কোর্ট বলল কমিশন অবৈধ, আচমকা পাল্টা চাপে শ্রীনি
ব্বিশ ঘণ্টা আগে ছবিটা অ্যাডভান্টেজ শ্রীনিবাসন ছিল না! টেনিসের ভাষায় তার চেয়েও কয়েক ধাপ বেশি ছিল। শুক্রবার নয়াদিল্লির অ্যাডভান্টেজ কোর্ট থেকে নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন কার্যত সার্ভ করতেন গেম, সেট ও ম্যাচের জন্য!
মহেন্দ্র সিংহ ধোনিদের নাটকীয় ভাবে শেষ ওভারে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতার মতোই যেন বোর্ড প্রশাসকদের ম্যাচটাও আচম্বিতে ঘুরে গেল। ফের চেয়ারে বসে পড়তে উদ্যত শ্রীনি মঙ্গলবার পড়ে গেলেন অতর্কিত পাল্টা চাপে। আইপিএল গড়াপেটা বিতর্কে বোর্ডের তদন্ত কমিশনের বৈধতা নিয়ে বিহার ক্রিকেট সংস্থার যে জনস্বার্থ মামলা গত কয়েক দিন শুনানির জন্যই তোলেনি বম্বে হাইকোর্ট, ব্যক্তিগত আলোচনায় যে মামলা নিয়ে ভাববার কিছু নেই বলে কলকাতার সভা নিশ্চিন্ত হয়ে বসে ছিল, সেটাই কি না যাবতীয় অঙ্ক তছনছ করে দিল!
মুম্বইয়ের আদালতের ডিভিশন বেঞ্চ আচমকা এ দিন মামলায় রায় দিয়ে দিল। আর এত কড়া রায় দিল যে, বোর্ড কর্তারা একেবারেই তার জন্য তৈরি ছিলেন না। বোর্ডের আইনি মাথাদের এক জন এ দিন রাতে আনন্দবাজারকে বলছিলেন, “এখনও আমার বিস্ময় কাটছে না। আদালত প্রাক্তন দুই বিচারপতিকে নিয়ে গড়া তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট নস্যাৎ করে দিতে পারে, এই পর্যন্ত ঠিক আছে। বলতে পারে, এদের সুপারিশ কার্যকর কোরো না। সেটাও ঠিক আছে। কিন্তু একেবারে বিচারপতিদের নিয়োগটাকেই অসাংবিধানিক আখ্যা দেবে, সেটা ভাবাই যায়নি। অত্যন্ত কড়া রায়।”
ফিক্সিং কাণ্ডে নয়া ধাক্কা
বক্তা তাঁর নাম প্রকাশে এই মুহূর্তে ইচ্ছুক নন। কিন্তু মঙ্গলবার বোর্ড কর্তাদের প্রচুর ফোন তিনি পেয়েছেন। অনেকেই জানতে চান, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শ্রীনিবাসনের করণীয় কী? শ্রীনিবাসন নিজে স্টেপ আউট করার ভঙ্গিতে বলেছেন, “আমি দিল্লির ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে যোগ দেবই। কেউ আমাকে থামাতে পারবে না।” সংবাদসংস্থার প্রতিনিধি যখন পাল্টা জিজ্ঞেস করেন, এই পরিস্থিতিতে কী ভাবে যোগ দেবেন, তখন উত্তেজিত শ্রীনি বলেন, “মিটিংয়ে এসেই না হয় দেখবেন কী করে আমি ঢুকি।” শ্রীনির ঘনিষ্ঠ শিবিরও এই বিবৃতিতে কিছুটা আশ্চর্য।
এমন নাটকীয় দিন, যখন মুম্বই থেকে আদালতের রায়ে শ্রীনির সাজানো অঙ্ক তছনছ হয়ে যায়, আর দিল্লি পুলিশ ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সেই নাটকীয়তায় একপোঁচ রং চড়িয়ে দেয় তাদের ছ’হাজার পাতার চার্জশিটে। দিল্লি পুলিশ বলেছে, ভারতে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সঙ্গে দাউদ ইব্রাহিম এবং ছোটা শাকিল জড়িত। এঁরাই ভারতে ফিক্সিং ও বেটিং র্যাকেটের পাণ্ডা। মহাচাঞ্চল্যকর সেই চার্জশিটে রয়েছে ফোনে কথাবার্তা, ভয়েস স্যাম্পল রিপোর্ট, ফরেন্সিক রিপোর্ট এবং দোষ স্বীকার করে দেওয়া বিবৃতি। এই চার্জশিটের সুবাদে দশ বছরেরও পরে দাউদ ইব্রাহিম আবার ভারতীয় ক্রিকেট মহাকাশে ফিরে এলেন। শেষ তাঁর নাম যখন উঠেছিল যখন ভারতীয় দলে মহম্মদ আজহারউদ্দিন বলে কেউ খেলতেন। দাউদ ভারতে বরাবরই অসম্ভব স্পর্শকাতর ইস্যু। আর পাঁচটা দিন হলে বেটিংয়ে তাঁর জড়িয়ে থাকা, আইপিএলের মতো টুর্নামেন্টে দাউদ-চক্রের যখন-তখন ঢুকে পড়ার সুযোগ, ডাগআউটের কাছে যথেষ্ট নিরাপত্তাব্যবস্থা না রাখা এ সব নিয়ে আইপিএল তীব্র আক্রান্ত হত। দাবি উঠত আইপিএল বন্ধ করো। দেশ বাঁচাও!
