ছাদ ভেঙে বজবজ ইএসআই হাসপাতালের জরুরি বিভাগ বন্ধ। সারানো যাচ্ছে না। বেলুড় ইএসআই হাসপাতালে যক্ষ্মা ওয়ার্ড ও মর্গ তৈরির কাজ মাঝপথে আটকে, অক্সিজেন পাইপলাইন বসানোর কাজ বিশ বাঁও জলে। বালটিকুড়ি ইএসআই হাসপাতালে অস্থিরোগ ও স্ত্রীরোগ বিভাগ তৈরির কাজও বন্ধ। সেখানে আউটডোরের ছাদ ভেঙে পড়ছে, যে কোনও মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
তালিকাটা দীর্ঘ। রাজ্যের ১৩টি ইএসআই হাসপাতালের পরিকাঠামো উন্নয়ন, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রায় সব কাজ আটকে গিয়েছে টাকার অভাবে। রাজ্য সরকারের অভিযোগ, এই সব কাজের জন্য প্রকল্প অনুমোদন করে অর্থ মঞ্জুর করে ইএসআই কর্পোরেশন (কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন)। কিন্তু গত বছর থেকে সেই বরাদ্দ আগাম না জানিয়ে অর্ধেকেরও কম করে দিয়েছে তারা। এর ফলে ঠিকাদারদের পাওনা মেটানো যায়নি। যার পরিণতিতে সব হাসপাতালেই কাজ প্রায় বন্ধ। কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পুর্ণেন্দু বসু। তাঁর কথায়, “এই ভাবে আর দু’মাস চললে ইএসআই হাসপাতালগুলির পরিষেবা মুখ থুবড়ে পড়বে।”
ভুল যে তাদের, তা স্বীকার করে নিয়েছে ইএসআই কর্পোরেশন। এই কেন্দ্রীয় সংস্থার পূর্বাঞ্চলীয় সিনিয়র স্টেট মেডিক্যাল অফিসার সমীর চৌধুরী জানান, এত দিন জানা ছিল হাসপাতাল সংস্কারে টাকা খরচের উর্ধ্বসীমা নেই। কিন্তু নিয়মকানুনের ফাইল ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, প্রকল্প-প্রস্তাব যাই থাকুক, ওই খাতে কোনও রাজ্যকেই বছরে ৮ কোটি টাকার বেশি দেওয়া যায় না। তাঁর মন্তব্য, “ভুলটা শুধরে নিয়েছি। তাই নিয়ম ভেঙে আর টাকা দেওয়া যাবে না।”
সমস্যার শুরুও এখান থেকেই। শ্রম দফতরের বক্তব্য, ইএসআই হাসপাতালগুলিতে কী কাজ করা দরকার, তা ঠিক করে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল উন্নয়ন কমিটি। হাসপাতালের সুপার কমিটির চেয়ারম্যান। কমিটিতে ইএসআই কর্পোরেশনের এক জন প্রতিনিধি রয়েছেন। কমিটির প্রস্তাব যায় ইএসআই কর্পোরেশনের কাছে। তারা প্রস্তাব অনুমোদন করে অর্থ মঞ্জুর করে। শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু জানান, ২০১২-১৩ আর্থিক বর্ষে রাজ্যের ১৩টি ইএসআই হাসপাতালের সংস্কারে ১৮ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করে কর্পোরেশন। মার্চ পর্যন্ত কাজ হয় সাড়ে ১৫ কোটি টাকার। কিন্তু গত ডিসেম্বরে ৮ কোটি টাকা দেওয়ার পরে আর টাকা দেয়নি কর্পোরেশন। ফলে ঠিকাদারদের সাড়ে ৭ কোটি টাকা পাওনা হয়েছে। তাঁরা কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। চলতি আর্থিক বছরের (২০১৩-১৪) জন্যও কর্পোরেশন ৮ কোটি টাকা পাঠিয়েছে। এক শ্রমকর্তার বক্তব্য, “এই টাকা দিয়ে গত বছরের বকেয়া শোধ করলে এ বার আর কাজই হবে না। এবং বাস্তবে সেটাই হয়েছে।” রাজ্যে এই পরিস্থিতির কথা জানিয়ে দিল্লিকে চিঠি পাঠিয়েছেন কর্পোরেশনের কর্তা। তাঁর কথায়, “দু’মাস আগে চিঠি দিয়েছি। উত্তর আসেনি।” শ্রমমন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন, “আট কোটি খরচের সীমা বেঁধে দেওয়া হলে তা আগে জানানো হল না কেন?” তাঁর বক্তব্য, “প্রতি বছর ইএসআই কর্তৃপক্ষ এ রাজ্য থেকে ৩০০ কোটি টাকার বেশি আদায় করে। দেশের বিভিন্ন সরকারি ব্যাঙ্কে তাদের জমা রয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। তা হলে এই নিয়ম কার স্বার্থে?”
নিজেদের ভুল স্বীকারের পাশাপাশি ইএসআই কর্পোরেশনের এক শীর্ষকর্তা রাজ্যের বিরুদ্ধে টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ তুলেছেন। তাঁর অভিযোগ, “খরচের সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে গত বছর। কিন্তু তার আগে যত খুশি খরচ করা যেত। দেখা গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের একাধিক ইএসআই হাসপাতালে লক্ষ-লক্ষ টাকা খরচের হিসেব নেই। কাজ হয়নি, অথচ টাকা ব্যয় হয়েছে।” তাঁর মতে, “ঠিকমতো খরচ করলে বছরে ৮ কোটি টাকা কম নয়।” ইএসআই-কর্তার এই অভিযোগ মেনে নিলেও রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী দায় চাপিয়েছেন কর্পোরেশনের উপরেই। তাঁর অভিযোগ, “ওঁরা কি ঘুমোচ্ছিলেন? খরচের হিসেব ভাল করে খতিয়ে না-দেখে টাকা অনুমোদন করলেন কেন? কেন এত দিন হাসপাতালে অডিট হয়নি? ওদের ভুলের জন্য হাসপাতালের পরিকাঠামো উন্নয়ন কেন ধাক্কা খাবে? আমরা এখন একাধিক হাসপাতালে ভিজিল্যান্স বিভাগকে দিয়ে তদন্ত করাচ্ছি।” |