প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রকাশ্য রাস্তায় একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রীকে গুলি করে খুন করল দুই দুষ্কৃতী। রবিবার সকালে জলপাইগুড়ির ফালাকাটা শহরের সুভাষ কলোনিতে এই ঘটনার পরে তাপস দাস ওরফে খুলু এবং গোপাল আচার্য নামে দুই অভিযুক্তকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। মৃত ছাত্রীর নাম নিকিতা দত্ত (১৭)। চোখের সামনে গোটা ঘটনা দেখে জ্ঞান হারায় দশম শ্রেণির আর এক ছাত্রী। তাকে ফালাকাটা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আলিপুরদুয়ারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আকাশ মেঘারিয়া বলেন, “অভিযুক্তেরা ওই ছাত্রীকে প্রায়ই উত্ত্যক্ত করত বলে জানা গিয়েছে। ধৃতদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগে মামলা করা হয়েছে।” নিকিতার এক প্রাক্তন গৃহশিক্ষককেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
মাস খানেক আগেই প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কোচবিহারের দিনহাটার বুড়িরহাটে নূপুর দাস নামে এক স্কুল ছাত্রীকে কুপিয়ে খুন করে পলাশ সেন নামে এক যুবক। সে সময় তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে পলাশ একটি স্কুলবাড়ির ছাদ থেকে পড়ে মারা যায়। গত মাসে নদিয়ার গেদে উত্তরপাড়াতেও প্রেমে প্রত্যাখ্যাত এক যুবকের বিরুদ্ধে সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ উঠেছিল। |
ফালাকাটায় নিহত ছাত্রী নিকিতা দত্তের শোকার্ত পরিজন। |
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, রবিবার সকাল পৌনে ১১টা নাগাদ গৃহশিক্ষকের কাছে পড়া শেষ করে নিকিতা একাই বাড়ি ফিরছিল। সে সময় গোপালের মোটরবাইকে চেপে তাপস এসে তার পথ আটকায়। নিকিতার হাত ধরে টানাটানিও শুরু করে সে। নিকিতা প্রতিবাদ করে। হইচই শুনে আশেপাশের মানুষজন এগিয়ে আসেন। তখন তাপস জামার ভিতর থেকে একটি দেশি আগ্নেয়াস্ত্র বার করে সবাইকে সরে যাওয়ার হুমকি দেয়। লোকজন পিছু হঠতেই তাপস আচমকা নিকিতার মাথায় আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে দেয়। নিকিতার কপালের ডান দিকে গুলি করা হয়েছে। মাথার পিছন দিয়ে গুলিটি বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায় নিকিতা। চোখের সামনে এমন ঘটনা দেখে স্থানীয়রা হতভম্ব হয়ে পড়েন। সেই ফাঁকে বাইকে চড়ে পালিয়ে যায় গোপাল ও তাপস। পরে ফালাকাটা থেকেই গোপালকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সূত্রের খবর, গোপালকে দিয়ে তাপসকে ফোন করানো হয়। সেই সূত্র ধরেই শিলিগুড়ির মহাবীরস্থান থেকে তাপসকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
পুলিশ জানিয়েছে, তাপস ও গোপালের বিরুদ্ধে নানা অসামাজিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তার মধ্যে তাপসের দাপট বেশি। একটি রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় সে এলাকায় দাপিয়ে বেড়াত বলে অভিযোগ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, নিকিতা খুনের সময় ওই রাস্তা দিয়েই পড়তে যাচ্ছিল স্থানীয় এক স্কুলছাত্রী। দশম শ্রেণির ওই মেয়েটি চোখের সামনে এমন ঘটনা দেখে অজ্ঞান হয়ে যায়। হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরে বিকেল পর্যন্ত সে কথা বলতে পারেনি বলে জানা গিয়েছে। ঘটনার পর থেকে গোটা এলাকা আতঙ্কিত হয়ে রয়েছে। |
তাপস দাস
|
গোপাল আচার্য
|
ছবি: রাজকুমার মোদক |
|
ঘটনাস্থলের ঠিক পাশেই বাড়ি পাখিরানি মিত্র ও দেবযানী দাসের। তাঁরা জানান, হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে একটা শব্দ। ঘর থেকে বেরিয়ে তাঁদের চোখে পড়ে নীল জিন্স ও গোলাপি টপ পরা পাড়ার মেয়ে নিকিতার দেহ রাস্তায় পড়ে রয়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চার দিক। স্থানীয়রা জানান, ঘটনাস্থলের কাছেই এসএসবি-র একটি শিবির রয়েছে। তার প্রহরীরা গুলির শব্দ শুনে ছুটে এলেও অভিযুক্তদের ধরতে পারেনি। পুলিশের অনুমান, বিহারের মুঙ্গের থেকে চোরাপথে আনানো ৭.৬৫ বোরের আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি করা হয়েছে।
দুই অভিযুক্ত এবং নিকিতা সকলেই সুভাষ কলোনির বাসিন্দা। নিকিতার বাবা কানু দত্তের পাটের সুতো তৈরির কারখানা রয়েছে। এক মাত্র সন্তানকে হারিয়ে তিনি বলেন, “আমি খুলুর ফাঁসি চাই।” নিকিতার মা শিবানী দত্তের কথায়, “মেয়েকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল খুলু।” কানু দত্ত জানান, বছর খানেক আগে এক গৃহশিক্ষকের কাছ নিকিতা পড়ত। তাঁর অভিযোগ, “তার কাছ থেকেই মেয়ের নম্বর জোগাড় করে খুলু। তার পরে গত এক মাস ধরে খুলু আমার মেয়েকে রাস্তাঘাটে, মোবাইলে বারবার উত্ত্যক্ত করছিল। তিন সপ্তাহ আগে জানতে পেরে আমি ওই মোবাইলটি নষ্ট করে ফেলি।” কানুবাবু জানান, তার পর থেকে তিনিই মেয়েকে সঙ্গে করে পড়তে নিয়ে যেতেন। এ দিন যেতে পারেননি। তাঁর কথায়, “সেই সুযোগেই খুলু আমার মেয়েকে খুন করেছে।” |
|
|
ঘটনাস্থল। |
ফালাকাটা থানায় বিক্ষোভ বাসিন্দাদের।—নিজস্ব চিত্র। |
|
নিকিতার গৃহশিক্ষক সুজিত চক্রবর্তীর কথায়, “পড়ানোর সময়েও ওকে স্বাভাবিকই দেখেছিলাম। এমন হাসিখুশি একটি মেয়েকে এই ভাবে খুন করা হবে, ভাবতেও পারছি না।” নিকিতার স্কুল ফালাকাটা গার্লস হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষিকা শিপ্রা দেব (সাহা রায়) বলেন, “ভাল ছাত্রী ছিল। দিনেদুপুরে তাকে এ ভাবে গুলি করে মেরে ফেলার ঘটনা মানতে পারছি না। দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি করছি।”
ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তে এলাকা জুড়ে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দেয়। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতৃত্বও। দুপুর দেড়টা থেকে টানা তিন ঘণ্টা ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করে রাখেন স্থানীয় বাসিন্দারা। |