অথচ মঙ্গলবার এতটাই ব্যতিক্রমী যে, সেখানে হেডলাইন দাউদেরও আগে শ্রীনিবাসন। ক্রিকেটমহলে দিনভর তীব্র জল্পনা চলল, আচমকা কোণঠাসা হয়ে পড়া তিনি এ বার কী করবেন? প্রাথমিক সমাধান সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে স্থগিতাদেশ নেওয়া। দ্বিতীয় সমাধান পুরো রায়ের জন্য অপেক্ষা করা। তার পর ঠিক করা, কী করব। দুপুরের দিকে এক রকম সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টেই যাওয়া ভাল। রাতের দিকে শ্রীনিকে কেউ কেউ বলেছেন, আর একটু আটঘাট বেঁধে আমাদের এগোনো উচিত। সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু শেষ স্টেশন।
কলকাতার বৈঠকে থাকা সদস্যদের কেউ কেউ সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অরুণ জেটলি সম্পর্কে উষ্মা প্রকাশ করছেন। ললিত মোদী এ দিন জেটলিকে তীব্র আক্রমণ করে বলেছেন, “জেটলি বিজেপির চরম ক্ষতি করছেন শ্রীনির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করে। শ্রীনির মতো অসৎ লোকের পেছনে উনি মাস্টার স্ট্র্যাটেজিস্ট হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। অবশ্য অসৎরা একসঙ্গেই থাকে।” বোর্ড সদস্যরা এতটা চরমপন্থী না হলেও অনেকেরই মনে হচ্ছে, কলকাতার বৈঠকে যখন কমিশনের রিপোর্টের ব্যাপারে জেটলির আইনি পরামর্শ নেওয়া হচ্ছিল, তখন তিনি বাস্তব ছবিটা দেখালেই পারতেন। জেটলি ব্যক্তিগত ভাবে একাধিক সদস্যকে বলেছেন, রিপোর্টের কিছু কিছু দুর্বল দিক আছে, যা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। কিন্তু কখনও জোর দিয়ে বলেননি, এটা গ্রহণ করলে বোর্ডকে ঝুঁকির মুখে দাঁড়াতে হবে।
বোর্ড সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার আগে শ্রীনি-নিযুক্ত কমিশন আরও নানান অসঙ্গতির মুখে পড়েছে। এ দিন প্রাক্তন বোর্ড সচিব সঞ্জয় জাগদালের পাঠানো একটি ই-মেল ফাঁস হয়ে গিয়েছে। যেখানে জাগদালে দাবি করেছেন, ‘আমার নাম করে বিচারপতি নিয়োগের বিবৃতি মিডিয়ায় দেওয়া হয়েছিল। অথচ আমি ব্যাপারটার কিছু জানতামই না। আমায় কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি।’ প্রাক্তন বোর্ড কোষাধ্যক্ষ অজয় শিরকেও বলেছেন যে, বিষয়টা তাঁদের সম্পূর্ণ অগোচরে রাখা হয়েছিল। এগুলো থেকে আরওই পরিষ্কার, নিজের জামাই ও ইন্ডিয়া সিমেন্টস সম্পর্কে তদন্তকারী কমিশনের পূর্ণ নিয়োগ করেছিলেন স্বয়ং বোর্ড প্রেসিডেন্টই। ন্যায়-ট্যায়ের তোয়াক্কা না করে। এমনও গুজব বোর্ড চত্বরে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে, এই দুই বিচারপতির এক জনের ছেলে ইন্ডিয়া সিমেন্টসে চাকরি করেন। বিহার ক্রিকেট সংস্থার সচিব তো এ দিন আনন্দবাজারকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে শ্রীনির বিরুদ্ধে তাঁকে উৎকোচ দিতে চাওয়ার চাঞ্চল্যকর অভিযোগও এনেছেন। হঠাৎই যেন শ্রীনির আকাশে চার দিকে কালো মেঘ।
অথচ চব্বিশ ঘণ্টা আগেও নীরব স্লোগান ছিল শ্রীনি আনো, বোর্ড বাঁচাও। সেই ভৃত্যসুলভ জাতীয় ক্রিকেট-কোরাস যে এমন বিহ্বলতায় বদলে যাবে, কে জানত! শ্রীনি যে অনমনীয় হয়ে দিল্লির বৈঠকে যাবেন বলছেন, সেটা শুনেও তাঁর ঘনিষ্ঠ কারও কারও মনে হচ্ছে, “হঠকারিতা আর অহেতুক মরিয়া মনোভাব হয়ে যাচ্ছে।” বম্বে হাইকোর্টের বিচারপতিরা যদি কমিশনের নিয়োগকেই অসাংবিধানিক আখ্যা দেন, তা হলে কার্যত যাঁর বিচার ওই কমিশনের করার কথা ছিল, সেই অভিযুক্ত কী করে বৈঠকে যোগ দিতে পারেন?
জগমোহন ডালমিয়াকে এ দিন জিজ্ঞেস করা হলে তিনি একই রকম বিহ্বলতার সঙ্গে জবাব দেন, “শ্রীনিবাসন নয়াদিল্লির বৈঠকে যাবেন কি না তিনিই বলতে পারবেন। আমার কোনও ধারণা নেই।” সিএবি-তে এ দিন ডালমিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে প্রত্যাবর্তনের আনন্দে ক্লাবগুলিকে কম্পিউটার বিতরণ করা হয়। সিএবি পৌঁছনোর আগে অবশ্য বারবেলাতেই ডালমিয়া জেনে যান, উপহার যে তাঁর জন্যও অপেক্ষা করে রয়েছে! বিহার ক্রিকেট সংস্থার এক সদস্য তাঁকে ফোনে বলেন, “দাদা, মিষ্টি খাওয়ান।” আদালতের আদেশ অন্তবর্তিকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডালমিয়ার মেয়াদ অবশ্যই বাড়িয়ে দিল। অনেকেই মনে করছেন, শ্রীনি যতই তোড় করুন, এই পরিস্থিতিতে সেপ্টেম্বরের আগে তাঁর ফিরে আসা আর সম্ভব নয়।
কারও কারও আবার নতুন নাটকীয় পরিস্থিতি দেখে বেশ মজাই লাগছে। ডালমিয়ার ভাগ্য পরিবর্তনে শরদ পওয়ারের সদর্থক ভূমিকার কথা ভেবে। অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ বোর্ড সদস্যের ধারণা, বিহার ক্রিকেট সংস্থার পিছনে চাণক্য হলেন পওয়ার। মাত্র বছর দেড়েক আগে বিশ্বকাপের ম্যাচ ইডেন থেকে নিয়ে গিয়ে যিনি ডালমিয়ার আজীবন ঘৃণ্য তালিকায় পড়েছিলেন। সেপ্টেম্বরে শ্রীনির পুনর্নিবাচন ঠেকাতে হলে পওয়ারই একমাত্র লোক। তা সে যতই তিনি ডালমিয়ার চক্ষুশূল হন!
কথায় বলে, রাজনীতি অকল্পনীয় সব শয্যাসঙ্গী তৈরি করে। ক্রিকেট রাজনীতিও কি ব্যতিক্রম?




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.