ছুতো পেলেই হেনস্থা করে সিভিক পুলিশ, ক্ষুব্ধ শহরবাসী |
অসন্তোষ আগে থেকেই ছিল। অহেতুক রাস্তা আটকানো, তল্লাশির নামে হেনস্থা, গালিগালাজ করার অভিযোগও উঠছিল। বৃহস্পতিবার রাতে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার এক কর্মী ও তাঁর দুই সঙ্গীকে আটকে টাকা চাওয়ার অভিযোগের পরে সিভিক পুলিশের ‘দুর্বব্যহার’ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন দুর্গাপুর ও আশপাশের এলাকার অনেকেই। পুলিশ কমিশনার অজয় নন্দ জানিয়েছেন, দোষ করলে কেউ ছাড়া পাবে না। পরিস্থিতির দিকে কড়া নজর রাখা হচ্ছে বলেও আশ্বাস তাঁর।
২০১১ সালের ১ সেপ্টেম্বর আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেট চালু হয়। তার পরেই দুর্ঘটনাপ্রবণ এই এলাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা ঢেলে সাজার কাজ শুরু করে পুলিশ। ২০১২-এর ১ জানুয়ারি পৃথক ট্রাফিক পরিকাঠামো কাজ শুরু করে। এক হাজার সিভিক পুলিশ নিয়োগ করা হয়। তাঁদের প্রায় অর্ধেক থানার নানা কাজে যুক্ত। বাকিরা ট্রাফিক সামলানোর কাজ করেন। আর তা করতে গিয়ে অনেক সময়ে কেউ কেউ ‘বাড়াবাড়ি’ করেন বলে অভিযোগ।
সিভিক পুলিশের বিরুদ্ধে প্রথম বড় অভিযোগ ওঠে ২০১২ সালের ১ সেপ্টেম্বর। সেই বিকেলে সেপকো এলাকায় কাজ শেষে মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা তিন নির্মাণকর্মী ভারতী রোডে বেড়াতে যান। সন্ধ্যায় তাঁরা বিদ্যাপতি রোড ও জয়দেব রোডের বিপরীতে জঙ্গলের পাশে রাস্তা দিয়ে ফিরছিলেন তখন পুলিশ তাঁদের দুষ্কৃতী সন্দেহে তাড়া করে। ভয়ে তাঁরা দৌড়তে শুরু করেন। উত্তম মাল (৩৩) নামে এক জন ধরা পড়ে যান। পেশায় রাজমিস্ত্রী সানোয়ার শেখ পুলিশে অভিযোগ করেন, রাত ১০টা নাগাদ তাঁরা জানতে পারেন, উত্তমবাবুকে গুরুতর জখম অবস্থায় দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ভোরে পুলিশ গাড়ি ভাড়া করে উত্তমবাবুকে বহরমপুর হাসপাতালে পাঠালে ৩ সেপ্টেম্বর সকালে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়। পুলিশের মারে উত্তমবাবু মারা গিয়েছেন, এই অভিযোগ তুলে এবং দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে সেপকো এলাকার বাসিন্দারা দুর্গাপুর থানার সামনে দেহ রেখে দিনভর বিক্ষোভ করেন। মৃতের পরিবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনেও অভিযোগ জানায়। সম্প্রতি কমিশনের নির্দেশে সেই অভিযোগের ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্তও শুরু করেছেন দুর্গাপুরের এসিজেএম কাজি আবুল হাসেম। সেই ঘটনায় অভিযুক্ত ছিলেন দুই সিভিক পুলিশ কর্মী রাহুলকুমার বড়ুয়া এবং লম্বোদর মাহাতো। |
কমর্রত সিভিক পুলিশ।—নিজস্ব চিত্র। |
