শ্রোতারাই ‘হিট গাঙ্গুলি’ বানিয়েছেন

অরিজিৎ সিংহকে হাইজ্যাক করেই নিলেন?
কেন বলছেন বলুন তো!

এত দিন বাংলায় তো তিনি ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত ক্লাবের সদস্য ছিলেন। ‘বস’য়ের মিউজিক করতে গিয়ে নিজের দলে টেনে নিলেন।
হা হা হা। অনেক দিন থেকেই অরিজিৎকে নিয়ে বাংলায় কাজ করার ইচ্ছে ছিল। ‘বস’য়ের মিউজিক করার কথা হয় ‘আশিকি ২’য়ের মিক্সিংয়ের সময়। সেটা প্রায় এক বছর আগের কথা। মিক্সিংয়ের মাঝেই জিৎ আমাকে ফোন করে বলে, জিৎবাবু আমার প্রোডাকশনের একটা ছবি হচ্ছে। তোমাকে ওটায় সুর দিতে হবে। ফোনটা পেয়ে আমার খুব ভাল লেগেছিল। আমার প্রথম ছবি ‘প্রেমী’তে তো জিৎই হিরো ছিল। ‘মন মাঝি রে’ গানটার টিউন তৈরি করে অরিজিৎকে শুনিয়েছিলাম। ও শুনেই বলল, জিৎদা এটা আমি গাইব। তখন ওকে বললাম, এটা তোর জন্যই ভেবেছি।

সেটা যে সফল, তা তো আর বলে দিতে হবে না। ইউটিউবে প্রায় আড়াই লাখ হিটস্...
গানটা যে হিট হবে, তখনই জানতাম। অরিজিৎ অনেক ধরনের গান গাইলেও সুফি রক কখনও গায়নি। এক্সপেরিমেন্ট লোকে সব সময় পছন্দ করেন। সফ্ট মেলোডি শুনে শুনে কোথাও হয়তো স্যাচুরেশন পয়েন্টে এসে গিয়েছিল। সেটা থেকে হয়তো বেরোতেও চাইত অরিজিৎ। মনে আছে রাত দু’টোর সময় রেকর্ডিং করেছিলাম গানটার।

যতই এক্সপেরিমেন্টের কথা বলুন। অনেকে কিন্তু অন্য কথা বলছে।
কী বলছে লোকে?

বলছে বাংলাতে এত এক্সপেরিমেন্টাল ছবি হচ্ছে। গান হচ্ছে। কিন্তু সেখানে আপনাকে তো পাওয়া যাচ্ছে না। আপনার নিজের কখনও মনে হয় না, ‘২২শে শ্রাবণ’ বা ‘জাতিস্মর’য়ের সুর দিতে তো আমায় ডাকল না?
হ্যাঁ, অবশ্যই মনে হয়। কেন মনে হবে না! আমি তো এই এক্সপেরিমেন্টাল ছবিগুলোতেও সুর দিতে চাই। একেবারে যে করিনি, তা-ও তো না। ‘একলা আকাশ’ করেছি। বুম্বাদা (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) ‘বাপি বাড়ি যা’য়ের আগে ফোন করে বলেছিল, আমি অন্য রকম জিৎকে চাই। আমি দিতে কসুর করিনি। গানগুলোই তার প্রমাণ। সৃজিত (মুখোপাধ্যায়)-এর সঙ্গেও আমার অনেক দিনের আলাপ। ‘জোশ’য়ের ‘অচেনা শহর’ গানটার কথা তো ওরই লেখা। আমি ওপেন মাইন্ডেড। জানি না কেন ওর ছবিতে আমাকে ডাকে না।

‘বস’: জিৎ-শুভশ্রী
নিজে কখনও বলেছেন সে কথা...
না বলিনি। কেনই বা বলব? এটা ওর কল। আমার কাছে আমার গান যেমন সন্তানতুল্য। কোন গানটা কাকে দিয়ে গাওয়াব সেটা আমার সিদ্ধান্ত। ছবির ক্ষেত্রেও তাই। পরিচালক কাকে দিয়ে সুর করাবেন, সেটা পুরোপুরি তাঁর ওপর নির্ভর করে। আমি আগ বাড়িয়ে বলব না। এটাকে যদি ক্ষোভ বলেন, তো তাই। (হেসে) দেখি যদি এই ইন্টারভিউটা পড়ে যদি সৃজিত, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় বা কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় ফোন করেন।

আপনার সুর করা গানে সবই আপনার সিদ্ধান্ত। তাই কি নতুন মুখ?
কে বলল আপনাকে? যে গানে নচিদাকে দরকার হবে, আমার সেই গান নচিদাই গাইবে। আর যে গানে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস লাগবে সেখানে আনকোরা নতুন মুখ আনব। মিকার গলাকে যেখানে দরকার সেখানে মিকাকে দিয়ে গাইয়েছি। কিন্তু পুরাতনী মোহে পড়ে গানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না। গানের ফিল, গানের টেক্সচার বুঝে গায়ক নির্বাচন করব। বয়েস সেখানে বিবেচ্য হবে না।

