ভোর ৩টেয় ঘুম থেকে ওঠা। বাড়ির কাজ সেরে রওনা হতে হতে সাড়ে ৩টে। আধো-অন্ধকারে এবড়োখেবড়ো ৮ কিলোমিটার পেরিয়ে ঝাড়খণ্ডের পাথর খাদানে পৌঁছতে কম করে তিন ঘণ্টা কাবার। ভোর ৬টার আগে পৌঁছতে না পারলেই উপরি হিসেবে মেলে ম্যানেজারের গালি। বিকেল ৪টে পর্যন্ত ভারী পাথর বয়ে নিয়ে ক্রাশারে ফেলা। দিনশেষে ১২০-১৫০ টাকা নিয়ে একই পথ পেরিয়ে বাড়ি ফেরা। এটাই রুটিন শিবানী টুডুর।
পেশায় ক্রাশার-শ্রমিক, শিবানীদেবী নলহাটি থানার বানিওড় পঞ্চায়েতের লখনামারা গ্রামের বাসিন্দা। স্বামীকে হারিয়েছেন সাত বছর আগে। থাকেন দশ বাই ছ’ফুটের খড়-ছাওয়া মাটির ঘরে। সেই ঘরের মেঝেতেই ক্লান্তিতে পা ছড়িয়ে বসে ছিলেন পাঁচ সন্তানের মা, বছর পঁয়ত্রিশের শিবানীদেবী। কোনও রকমে মুখ তুলে বললেন, “আজ কাজে যেতে পারলাম না। রোজ দিন কি এত পরিশ্রম করে যাওয়া যায়। শরীর আর চলছে না।”
একা শিবানী টুডুই নন, এ ভাবেই বেঁচে থাকার লড়াই চালাচ্ছেন বীরভূমের নলহাটি পাথর শিল্পাঞ্চলের কয়েক হাজার খাদান-ক্রাশার শ্রমিক। মালিক-শ্রমিক বিরোধের জেরে প্রায় তিন মাস এলাকার সমস্ত খাদান ও ক্রাশার বন্ধ। জীবিকার সন্ধানে শিবানীর মতো আদিবাসী মহিলাদের একটা অংশ রোজ যাচ্ছেন লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের সুন্দরপাহাড়ি পাথর শিল্পাঞ্চলে। মহকুমা সহকারী শ্রম আধিকারিক (রামপুরহাট) অসিতবরণ রায় বলেন, “বহু বৈঠকেও সমস্যার সমাধান হয়নি। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে এলাকার প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত। তাঁদের মধ্যে একটা বড় অংশই মহিলা।” |
খাদান বন্ধ। নলহাটি থানার চন্দননগরে।— নিজস্ব চিত্র |
লখনামারার পার্বতী মারিয়া ছোট মেয়েকে মুর্শিদাবাদের আদিবাসী স্কুলের হস্টেলে রেখে পড়াচ্ছিলেন। কিন্তু এলাকায় কাজ হারানোর পরে রোজগার কমে গিয়েছে। পার্বতীর মেয়ে এখন বাড়িতে। “রোজ ঝাড়খণ্ড যেতে-আসতে এতটা সময় লাগে যে বাচ্চারা মায়েদের মুখ ভুলতে বসেছে”, বলছিলেন চন্দননগরের ধনবিটি হেমব্রম। ওই গ্রামেরই আনাতি সোরেন বলছেন, “পাথরের গুঁড়ো উড়ে দূষণে শরীরে কষ্ট বা পরিবেশ নষ্ট হলেও কিছু মনে করতাম না। কারণ, বাড়ি থেকে আধ কিমি হাঁটা পথে এলাকার ক্রাশারেই কাজ পেতাম। সুন্দরপাহাড়ি যাওয়ার মতো ধকল নিতে হত না।”
এই পাথর শিল্পাঞ্চলে পাথর বোঝাই শ্রমিকদের (কিনতে আসা গাড়িগুলিতে যাঁরা পাথর বোঝাই করেন) দু’টি সংগঠন শক্তিশালী। আইএনটিইউসি সংগঠনের সভাপতি জাকির হোসেন এবং টিউইসিসি সংগঠনের সম্পাদক আকবর শেখ জানালেন, মূল সমস্যা শিল্পাঞ্চলের পাথর বোঝাই করেন যে সব শ্রমিক, তাঁদের নিয়ে। দু’জনেই বলেন, “এলাকায় ১২০টি চালু ক্রাশার চাই। সেখানে দুই সংগঠন ভাগাভাগি করে ৭২০ জন পাথর বোঝাই করার শ্রমিককে নিয়োগ করবে। মালিকপক্ষের কাছে এটুকুই দাবি।” যদিও ওই শিল্পাঞ্চলের মালিক সংগঠনের সভাপতি আনন্দ যাদবের দাবি, “সংগঠনগুলি শ্রমিকদের ভুয়ো তালিকা দিয়ে টাকা কামাতে চাইছে। আমরা চাই প্রকৃত শ্রমিকেরাই কাজ করুন।” শ্রমিক সংগঠন দু’টির আবার পাল্টা অভিযোগ, মালিকপক্ষ যন্ত্র দিয়ে পাথর বোঝাই করে মুনাফা লুটতে চাইছে। তাই শ্রমিকেরা তাঁদের কাজ হারাচ্ছেন। তাঁদের সেই অভিযোগেরই প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছে এলাকার বিধায়ক, ফরওয়ার্ড ব্লকের দীপক চট্টোপাধ্যায়ের মুখেও। পক্ষান্তরে, এই অচলাবস্থার জন্য রাজ্য সরকারকেই দায়ী করেছে বিজেপি। দলের নলহাটি ১ ব্লকের সভাপতি অনিল সিংহের দাবি, জট মেটানোর জন্য বারবার প্রশাসনকে স্মারকলিপি দিলেও ফল মেলেনি।
মহকুমাশাসক (রামপুরহাট) রত্বেশ্বর রায় অবশ্য বলেন, “শুরু থেকেই আমরা সমস্যা মেটাতে তৎপর। একাধিক বার দু’পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসেছি। কিন্তু দু’পক্ষই নিজেদের দাবিতে অনড়।”
এই অবস্থায় ক্রমশ ক্ষোভ দানা বাঁধছে চন্দননগর, পাশিনালা-ছিলিমপুর, কালীপুর, লখনামারা, নামো গোবরাজলি, বাহাদুরপুরের আদিবাসীদের একটা বড় অংশের মধ্যে। সিপিএমের নলহাটি জোনাল কমিটির সম্পাদক সনৎ প্রামাণিকের কথায়, “পরিস্থিতি দিন-দিন খারাপ হচ্ছে।” এলাকায় কাজ হারানো আদিবাসী পুরুষ-মহিলারা বলছেন, “নলহাটিতেই কাজ চাই। মালিক আর পাথর বোঝাই করা শ্রমিকেরা ঝামেলা মিটিয়ে এলাকার খাদান-ক্রাশার চালু না করলে অবস্থা কিন্তু হাতের বাইরে চলে যেতে পারে।”
|