লাহৌরের নির্বাচনী জনসভায় মঞ্চ থেকে পড়ে যাওয়ায় প্রাণটা বেঁচেছিল। নইলে হয়তো জঙ্গির বুলেটের নিশানা হতে হতো তাঁকে। একটি ব্রিটিশ দৈনিকে তেমন দাবিই করেছেন পাকিস্তানের প্রাক্তন ক্রিকেটার এবং তেহরিক ই ইনসাফের নেতা ইমরান খান।
পাকিস্তানের ২৫টি জঙ্গি গোষ্ঠীর কোনওটিকে ভাড়া করে বিরোধী দলগুলো তাঁকে মারার ষড়যন্ত্র
করেছিল বলে ওই দৈনিকে জানিয়েছেন ইমরান খান। এর মধ্যে রয়েছে তালিবানও। তাঁর কথায়, “বিরোধী দলগুলো মনে করে, বিদেশিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাকিস্তান দখলের ছকে সামিল আছি আমিও। অথচ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই এবং মার্কিন ড্রোন হামলার বিরুদ্ধে আমি যথেষ্ট সরব। সেই অবস্থান বিচার করলে এটা একটা মারাত্মক অভিযোগ।” |
সে দিন দুর্ঘটনার পরে হাসপাতালের পথে ইমরান খান। —ফাইল চিত্র। |
কিন্তু ইমরান খান এবং তাঁর দল তেহরিক ই ইনসাফের প্রতি তালিবানের মতো জঙ্গি গোষ্ঠী নরমভাবাপন্ন বলেই মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের। যে কারণে পাকিস্তানের ভোটের আগে নির্বিঘ্নে প্রচার চালাতে পেরেছিল তেহরিক ই ইনসাফ। তালিবানের চোখে ইমরান ড্রোন হামলার বিরোধী এবং ইসলামপন্থী। তাই তাঁর দল এবং পিএমএলএন প্রচারের ছাড়পত্র পেয়েছিল। ইমরান নিজেও তালিবানের সঙ্গে শান্তি-আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন বেশ কয়েক বার। অথচ এখন সেই তিনিই কেন তালিবানের দিকে আঙুল তুলছেন, উঠছে সেই প্রশ্ন।
নির্বাচনী প্রচার চালানোর সময় কোনও এক দিন তাঁকে মেরে
ফেলার পরিকল্পনা হয়েছিল বলে জানাচ্ছেন ইমরান। সম্ভাব্য হামলার হাত থেকে ইমরান বেঁচে গিয়েছেন, কারণ প্রচার পর্বের বাকি পুরোটা
সময়ই তিনি হাসপাতালে ছিলেন। মে মাসের ৭ তারিখ লাহৌরের জনসভায় পড়ে যান তিনি। তার পরের দিন পুরনো গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে লাহৌর থেকে ইসলামাবাদের পথে তাঁর ১৩টি সভা ছিল। ইমরানের দাবি অনুযায়ী, সব সভায় প্রচুর লোক হচ্ছিল। তাঁকে ঘিরে ধরছিল জনতা। এত মানুষ নিয়ন্ত্রণের কৌশল তাঁর দলের সদস্যদের জানা ছিল না। রাজনৈতিক সভা শুরুর আগে প্রশাসনের তরফে নাকি ইমরানকে জানানো হয়েছিল, তাঁর জীবনসংশয় হতে পারে। তাই কড়া পুলিশি প্রহরা ছিল।
“২৪ ফুট উঁচু একটি ছোট প্ল্যাটফর্ম থেকে বক্তৃতা দিতে বলা হয়েছিল আমায়। বিস্ফোরণ থেকে রক্ষা পাওয়ার একটা চেষ্টা মাত্র। তা ছাড়া উৎসাহী যুবকরা যাতে মঞ্চে উঠে না পড়েন, তার জন্যও ওই ব্যবস্থা ছিল। মঞ্চে ওঠার কোনও সিঁড়ি ছিল না। ফর্কলিফট একটি ট্রাকে আমায় ওই প্ল্যাটফর্মে তোলা হচ্ছিল। আর তখনই মৃত্যুর সঙ্গে মোলাকাত হয়েছিল আমার,” বলছেন ইমরান।