গত ১৮ জুলাই বেনাচিতি বাজারে গাড়ি পরীক্ষার নামে মোটরবাইক আরোহীদের হেনস্থার অভিযোগ ওঠে এক পুলিশ আধিকারিক ও তাঁর সঙ্গী সিভিক পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে। বাঁকুড়ার গঙ্গাজলঘাঁটির বাসিন্দা জয়ন্ত ঘোষ ও সঞ্জীব ঘোষ অভিযোগ করেন, মোটরবাইকে চড়ে যাওয়ার সময়ে পুলিশ তাঁদের পথ আটকে কাগজপত্র দেখতে চায়। সেই সময়ে দুই সিভিক পুলিশকর্মী অভদ্র ভাবে কথা বলতে শুরু করে। প্রতিবাদ করলে মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। সেই সময়ে লালন সিংহ নামে এক পুলিশ আধিকারিক তাঁকে চড় মারেন এবং সিভিক পুলিশকর্মীরা গালিগালাজ করেন বলে অভিযোগ জয়ন্তবাবুর। আশপাশ থেকে ব্যবসায়ীরা বেরিয়ে আসেন। তাঁদের অভিযোগ, একে ঘিঞ্জি বাজার। রাস্তায় যানজট লেগেই থাকে। তার উপরে বাজারের রাস্তায় গাড়ি পরীক্ষার নামে হেনস্থা ও মারধরের ঘটনায় সমস্যা আরও বাড়ছে। প্রতিবাদে প্রথমে নাচন রোডে ও পরে স্থানীয় ফাঁড়িতে বিক্ষোভ দেখান ব্যবসায়ীরা।
বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ মৌলানা আজাদ রোডে একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী চন্দন দে ও তাঁর দুই সঙ্গী মোটরবাইকে চড়ে রঘুনাথপুর যাচ্ছিলেন। পুলিশের কাছে তাঁরা অভিযোগ করেন, দুই মোটরবাইক আরোহী যুবক সিভিক পুলিশ পরিচয় দিয়ে আই সেক্টরের কাছে তাঁদের পথ আটকে টাকা চায়। দিতে অস্বীকার করায় চন্দনকে পাশের নর্দমায় ফেলে মারধর করা হয়। বাধা দিতে গিয়ে তাঁর দুই সঙ্গীও প্রহৃত হন। চন্দনকে দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। শুক্রবার রাতে অভিযোগ পেয়ে পুলিশ দুই সিভিক পুলিশকর্মী অমিত ঘুঘু ও বিজয় পালকে গ্রেফতার করে। শনিবার আদালতে তারা জামিন পায়।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সিভিক পুলিশকর্মীদের এ হেন আচরণের শিকার শহরের অনেকেই। সকলে পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের না করতে চাওয়ায় সেগুলি জানাজানি হয় না। দুর্গাপুরের রায়ডাঙার বাসিন্দা, জামুড়িয়ার একটি স্কুলের শিক্ষক সাধন পানের কথায়, “মোটরবাইকে চড়ে যাতায়াত করি। গাড়ি পরীক্ষার নামে পুলিশ দাঁড় করায়। পরপর কাগজপত্র বের করার সময়ে একটু এ দিক-ও দিক হলেই সিভিক পুলিশকর্মীরা গালিগালাজ শুরু করে দেয়। ডিভিসি মোড়ের কাছে এক দিন এক সিভিক পুলিশকর্মী আমার গায়ে হাতও তোলে।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটি সেন্টারের এক শপিং মলের কর্মীরও অভিযোগ, “এ জোনের বাড়ি থেকে যাতায়াতের সময়ে কাগজপত্র পরীক্ষার নামে মাঝে-মধ্যে সিভিক পুলিশ আটকায়। কোনও খুঁত না পেলেই অসম্মানজনক কথাবার্তা শুরু করে।” অনেক সময়ে গাড়ি আটকে সিভিক পুলিশকর্মীদের একাংশ টাকা চান বলেও অনেকের অভিযোগ।
সিভিক পুলিশের একাংশের এমন আচরণ নিয়ে যে পুলিশ উদ্বিগ্ন, তা কার্যত স্বীকার করে নেন পুলিশ কমিশনার অজয় নন্দ। তিনি জানান, মানুষকে অহেতুক হেনস্থা করলে কেউ পার পাবে না। তিনি বলেন, “কিছু সিভিক পুলিশকর্মীর কাজকর্ম নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। তাদের উপরে কড়া নজর রাখা হচ্ছে।” কিছু কর্মীর এমন আচরণ নিয়ে বিরক্ত সিভিক পুলিশের একাংশই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েক জন সিভিক পুলিশকর্মী বলেন, “সম্মানের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু কয়েক জনের খারাপ মানসিকতার জন্য মানুষ আমাদের ভুল বুঝছেন।” |