ফসল ফলিয়ে সারা বছর পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে দেশের আদিম জনজাতি টোটোরা। যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ায় আয় কমে এসেছে। প্রভাব পড়ছে টোটোদের সামাজিক রীতি ও পুজো পার্বণের। কাইজি অর্থাৎ পুরোহিত ডেকে কলসি ভরা মারুয়ার, হাঁড়িয়া মুরগি শুয়োর আরাধ্য ঈশ্বরকে উৎসর্গ করে সারকা বা সাদিংপা’র মত পুজো আজ প্রায় বিলুপ্তের পথে। ভুটান পাহাড়ের পাদদেশে বীরপাড়া-মাদারিহাট ব্লকের বাসিন্দা ভারতবর্ষের অন্যতম ক্ষুদ্র জনজাতি টোটো সমাজ তাদের প্রচলিত নানান আচার, অনুষ্ঠান বিলুপ্ত হতে বসায় অভাবকেই মূল দায়ী করছেন। টোটো সমাজের মোড়ল গাপ্পু সুগ্রীব টোটোর কথায়, “আমাদের সংস্কৃতি ও পুজোর আচারে অর্থনীতি প্রভাব ফেলেছে। তা নিয়েই উদ্বেগে রয়েছি। আর্থিক দুরবস্থার কারণে প্রচুর পরিবার সারকা বা সাদিংপা পুজো করতে পারছে না। এক একটি পুজোতে সব মিলিয়ে ৫-৬ হাজার টাকা খরচ। অনেকে পুজো করতে পারছেন না।”
১৯০১ সালে টোটোদের সংখ্যা ছিল ১৭১ জন। পরিবারের সংখ্যা সে সময় ছিল ৩৬। জমির পরিমাণ ছিল ১৯৯৩ একর। ১৯৮১ সালে টোটোর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০৬। পরিবার ১৩৫টি। মোড়ল ধনপতি টোটোর নামে টোটোপাড়ার সমস্ত জমি থাকায় সরকার ৩৪৭ একর জমি টোটোদের দিয়ে দেয়। বাকি জমি খাস ঘোষণা করে। জনসংখ্যার অনুপাতে জমির সংখ্যা সে সময়ে সামঞ্জস্য থাকাতে টোটোদের সে ভাবে দুরবস্থায় পড়তে হয়নি। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিবার বড় হতে থাকায়, ধীরে ধীরে জমি কমে আসতে থাকে। পরিসংখ্যান গত ২০০১ সালে টোটদের জনসংখ্যা ছিল ১১৭৫ জন। তাদের মোট পরিবার ছিল ২৩৮টি। এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪০২ জন ও পরিবার ভেঙে হয়েছে ৩১৯। কারও ভাগে পড়েছে ২ বিঘা বা কারও চার বিঘা জমি। পাহাড়ের গা ঘেঁষে থাকা ওই জমিতে মরুয়া বা ভুট্টা ছাড়া অন্য কিছু তেমন ভাবে চাষাবাদ করা সম্ভব হয় না। পরিবারে বাড়তি উপার্জনের জন্য বহু টোটো পাড়ি দিচ্ছেন ভুটান বা ভিন রাজ্যে দিন মজুরের কাজের সন্ধানে। টোটোপাড়ার অশোক টোটো বলেন, “অর্থনৈতিক কারণে পোশাক, আচার-অনুষ্ঠান সব কিছুর উপর এখন প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। যে ভাবে পরিবার ভাগ হয়ে, জমি ভাগ হচ্ছে, তাতে দারিদ্র বাড়ছে। আমাদের পূর্বপুরুষের নামে থাকা সব জমি যাতে সরকার ফিরিয়ে দেয় সে দাবি করেছি।” তবে এর মধ্যেও অবশ্য টোটোদের সর্বজনীন অংচু আর নয়ু পুজোকে টিকিয়ে রাখতে পেরেছে টোটো সমাজ। বছরের বিশেষ দুই দিনে মারুয়ার হাড়িয়া, প্রকৃতি ঈশ্বরকে অর্পণ করে সে পুজো আজও সমান ভাবে করে আসছে টোটো সমাজ। টোটো পুরোহিত বা কাইজি ইন্দ্রজিৎ টোটোর কথায়, “লোকজনের কাছে টাকা নেই। পরিবারে শান্তি বজায় রাখার জন্য অর্থ খরচ করে সে ভাবে কেউ বাড়িতে পুজো করায় না।” দরজে টোটোর ২ ছেলে, এক মেয়ে। দরজের কথায়, “আড়াই বিঘা জমিতে চাষ করে।এখন আর শুয়োর, মুরগি কিনে পুজো করার সামর্থ্য নেই।” |