|
|
|
|
যন্ত্রণার এক মাস পূর্তি
পার্ক স্ট্রিটের মিউজিক ওয়ার্ল্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শোকের রেশ এখনও চলছে। লিখছেন অরিজিৎ চক্রবর্তী |
সময়ের ব্যবধান পাক্কা দশ বছর। শহর দু’টোর দূরত্বও সাড়ে তেরো হাজার কিলোমিটার।
তবু এই জুলাইতে কি কোথাও ক্যালিফোর্নিয়ার সঙ্গে মিলে গেল কলকাতা?
আইটিউনস্ মিউজিক স্টোর আসায় প্রমাদ গুনেছিল সংগীত জগত। টাকা দিয়ে এই স্টোর থেকে ডাউনলোড করা যায় গান-সিনেমা। ভয় ছিল গান ডাউনলোডের ঠেলায় তাঁদের ব্যবসাই না উঠে যায়। দল বেঁধে রেকর্ড লেবেলের মালিকেরা দেখা করতে গিয়েছিলেন স্টিভ জোবসের কাছে। আর এ মাসের প্রথম দিনটাতেই যে দরজা বন্ধ হয়ে গেল পার্ক স্ট্রিট মিউজিক ওয়ার্ল্ডের।
কিন্তু কলকাতার সংগীতপ্রেমীরা যাবেন কোথায়? নিজের জন্য হোক কী উপহার দেওয়া, পার্ক স্ট্রিট মিউজিক ওয়ার্ল্ড তো সত্যিই ‘ওয়ান স্টপ’। জেন ওয়াই না হয় আইটিউনস্-ফ্লিপকার্ট-অ্যামাজন থেকে কিনে নিল গান। কিন্তু আগের প্রজন্ম?
“আমি কী করে ডাউনলোড-টাউনলোড করব! আগে রেকর্ড ছিল, তার পর ক্যাসেট হয়ে এল সিডি। এ পর্যন্ত মানিয়ে নিয়েছিলাম। সিডির শারীরিক উপস্থিতি আমার চাই। শুধু শোনার জন্য না, লোককে উপহার দিতেও তো সিডি চাই। অবশ্য এখন সবই তো ভার্চুয়াল, বায়বীয়। সম্পর্কও বায়বীয় তো, গানই বা হবে না কেন?” রীতিমতো ক্ষুব্ধ সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য। |
|
কিন্তু জেন ওয়াই কি একমত? আশুতোষ কলেজের দেবাদৃতা রায় একদম একমত নন। বললেন, “সারা বিশ্বে এখন ডকু-ফিল্মের ট্রেন্ড। কিন্তু ডকু-ফিল্মের কোনও ডিভিডি পাওয়া যেত না মিউজিক ওয়ার্ল্ডে। বাধ্য হয়েই ফ্লিপকার্ট-অ্যামাজনের উপর ভরসা করতে হত। একটা সিডিতে হয়তো একটা বা দু’টো গান ভাল, তার জন্য গোটা সিডি কিনব কেন? শুধু সেই গানগুলো আইটিউনস্ থেকে কিনে নেব।”
কিন্তু ভার্চুয়াল স্টোর থেকে গান কেনায় একদম সায় নেই কবি ও গীতিকার শ্রীজাত-এর। “গান যেমন আইটিউনস থেকে ডাউনলোড করা যায়, বইও তো তেমনই কিন্ডেলে ডাউনলোড করে নেওয়া যায়। কিন্তু কে কিন্ডেলে বই পড়বে বলুন তো? বই পড়তে পড়তে বইয়ের গন্ধই তো মন ভাল করে দেয়। মিউজিক ওয়ার্ল্ডও তা-ই করত। ওই যে একের পর এক সাজানো সিডি। সেগুলো দেখেই তো মন ভাল হয়ে যায়। অনেক দিন এমন হয়েছে, মনটা ভাল নেই। সটান ঢুকে গেছি মিউজিক ওয়ার্ল্ডে। সিডি ঘাঁটতে ঘাঁটতে কখন জানি মন ভাল হয়ে গেছে,” স্পষ্ট শ্রীজাত।
নস্ট্যালজিয়াকেও তো বাদ দেওয়া যায় না। পার্ক স্ট্রিট মিউজিক ওয়ার্ল্ড তো শুধু সিডির দোকান নয়, একটা ল্যান্ডমার্কও বটে। সেটাই যে আর থাকল না। “সারা বিশ্বেই তো একে একে মিউজিক স্টোরগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নস্ট্যালজিয়া বাদ দিলে সংগীত শ্রোতাদের কাছে ফিজিক্যাল স্টোরের প্রয়োজনীয়তাও কিন্তু তেমন নেই। অনেক সময় আমি সাত-আটটা সিডির তালিকা দিয়ে এসেছি স্টোরগুলোতে। কোনও দিন সেগুলো পাইনি। আইটিউনস্ আসার পর দেখেছি এমন কোনও গান নেই যা ওখানে পাওয়া যায় না। আমি তা-ই নিজেকে দু’ভাগে ভাগ করে নিয়েছি, সংগ্রাহক আর শ্রোতা। প্রথম জনের জন্য সিডির দোকান মাস্ট। কিন্তু দ্বিতীয় লোকটার জন্য ফিজিক্যাল স্টোরের কোনও দরকার নেই,” বললেন রূপম ইসলাম। |
সিডির ক্রেতা থাকবেই। তাই যেন সিডি তৈরির ব্যাপারটা পুরোপুরি বন্ধ না হয়ে যায়
কোয়েল |
সিডির শারীরিক উপস্থিতি আমার চাই। লোককে উপহার দিতেও তো সিডি চাই
সুচিত্রা ভট্টাচার্য |
|
অন্য দিকে নায়িকা কোয়েল তো মিউজিক ওয়ার্ল্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা উঠতেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লেন। কত ছবির সিডি লঞ্চ করার জন্য তাঁকে যেতে হয়েছে ওই স্টোরে। সে সব এখন ইতিহাস। ব্যথিতভাবে বললেন, “আমার ছবির গানগুলো ইউ টিউবে শুনছি। কিন্তু সেটাই বড় কথা নয়। কত লোকের রুটিরুজি চলে যাবে সিডি তৈরি বন্ধ হলে। আমার বিশ্বাস সিডির ক্রেতা থাকবেই। তাই যেন সিডি তৈরির ব্যাপারটা পুরোপুরি বন্ধ না হয়ে যায়। মিউজিক কোম্পানিগুলো যেন এ নিয়ে ভাবেন।”
এক বিশিষ্ট সিডি নির্মাতা সংস্থার অধিকর্তা এসএফ করিম মিউজিক ওয়ার্ল্ড বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে হতাশ নন। জানালেন, “ফিজিকাল ফরম্যাটে সিডি বিক্রি তো কমেইছে। এখন গান শোনার নানা মাধ্যম হয়েছে। তবে তার মানে এই নয় যে আমরা সিডি তৈরি বন্ধ করে দেব।”
সত্যিই তো স্টিভ জোবসের কাছে ছুটে আসা রেকর্ড লেবেলের মালিকদের ভয়টা তো পুরোপুরি সত্যি হয়নি। দিব্যি টিকে আছে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু কে বলতে পারে, এখন যেমন আইটিউনসের জন্য ‘বোনাস ট্র্যাক’ থাকে, অদূর ভবিষ্যতে শুধু আইটিউনসের জন্যই অ্যালবাম তৈরি হবে না!
সংগ্রাহকদের তখন কষ্ট হবে, আর শ্রোতাদের শিখে নিতেই হবে গান ডাউনলোড করা। |
|
|
|
|
|