কিশোর সাহা • শিলিগুড়ি
সব্যসাচী ঘোষ • গরুবাথান |
পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠন নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হতেই তেতে উঠল দার্জিলিং পাহাড়। রবিবার ফের গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিটিএ) ছাড়ার হুমকি দিলেন বিমল গুরুঙ্গ। যে হুমকিকে পাহাড়কে ফের অশান্ত করে তোলার চেষ্টা হিসেবেই দেখছে রাজ্য প্রশাসন। জোর করে জনজীবন বিপর্যস্ত করার চেষ্টা যে বরদাস্ত করা হবে না সেই বার্তা গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাকে দেওয়ার পাশাপাশি দার্জিলিং অশান্ত হয়ে উঠতে পারে এমন কোনও পদক্ষেপ না-করার জন্যও কেন্দ্রকে অনুরোধ জানিয়েছে মহাকরণ। |
গরুবাথানের সভায় বিমল গুরুঙ্গ। ছবি: দীপঙ্কর ঘটক। |
রাজনীতিক নেতাদের অনেকেরই মতে, পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য যদি গঠন হয়ে যায়, তা হলে ঘরে-বাইরে চাপের মুখে পড়বেন গুরুঙ্গ। সেই আশঙ্কা থেকেই এ দিন দার্জিলিং জেলার গরুবাথানে এক সমাবেশে ‘অন্তিম লড়াই’-এর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। সোমবার থেকে পাহাড়ের তিন মহকুমায় বনধে সামিল হওয়ার জন্যও সকলকে ডাক দেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সভাপতি তথা জিটিএ প্রধান। কেন্দ্র ও রাজ্যের নানা মহল থেকে বনধ প্রত্যাহারের অনুরোধ করা হলেও তাঁরা এখনই সাড়া দিতে রাজি নন বলেও জানিয়ে দেন গুরুঙ্গ। তাঁর কথায়, “আগে অনেক বার জিটিএ ছেড়ে দেব বলেছি। কিন্তু, কেন্দ্র ও রাজ্যের অনুরোধে পিছিয়েছি। তেলেঙ্গানা হলে আমরা গোর্খাল্যান্ড পাব না কেন? এ বার সত্যিই জিটিএ ছেড়ে দেব।” এর পরেই তাঁর হুঁশিয়ারি, “এটা গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে অন্তিম লড়াই। রাস্তায় নেমে বনধ করব। কারও যদি ট্রেন বা বিমানের টিকিট থাকে, পাহাড় ছেড়ে চলে যান। কোনও কিছুকেই ছাড় দেওয়ার প্রশ্ন নেই।” |
মোর্চার ডাকা বন্ধ ঘোষণার পর পাহাড়ে রসদ
মজুত রাখতে তৎপর হয়েছেন বাসিন্দারা।— নিজস্ব চিত্র। |
তবে মোর্চা জবরদস্তি বনধ করতে চাইলে তিনি যে কঠোর মনোভাব দেখাবেন, সে কথা এ দিনই পরিষ্কার করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “পাহাড়কে স্বাভাবিক করে উন্নয়ন শুরু হতেই নানা অপচেষ্টা শুরু
হয়েছে। আমি বাংলার মানুষ হিসেবে কখনও, কোনও দিন দার্জিলিংকে আলাদা হতে দেব না। দার্জিলিং আমাদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল, আছে ও থাকবে।” বনধ মোকাবিলায় স্থানীয় ভাবেও তৈরি থাকছে প্রশাসন। এ দিন বিকেলে দার্জিলিং রিচমন্ড হিলে সাংবাদিক সম্মেলন করে জেলাশাসক এবং এসপি জানিয়ে দেন, “সব সরকারি দফতর খোলা থাকবে। কোনও ছুটি মঞ্জুর হবে না। গরহাজির হলে মাইনে কাটা যাবে। পাহাড়ে অতিরিক্ত সশস্ত্র পুলিশ ও আইআরবি জওয়ান মোতায়েন করা হচ্ছে। ৩১-এ জাতীয় সড়কেও পুলিশ থাকবে।”