আপনার ফ্যানদের বয়সও তো অল্প। নাইট ক্লাবে আজ বাংলা গান বাজছে। জেন ওয়াই-য়ের আইপড ভরা বাংলা সিনেমার গানে। এটা তো জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের অবদান। মানেন?
হ্যাঁ, জানি। অবদান তো একটা আছেই। তবে জার্নিটা কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না। অবশ্য স্ট্রাগলটা তো সবাইকেই করতে হয়। ২০০৪-এ শ্রীকান্তদা যখন আমাকে বাংলা ছবির মিউজিক দেওয়ার জন্য বলেন, তখন ইন্ডাস্ট্রিতে বাংলা ছবি নিয়ে এমন পজিটিভ মনোভাব ছিল না। বাংলা সিনেমার গানই তো লোকে শুনত না! কিন্তু শ্রীকান্ত (মোহতা)-দা, মণি (মহেন্দ্র সোনি)-দা, রানে (নিসপাল সিংহ রানে)— সবাই মিলে আমাকে যে উৎসাহটা দিয়েছেন সেই সময়, তাতে একদিনের জন্যও অনুপ্রেরণা হারিয়ে ফেলিনি। আজ তার ফল সবাই পাচ্ছি। এই যে নাইট ক্লাবে ‘ভজ গৌরাঙ্গ’ বাজছে, সেটা তো ভালই লাগে। ভিতরে ভিতরে বেশ গর্ব অনুভব করি। আজ হিন্দি ছবিতেও মিউজিক দিচ্ছি। কিন্তু সব কিছুর জন্যই ধন্যবাদ দেব আমার শ্রোতাবন্ধুদের।

আপনার হাতে মাইকই সব সময় দেখেছি, ‘হিট গাঙ্গুলি’ যে এত ‘অমায়িক’ সেটা তো জানতাম না।
হা হা হা

আপনি তো আর গানকে শুধু শোনার মধ্যে রাখলেন না। সেটাকে পারফর্ম্যান্সের পর্যায়ে নিয়ে গেলেন।
আমি পারফর্ম্যান্সে বিশ্বাসী। (হেসে) জানেন, প্রথম বার স্টেজে তবলা বাজিয়ে ক্যাডবেরি পেয়েছিলাম। তখন আমার বয়স পাঁচ কি ছয়। তবলাটাও ঠিক মতো হাতে পেতাম না। মা গান গাইছিলেন আর বাবা অ্যাকর্ডিয়ান বাজাচ্ছিলেন। স্টেজ পারফর্ম্যান্সের সেই লোভ আর ছাড়তে পারেনি। হা হা হা। আসলে স্টেজে গান গাইতে আমার ভালই লাগে। বাচ্চাদের স্টেজে উঠে আসা। আমার তো তবু দেখে গাইতে হয়। কিন্তু ওদের সব গান মুখস্থ। গোমড়া মুখো জেঠুকে ‘ঢাকের তালে’তে কোমর দোলাতে দেখার আনন্দ ছবির সংগীত পরিচালক হওয়ার আনন্দের থেকে একটুও কম লাগে না আমার।

এ প্রসঙ্গে, আপনার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ আছে। আপনি নিজের সুর দেওয়া গানের অনেক ক’টাই নিজের জন্য রেখে দেন ফাংশনে গাইবেন বলে?
ক’টা আর নিজের জন্য রাখি! ‘বস’য়েরও তো মাত্র একটা গানই নিজে গেয়েছি। আর শো-তে তো আমি শুধু নিজের গাওয়া গান গাই না! অন্য গায়কদের গাওয়া গানও গাই। আর গাইব নাই বা কেন! ওই গানগুলোর সুরকার তো আমি। আমার গাইতে অসুবিধে কোথায়? সলিল চৌধুরী গাইতেন, পঞ্চম (রাহুল দেব বর্মন)-দা গাইতেন। আমি গাইলেই অপরাধ!

পুরনো দিনের কথাই যখন তুললেন। একটা প্রশ্ন করি, আগেকার দিনে সুরকাররা স্টার গায়ক-গায়িকা তৈরি করতেন। আপনি এখন দেশের একজন বিশিষ্ট সুরকার। আপনার হাতে কোনও গায়ক বা গায়িকা স্টার হল না তো?
এই অভিযোগটা মানতে পারলাম না। আমার ছবিতে যারা যারা গান গেয়েছে, তারা সবাই কিন্তু আজ প্রতিষ্ঠিত।

