পঞ্চায়েত ভোটের দিনগুলিতে নির্বাচনী গোলমালে যাঁরা খুন হয়েছেন, রাজ্য সরকার তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেবে বলে ইঙ্গিত দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পঞ্চায়েতের ভোটগ্রহণ শেষ হলেও নির্বাচন পর্ব এখনও মেটেনি বলে ক্ষতিপূরণের কথা মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি ঘোষণা করেননি। তবে শনিবার বিধানসভায় তিনি যা বলেছেন, তার মর্মার্থ পঞ্চায়েত ভোটের দিনগুলিতে নির্বাচনী গোলমালে নিহতদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হবে। অতীতে বাম সরকার পঞ্চায়েত বা পুর নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রিক গোলমালে নিহত কাউকে ক্ষতিপূরণ দেয়নি। সে দিক থেকে ওই ক্ষতিপূরণ অভিনব।
মুখ্যমন্ত্রীর মতে, পঞ্চায়েত ভোটের পাঁচটি দফায় মোট সাত জন ভোটকেন্দ্রিক গোলমালে খুন হয়েছেন এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে মারা গিয়েছেন দু’ জন। ওই ন’ জনকেই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বলে মুখ্যমন্ত্রী ইঙ্গিত দিয়েছেন। স্বাভাবিক ভাবেই বাম বা কংগ্রেস কোনও পক্ষই ক্ষতিপূরণের বিরোধিতা করেনি। কিন্তু নিহতের সংখ্যা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে তাদের প্রবল আপত্তি আছে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এবং কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া দু’ জনেরই প্রশ্ন, পঞ্চায়েত ভোটের দিনগুলিতে গোলমালে নিহতের সংখ্যা সাত এ তথ্য মুখ্যমন্ত্রী পেলেন কোথা থেকে? দুই নেতার মতেই, নিহতের সংখ্যা অনেক বেশি। ক্ষতিপূরণ দিলে তা সকলকেই দিতে হবে।
এ দিন বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “পঞ্চায়েত ভোট পর্বে যাঁরা প্রকৃতই খুন হয়েছেন, অর্থাৎ, বোমা বাঁধতে গিয়ে মারা যাননি, তাঁদের বিষয়টা মানবিক দিক থেকে দেখব। তাঁদের পরিবারের প্রতি আমার সহানুভূতি আছে। তাঁরা যে দলেরই হোন। এখন ভোট বলে আর কিছু বলছি না।” মুখ্যমন্ত্রীর আরও আশ্বাস, “পঞ্চায়েত ভোট পর্বে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মৃত্যুর ঘটনার ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্ত হবে। তাঁরা ক্ষতিপূরণ পাবেন।” ‘প্রকৃত খুন’ প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাখ্যা, “ভোটে কেউ বোমা বাঁধতে গিয়ে মারা গেলে, সেটা বেআইনি এবং দুর্ঘটনা। সেটা খুন নয়। গণতন্ত্রে বোমা বাঁধার প্রয়োজন কী?” বিরোধীদের মতে ভোটের দিনগুলিতে গোলমালে নিহতের সংখ্যা সাতের বেশি হলেও মমতার বক্তব্য, তাঁদের অনেকেই বোমা বাঁধতে গিয়ে তা ফেটে মারা গিয়েছেন। ফলে তাঁদের কোনও ভাবেই নির্বাচনী গোলমালে নিহত বলে মানা যাবে না।
মুখ্যমন্ত্রীর ওই যুক্তি উড়িয়ে দিয়ে সূর্যবাবু বলেন, “আমরা মৃতের তালিকা ছাপাই। ভোটের আগেই আমাদের দলের ২১ জন মারা গিয়েছিলেন। আর পাঁচ দফার ভোটে মোট ২৫ জন মারা গিয়েছেন।” সূর্যবাবুর দেওয়া হিসাবে নিহতদের ১১ জন বামপন্থী, সাত জন কংগ্রেস কর্মী, চার জন তৃণমূল কর্মী, এক জন বিক্ষুব্ধ তৃণমূল কর্মী, এক জন এসইউসি কর্মী এবং এক জন সাধারণ ভোটার। সূর্যবাবুর দাবি, ক্ষতিপূরণ দিলে ওই ২৫ জনের পরিবারকেই দেওয়া উচিত।
এই ক’দিন ধরে বিরোধীরা লাগাতার পঞ্চায়েত ভোটে সন্ত্রাসের অভিযোগ করে আসছেন। অনেকেই বলছেন, এ দিন মুখ্যমন্ত্রী মুখ খুলে বুঝিয়ে দিতে চাইলেন, রক্তপাত হলেও তার পরিমাণ ছিল বাম জমানার তুলনায় অনেকই কম। এই দাবি করে এ দিন মমতা জানান, পঞ্চায়েত ভোটে ১৯৯৮ সালে ৪৮ জন, ২০০৩ সালে ৪০ জন, ২০০৮ সালে ৩৫ জন নিহত হন। এ বার নিহতের সংখ্যা তার তুলনায় অনেক কম। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “এ বার ভোট প্রক্রিয়া শুরুর সময় থেকে মোট ২৭ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২২ জন তৃণমূল কর্মী।”
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, “এক দিনে ভোট করলে নিহতের সংখ্যা আরও কম হতো।” বিরোধীদের পাল্টা অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া পরিসংখ্যান অসত্য।
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেন, “সামান্য কিছু এলাকার লোক ছাড়া সকলে বলছেন, তাঁরা নির্বিঘ্নে ভোট দিয়েছেন। কেবল মাত্র মালদহ ও মুর্শিদাবাদের কয়েকটি বুথে গণ্ডগোল হয়েছে।” মানসবাবু পাল্টা বলেন, “রাজ্যের সব জেলাতেই গণ্ডগোল হয়েছে। আমতায় এত বাড়ি পুড়ল, বিধায়ক অসিত মিত্র আক্রান্ত হলেন, তার উল্লেখও মুখ্যমন্ত্রী করলেন না!”
বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুর অভিযোগ, “মোট ৪৪৭১টি বুথ দখল হয়েছে, যার অধিকাংশই করেছে তৃণমূল।” পঞ্চায়েতের গণনাপর্বেও হিংসার আশঙ্কা করে বিমানবাবু বলেন, “হিংসা ঠেকাতে নির্বাচন কমিশন ও রাজ্য সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে হবে।” |