষেফুল দেখছেন বিরোধীরা। সিপিএম নেতাদের একাংশ মানছেন, ২০০৮ সালের নভেম্বর থেকে টানা আড়াই বছর জঙ্গলমহলে দাপিয়ে বেড়িয়েছে মাওবাদী-জনগণের কমিটি। একের পর এক খুন সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে। ওই সময় আড়াইশোরও বেশি মানুষ খুন হন। অপহৃত হয়ে এখনও নিখোঁজ রয়েছেন ৭৭জন। সব মিলিয়ে ২৮৮ দিন বন্ধ-অবরোধ হয়েছিল। নানা ছুতোনাতায় বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের কাছে তোলাবাজি চালাত মাওবাদী-কমিটির লোকেরা। সেই পরিস্থিতি উপযুক্ত হাতে মোকাবিলা করতে পারেননি তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সিপিএমের এক প্রবীণ নেতার কথায়, “গরিব মানুষ খেতে পাক, বা না-পাক, সকলেই শান্তি চায়। গ্রামের মানুষকে এখন আর বিনিদ্র রজনী কাটাতে হচ্ছে না। দু’বছর আগে আমরা তৃণমূল-মাওবাদী সংশ্রবের অভিযোগ করতাম বটে। কিন্তু জঙ্গলমহলের তখনকার নৈরাজ্য পরিস্থিতি কঠোর হাতে মোকাবিলা করার মতো সাহস আমাদের সরকার দেখাতে পারে নি। সেটা বর্তমান সরকার পেরেছে।” সিপিএমের নিচুতলার কর্মীদের একাংশ বলছেন, “চৌত্রিশ বছরে নয়াগ্রামে সুবর্ণরেখায় কিংবা লালগড়ে কংসাবতীতে সেতু হয় নি। মমতার সরকারের আমলে দু’টো সেতুর কাজ হচ্ছে। ফলে গ্রামের মানুষ তৃণমূলকে অন্ততপক্ষে পাঁচটা বছর দেখতে চাইছেন। সর্বত্রই রাস্তাঘাট তৈরি বা চওড়া করার কাজ হচ্ছে। কাজের গতি শ্লথ হতে পারে। কিন্তু মানুষ চোখে উন্নয়নের কাজটা দেখছেন।” সিপিএমের লালগড় লোকাল কমিটির সদস্য তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “মানুষ মনে করছেন তৃণমূল থাকলে তারা ভাল থাকবেন। শাসক দল থেকে এই বার্তাটা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।” জেলা কংগ্রেসের সহ সভাপতি সুব্রত ভট্টাচার্যের কথায়, “রক্তঝরা দিনগুলি থেকে মানুষ মুক্তি পেয়েছেন। ‘তৃণমূল থাকলে শান্তি থাকবে’ মুখ্যমন্ত্রীর এই আপ্তবাক্য মানুষ বিশ্বাস করেছেন।” তৃণমূল ঝড়ে সবচেয়ে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে আঞ্চলিক ঝাড়খণ্ডী দলগুলি। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ঝাড়গ্রাম মহকুমার ২৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত এবং ১টি পঞ্চায়েত সমিতি ঝাড়খণ্ডীরা দখল করেছিল। এবার সিপিএম ৩টি গ্রাম পঞ্চায়েত দখলে রাখতে পারলেও ঝাড়খণ্ডীরা একটিও গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করতে পারে নি। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা চুনিবালা হাঁসদার ঝাড়খণ্ড পার্টির (নরেন)। দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত নরেন হাঁসদার খাসতালুক বিনপুর-১ ব্লকের মাগুরাতেও হেরেছে চুনিবালার দল। বিনপুর-১ (লালগড়) পঞ্চায়েত সমিতির মাত্র একটি আসনে জিতেছে ঝাড়খণ্ড অনুশীলন পার্টি। ঝাড়খণ্ড অনুশীলন পার্টির নেতা অসিত খাটুয়ার বক্তব্য, “প্রতিটি এলাকায় তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা গিয়ে মানুষজনকে বুঝিয়েছেন, তৃণমূল ক্ষমতায় থাকলে জঙ্গলমহলে শান্তি থাকবে, উন্নয়ন হবে। মানুষ তাতে বিশ্বাস রেখেছে।” |
|
|
|
|
|