এটা তো মানবেন যে, বড় বাজেটের বাংলা গানে আপনি অপরিহার্য। কিন্তু এত দিন মুম্বইয়ে থেকেও বলিউডে সেই জায়গাটা করতে পারলেন না? প্রীতমের জন্য ছেড়ে রাখলেন?
(একটু ভেবে) কথাটা হয়তো ক্লিশে শোনাবে। তবুও বলব, আমি র্যাট রেসে নেই। কেউ বলিউডে ভাল ছবিতে কাজ করা মানে তো এটা নয় যে, আমি খারাপ ছবিতে মিউজিক দিচ্ছি। আমি কখনও মনে করি না, বিগ বাজেটের ছবির মিউজিক করলাম মানেই আমার জীবন ধন্য হয়ে গেল। বা বড় স্টার কাস্ট থাকা মানেই সেটা বড় ছবি। আমি তো ‘শিরিন ফারহাদ কি তো নিকল পড়ি’ করেছি, ‘ব্লাড মানি’ করেছি, ‘রাজ থ্রি’ করেছি, ‘আশিকি টু’ করেছি। আমার কাছের লোকেরা আমাকে প্রশ্ন করে, আমি কোথায় কাজ করে বেশি আনন্দ পাই? বলিউড না টলিউড? আমি তাদের বলি, হাততালির শব্দ সব জায়গায়ই এক কিন্তু বাংলার হাততালিতে যে মনের টান আছে সেটা কোথাও পাই না। হৃদয়ের টান আছে বাংলার শ্রোতাদের হাততালিতে।
বাংলার সংগীতপ্রেমীদের কাছে এ মাসটা কিন্তু মোটেও ভাল ছিল না। পার্ক স্ট্রিট মিউজিক ওয়ার্ল্ড বন্ধ হয়ে গেল...
আমারও খুব খারাপ লেগেছিল। কিছু দিন আগেই চন্দ্রাণীর সঙ্গে আলোচনা করছিলাম। আমরা বরাবর গানের সিডি গিফ্ট দিয়ে এসেছি। গান উপহার দেওয়ার মধ্যে কিন্তু মনেরও একটা ভাষা আছে। গিফ্টা প্যাক করার মধ্যে একটা রোম্যান্টিসিজম আছে। কলকাতায় তার একটা উৎসই তো বন্ধ হয়ে গেল। অবশ্য এটাই মনে হয় ভবিতব্য। আমার গানও তো শ্রোতারা, শ্রোতা না বলে বোধ হয় দর্শক বলাই ভাল, ইউটিউবে দেখে। নিজেদের মধ্যে ব্লু টুথে শেয়ার করে নেয়। পাইরেসিটা একটা সাঙ্ঘাতিক জায়গায় চলে গিয়েছে। আরে একটা সিডিতে তো এক রকমের গানই থাকে না। অনেক রকমের গান সুরকার বাঁধেন। সেটা এই জেনারেশন ডেফিনিটলি মিস করছে।

এই জেন ওয়াইকেই তো আপনি ঘাড় ধরে বাংলা গান শুনিয়েছেন। আপনার গানের কাছে হানি সিংহ-ও হোয়াইটওয়াশ। এর ইউএসপি-টা কী?
(অনেকক্ষণ চুপ) আমার মনে হয় মাটির টান। আমি বাংলা ছেড়েছি ষোলো-সতেরো বছর হয়ে গেল। কিন্তু আদতে তো সেই গঙ্গাপাড়ের ছেলে। বরানগরে বেড়ে ওঠা। রামকৃষ্ণ মিশনে স্কুলিং। আমার মেলোডি তো গঙ্গা থেকেই উঠেছে। একটা দিনও হয়নি, আমি সলিল চৌধুরী কী সুধীন দাশগুপ্তের গান না শুনে ঘুমাতে গিয়েছি। আমি আর চন্দ্রাণী মাঝে মাঝেই ‘বসন্ত বিলাপ’ দেখি। ‘লেগেছে লেগেছে আগুন’ গানটা শুনি। এগুলোই হয়তো ‘হিট গাঙ্গুলি’ করেছে।

শুনেছি আপনার বৌ চন্দ্রাণী আপনার পিআর ম্যানেজার।
হা হা হা। না চন্দ্রাণী ওর কলেজ নিয়েই ব্যস্ত। ও আমার পিআর করে না। ম্যানেজার বলতে পারেন। আমার যা ভুলো মন! আমি এমনিতেই মিডিয়ার প্রিয় পাত্র, পিআর-এর দরকার হয় না।
প্রীতমকে ওঁর কাজের জন্য কনগ্র্যাচুলেশন জানিয়েছেন?
হ্যাঁ, কথা তো হয় আমাদের। এই তো সে দিন এক অ্যাওয়ার্ড ফাংশনে দেখা হল, ও ‘আশিকি ২’য়ের জন্য আমাকে কনগ্র্যাচুলেট করল, আমি প্রীতমদাকে ‘বরফি’র জন্য কনগ্র্যাচুলেট করলাম।

আপনি এত গোড়ার কথা বললেন, শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, ‘বস’য়ের টাইটেল সংয়ের ‘মেড ইন কলকাতা’ কি আপনারই ট্যাগ লাইন?
হা হা হা। হয়তো তাই। আমি যেখানেই যাই না কেন, নাক উঁচু করে বলি আমি বাঙালি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.