ফর্কলিফটে তাঁকে তোলার সময় বার বার সেটা কাঁপছিল। আর ইমরানকে ঘিরে রেখেছিলেন তাঁর নিরাপত্তায় থাকা কর্মীরা। যার ফলে ইমরান প্ল্যাটফর্ম ঘিরে থাকা বেষ্টনী দেখতে পাচ্ছিলেন না। তিনি বলছেন, “এই সময়ই হঠাৎ ভারসাম্য হারিয়ে ঝুঁকে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম সামনেই ওই বেষ্টনীতে আটকে যাব। কিন্তু আরও নীচের দিকে তলিয়ে গেলাম। পিঠে ধাক্কা খেয়ে ১৮ ফুট নিচু কোথাও একটা পড়লাম। তার পর সোজা হাসপাতালে।” ফুসফুসে ক্ষত, শিরদাঁড়ায় এবং মস্তিষ্কে বড় রকমের আঘাত সত্ত্বেও বেঁচে যান তিনি। ইমরানের মন্তব্য: “হাসপাতালে পাক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে দেখতে এসে বলেছিলেন, ৭ মে-র নির্বাচনী প্রচারের পরের দিন আমাকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল জঙ্গিদের।” যা শুনে বেশ হতাশ হয়ে পড়েন তেহরিক নেতা। এক দিকে, তাঁকে গ্রাস করছিল পঙ্গু হয়ে পড়ার ভয়। অন্য দিকে, নির্বাচনের প্রায় দোড়গোড়ায় এসেও জনসভায় যোগ দিতে না পারার ব্যর্থতা।
ইমরান মনে করেন, তাঁরা পাকিস্তানের জনতার মন ছুঁতে পেরেছিলেন। দেশের অন্য রাজনৈতিক দলগুলো এমন সব প্রার্থী দেয়,
যাদের বেশির ভাগই ধনকুবের। রাজনীতিতে তারা আসে টাকা কামাতে। মানুষের জীবন পাল্টাতে নয়। এরা ঘন ঘন দলও পাল্টায়। “পাকিস্তানে কোনও দিন সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে না। কারণ এখানে এমপি-রা নিজেদের বেচে দিয়েছেন। প্রার্থীভিত্তিক রাজনীতি ভুলতে হবে আমাদের।” পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে তেহরিক ই ইনসাফই একমাত্র দল যারা
অন্তর্বর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে প্রার্থী বাছাই করেছিলেন বলে দাবি ইমরানের। কিন্তু প্রচার যখন তুঙ্গে, তখনই তিনি হাসপাতালে।
ইমরানের মতে, “পাকিস্তানের অগ্রগতিতে মূল বাধা সন্ত্রাস। যাঁরা এই দেশটাকে দশ বছর আগেও চিনতেন, তাঁরা দেখলে বুঝবেন হিংসা এবং সন্ত্রাসের মাত্রা কতটা ভয়ঙ্কর ভাবে বেড়ে গিয়েছে। জঙ্গিনিধনের চেষ্টা করলেই মনে করা হয়, সরকার এবং সেনা মার্কিন নীতির দাস। তাই বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশে (যেখানে পরে সরকার গড়েছে তেহরিক ই ইনসাফ) ড্রোন হামলা হলেই প্রতিশোধ নিতে বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। তাতে শুধু বাড়ে মৃত্যু।”
তা-ও আশা রাখছেন প্রাক্তন এই ক্রিকেট-তারকা। ন্যাটো জেনারেল নিক কার্টারের কথায় ভরসা পেয়েছেন তিনি। কার্টারের বক্তব্য, তালিবানের সঙ্গে আরও দশ বছর আগে আলোচনায় বসা উচিত ছিল। ইমরানের কথায়, “বহু দিন ধরে এই কথাটাই বলছি আমি। সন্ত্রাস-সঙ্কট থেকে বাঁচতে রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন। না হলে পাকিস্তান পুনর্নির্মাণ সম্ভব নয়।” |