|
|
|
|
|
|
চেনা গল্প অচেনা মোচড় |
আজ কপাল পুড়ল: ম্যাকবেথ-এর
|
শিশির রায় |
ভুলে গেছিল। ওই এক বারই ভেতরটা দেখে ফেলেছিল লেডি ম্যাকবেথ। নিজে গিয়ে মাখিয়ে এল। ছিঃ, তুমি পুরুষ! তুমি না ম্যাকবেথ! শৌর্যবীর্যবান, প্রতাপী জেনারেল! নারীর বিদ্রুপের সামনে কুঁকড়ে গিয়েছিল লজ্জায়, অপমানে।
ওই এক বারই। সিংহাসনে বসেই অন্য মানুষ। ‘হেইল ম্যাকবেথ!’ ধ্বনিতে গমগমে দরবার। লেডি ম্যাকবেথ-এর মুখে গর্ব ঝলসাচ্ছে। এর ডান হাত ওর বাঁ হাত ছুঁয়ে, সিংহাসনের ওপর। এক বার বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরল রানির লতানে আঙুলগুলো। অনামিকার হিরের আংটির ধার কেটে বসল ধবধবে, মেয়েলি তর্জনীতে। উঃ! ব্যথায় বিকৃত হয়েছিল রানির মুখ, শিউরে উঠে চেয়েছিল ম্যাকবেথের দিকে। ব্যাঙ্কো কুর্নিশ করছে। ম্যাকবেথের মুখে মৃদু হাসি, দৃষ্টি সোজা, চোখ চকচক করছে। রানি, আমার প্রিয়তমা, ওটুকু রক্ত না হয় ঝরলই তোমার আঙুল থেকে। ম্যাকবেথের পৌরুষকে ব্যঙ্গ করেছিলে সে দিন, ভুলিনি। অমন সুখের সময়ে, উৎসবের লগ্নেও না। ডানকানের রক্তে দু’হাত রাঙিয়েছিলে, এখন দু’ফোঁটাতেই উঃ?
ঘোড়াটা গুঙিয়ে উঠল এক বার। গরম লু ঝাপট মেরে যায় মুখে। ডাইনিটা কি আসছে? ওর জন্যই এত পথ ঠেঙিয়ে আসা। একটা খবর, একটা ‘হ্যাঁ’ শোনার আশায় এত পথ উজোনো। ফ্লিয়ান্স, ব্যাঙ্কোর ছেলে, কবে আসবে স্কটল্যান্ডে? আসবে তো? রাজা ম্যাকবেথ, চুলে পাক-ধরা প্রৌঢ় ম্যাকবেথ কত কাল পথ চেয়ে প্রতীক্ষায়! মুকুটটা বড্ড ভার হয়ে চেপে বসছে আজকাল। ওকে পরিয়ে দিয়ে তবে শান্তি। তবে ঘুম। কত কাল দু’চোখের পাতা এক করেনি ম্যাকবেথ, কেঁদেছে ফ্লিয়ান্স-এর জন্য।
স্কটল্যান্ড জানে, ফ্লিয়ান্স ব্যাঙ্কোর ছেলে। ঈশ্বর জানেন, না। ওই মুখ, ওই চোখ, হাতের গুলি, কবজি— অবিকল ম্যাকবেথ। ব্যাঙ্কো জানত, মুখ ফুটে বলতে পারেনি কখনও। এক কালের প্রাণের বন্ধু রাজা হয়ে গেলে কিছু কথা বলা যায় না। আর, ম্যাকবেথই ফ্লিয়ান্সের জন্মদাতা, রাষ্ট্র হলে ম্যাকবেথের কী? রাজার সব কিছু সওয়া যায়। গুমখুন, ব্ল্যাকমেলিং, পরস্ত্রীর গর্ভে সন্তান, সব। অত বড় বীর যে ব্যাঙ্কো, ঈশ্বর মেরে রেখেছিলেন ওই জায়গায়। |
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
বাবা হওয়ার মুরোদ ছিল না। অথচ ডাইনিরা বলেছিল, ব্যাঙ্কোর বংশধর রাজা হবে এক দিন। ম্যাকবেথ রাজা হবে, জানা-ই। কত দিন ওই মুকুট স্বপ্নে এসেছে। ডানকানকে খুনের প্ল্যানও কবে ছকে রাখা। ব্যাঙ্কোকে বলতে শিউরে উঠেছিল। ছোটবেলা থেকে বন্ধুকে চেনে। জানে, ম্যাকবেথ ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। ডাইনিরা কোথায় লাগে ওর কাছে! তুকতাক, মন্ত্রতন্ত্রের ভাঁওতাবাজি নয়। রাজা হবে মানে হবেই। মুকুট পরবে মানে পরবেই। চওড়া পাঞ্জা-ছাতির জোর সূক্ষ্ম বুদ্ধি আর বরফ-শীতল মেজাজের সঙ্গে মিশলে কী হয়, স্কটল্যান্ড দিব্য জানে এখন।
ডানকান বোকা। নইলে যে ম্যাকবেথ অ্যাদ্দিন এত শত্তুরের পাখসাট সামলাল, তাকে ডিঙিয়ে সিংহাসন দেয় নিজের গবা ছেলেকে! মরতে হতই ওকে। আমি ম্যাকবেথ, তাকতে, সামর্থ্যে, সাফল্যে সবার সেরা। আমিই তো রাজা হব। হতভাগ্য ব্যাঙ্কো। তোর ছেলে ফ্লিয়ান্স আসলে আমারই, ওকেই রাজা করতাম পরে। আহা লেডি ম্যাকবেথ, মাই ফেয়ার লেডি! মা হতে পারনি কোনও দিন, অথচ জানতে ফ্লিয়ান্স-এর কথা। সইতে পারোনি সে সত্য, খুন করতে বললে ওদের। তোমায় কষ্ট দিতে চাইনি। এমন প্ল্যান বানালাম, দু’দিক রফা। খুনি ব্যাঙ্কোকে মারল, ফ্লিয়ান্সকে পালাতে দিল। আমার নির্দেশ। তোমাকে বোঝানো তো এমন কিছু কঠিন না। জীবনভর কত কিছু বোঝালাম দেশকে, তুমি সামান্য মেয়েমানুষ! ম্যাকবেথের মুকুট রক্ষার শতরঞ্জ খেলায় বোড়ে, না, ঘোড়া! তাও আড়াই চালের দৌড় থামতেই পাগল হয়ে গেলে!
বন্ধুতা। রক্ত। মুকুট। ক্ষমতা। উত্তরাধিকারের পায়ের কাছে সব এসে থমকে থাকে। তিন ডাইনির দুজনকে এই হাতে গলা টিপে মেরেছে। জঙ্গল এগিয়ে আসবে দুর্গের দিকে? ও সব সস্তা ক্যামোফ্লাজে আমি ভুলব! মাতৃগর্ভ থেকে সময়ের আগেই বেরনো ম্যাকডাফ, বিদ্রোহী ম্যাকডাফকে এফোঁড়-ওফোঁড় করেছে এই হাতের তলোয়ার। একটা ডাইনি ককিয়ে পায়ে পড়েছিল, তাকেই দিয়েছে ফ্লিয়ান্সকে বড় করার ভার। আজ সে-ই আসবে, ম্যাকবেথের, স্কটল্যান্ডের উত্তরাধিকারের খবর নিয়ে।
মুকুট খুলে রাখে ম্যাকবেথ। হু হু হাওয়া... |
|
|
|
|
|