গুরুঙ্গের আশঙ্কা, আন্দোলন বন্ধ করতে পুলিশ লাঠি-গুলি চালাতে পারে। তাই পাহাড়ের গোর্খা পুলিশদের প্রতি তাঁর বার্তা, “আপনাদেরও ভাবার সময় এসে গিয়েছে। এটা আপনাদেরও মাতৃভূমি। আপনাদেরও পরিবার, পরিজন রয়েছে। তাঁদের জন্যও আলাদা রাজ্য হবে।”
এ দিনই অবশ্য জিটিএ-র মঞ্চ থেকেই গরুবাথানে একাধিক প্রকল্পের শিলান্যাস করেন গুরুঙ্গ। তার পরে সরকারি ব্যানার, ফেস্টুন খুলে সেখানে দলীয় পতাকা টাঙিয়ে জনসভা করে জিটিএ ছাড়ার হুমকি দেন তিনি। একই মঞ্চ থেকে জিটিএ-র প্রকল্পের শিলান্যাস ও পরে জিটিএ ছাড়ার হুমকি দেওয়া নিয়ে মোর্চার অন্দরে তো বটেই, পাহাড়ের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যেও শুরু হয়েছে নানা জল্পনা। অনেকেই বলছেন, রাজনৈতির বাধ্যবাধকতা থেকেই পৃথক রাজ্যের দাবি তুলছেন গুরুঙ্গ। আবার জিটিএ-ও পুরোপুরি ছাড়ছেন না।
মোর্চা সূত্রের খবর, পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠিত হলে দলের কট্টরপন্থীরা আলাদা সংগঠন গড়ে কিংবা জিএনএলএফে সামিল হয়ে নতুন করে আন্দোলনের হুমকি দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন মোর্চা নেতৃত্ব। অখিল ভারতীয় গোর্খা লিগ, জিএনএলএফের মতো দলগুলিও তখন গুরুঙ্গকে কোণঠাসা করতে চাইবে। আবার গুরুঙ্গরা যদি জিটিএ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন, তা হলে কেন্দ্র ও রাজ্যের বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। সে ক্ষেত্রে আগামী দিনে তাঁরা নয়াদিল্লি ও মহাকরণের কাছে গুরুত্ব হারাতে পারেন।
এ সমস্ত কিছুই মাথায় রাখতে হচ্ছে মোর্চা সভাপতিকে। তাই যে মঞ্চ থেকে কেন্দ্র ও রাজ্যের বরাদ্দ টাকা খরচের জন্য প্রকল্পের সূচনা করছেন, সেখানে দাঁড়িয়েই তাদের সমালোচনা করছেন। যেমন সরকারি অনুষ্ঠানে বলেছেন, “পাহাড়ে অনেক কাজ করতে হবে। তা আমরা শুরু করেছি। ধীরে ধীরে সব হবে।” ঘণ্টাখানেক পরে সেই মঞ্চ থেকে গুরুঙ্গকে বলতে শোনা গিয়েছে, “অনেক আশা নিয়ে জিটিএ হয়েছিল। কিন্তু কোনও কাজই হচ্ছে না।” রাজ্যকে দুষে বলেছেন, “জিটিএ-র প্রধান সচিবের জন্য আমাদের আদালতে যেতে হয়েছে। রাজ্য সরকার দফতর হস্তান্তর নিয়ে গড়িমসি করছে। এ ভাবে কাজ হয় না।” তার পরেই ঘোষণা, “কয়েক দিনের মধ্যে আমি পদত্যাগ করতে চলেছি।” এবং মুখ্যমন্ত্রীকে কটাক্ষ করে মন্তব্য, “সুইৎজারল্যান্ড বানাবেন বলেছিলেন। কিন্তু কিছুই হল না। গরু-ছাগলের খোঁয়াড়ও হয়নি।”
মহাকরণ সূত্রে খবর, পৃথক তেলেঙ্গানা গঠনের আশঙ্কা থেকে দার্জিলিঙে আবার কী ভাবে অশান্তি ছড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে, তা দিল্লিকে জানিয়েছে রাজ্য। সূত্রটি জানিয়েছে, দার্জিলিং ফের উত্তপ্ত হতে পারে এমন কোনও পদক্ষেপ যাতে না করা হয়, সেই বার্তাও কেন্দ্রকে দিয়েছে রাজ্য। কেন্দ্রের তরফে পরিস্থিতি নিয়ে খোঁজখবরও শুরু হয়েছে। অনুরোধ এসেছে অন্য মহল থেকেও। মোর্চা সূত্রের খবর, এ দিন গরুবাথানেই গুরুঙ্গের কাছে ফোন আসে তেলেঙ্গানার নেতা কে কেশব রাওয়ের। এক সময় কংগ্রেসে ছিলেন কেশব রাও। |