থমথমথিশ! নাম শোনোনি বুঝি? তা শুনবেই বা কী করে? এ তো আর মনিষ্যিদের জায়গা নয় যে, বইয়ে পড়বে কী খবরে শুনবে; এ হল ভূতেদের রাজ্য। আকাশছোঁয়া গাছগুলোর একডালা, দোডালা, তেডালা, মগডালা জুড়ে ভূতেরা থাকে। থমথমথিশের ঠিক মাঝখানটাতে ভূতুমতাল, ভূতেদের দিঘি। ভূত হলে কী হয়, নাইতে খেতে জল লাগে তো। তবে থমথমথিশে ওই হার্টে ব্যামো, পায়ে বাত, চোখে ছানি, বুড়োবয়স এ সবে মরে আসবার জো নেই। মনিষ্যির দল আজকাল অনবরত গুলিগোলা ছুড়ছে, বোমাপটকা ফাটাচ্ছে, বাস, ট্রাম, ট্রেন, রেস্তোরাঁ উড়িয়ে দিচ্ছে। নিজেদেরই মারছে, নিজেরাও মরছে। তা ওই রকম মরণ যাদের, তারাই জড়ো হয় ওই থমথমথিশে। |
মনিষ্যিগুলো বিজ্ঞান পড়েছে বটে, তবে মুখ্যুগুলোর না মলে জ্ঞান হয় না। থমথমথিশে ভূতেতে ভূতেতে ভাগ নেই। দিনেরবেলা চোখে পট্টি বেঁধে, পিঠে ধামা এঁটে গাছ থেকে হেঁটমুণ্ডু হয়ে সব ঘুমোয়। সন্ধেবেলা যখন সূয্যিমামার রাগঝাল কমে ভাজা রুটির মতো হয়ে আসে, তখন আড়মোড়া ভেঙে সব উঠে বসে। রাত হলে মস্ত চুল্লিতে রান্না চাপে। গরম গরম ভুচুড়ি আর ভ্যাঁচড়ার সব্বাই সমান সমান ভাগ পায়। মাঝরাত থেকে ভোর পর্যন্ত তাসপাশা, তানতরজা, লাল্টুফাল্টু চলতে থাকে। থমথমথিশে ঘাড় মটকানো, রক্তচোষা, ভর করা এ সব এক্কেবারে মানা। যদি কেউ ভুল করেও তা হলে তাকে কুড়ি হাজার ভূতদিন মনিষ্যি খেটে আসতে হয়। আর সে যে কী পাপ, সব ভূতই জানে। জন্মানো ইস্তক যন্ত্রণা। একরত্তি প্রাণ প্যাঁটপেঁটিয়ে ইনজেকশন, পুষ্টির নামে অখাদ্য খাবার, নিজের চেয়ে ভারী ইস্কুলব্যাগ বয়ে বয়ে দশ বছরেই চোখে ছানি, পিঠে কুঁজ, চচ্চড় করে বেড়ে ওঠার জন্যে নিরন্তর পরিশ্রম। ফ্ল্যাট কেনা, গাড়ি কেনা, গুচ্ছের টাকা খরচ করে বিদেশ বেড়ানোর ব্যবস্থা না মরা ইস্তক শান্তি নেই।
গোল বাধল ভূচোনায় গিয়ে। ভূচোনা হল গিয়ে ভূতেদের আলোচনা সভা। তিন ভূতবর্ষে এক বার হয়। নানান দেশ থেকে ভূতেরা আসে। ভূতেদের নিয়মকানুন, ভূতেদের অপরাধ আর সাজা, মরে কিম্ভূত হবে না মনিষ্যি হবে, সে সব তিন ভূতবর্ষের জন্য সিদ্ধান্ত হয়। ভূতেরা মানুষের মতো বেআক্কেলে নয় যে দেড়খানা নেতা পাঠিয়ে ভূচোনা সারবে। তাই ফি-বারের মতো এ বারও সর্দার চৌমাথা ভূত গেছো, মেছো, সোজা, হাজা, কেলো, ভোম্বল, লক্কড়, ঝক্কড় সবাইকে নিয়ে ভূচোনায় যোগ দিতে গেছিল। ফিরে যা দেখল তা ভূতবাজিতেও অসম্ভব। থমথমথিশ বিলকুল ফর্সা। একটুকরো আসশেওড়ার ডাল পর্যন্ত পড়ে নেই কোথাও। বদলে দাঁড়িয়ে আছে শেষ নেই শুরু নেই ইকড়িমিকড়ি আলো জ্বলা মস্ত এক মনিষ্যিদের বাড়ি। খবর নিয়ে জানা গেল এর নাম ‘মল’। ফুর্তির জন্যে অ্যাদ্দিন সিনেমা, থিয়েটার, রেস্তোরাঁ, রেসের মাঠ ছিল; এ ভাগাড় নতুন জুটল। দেখেশুনে সর্দার চৌমাথা ভূতের চারটে মাথা চার দিকে বনবনিয়ে ঘুরতে লাগল। আণ্ডাবাচ্চা নিয়ে যাবে কোথায়? এক দল ভূত যেখানেই যাবে শিরশিরে হাওয়া দেবে, ভয় ভয় ভাব হবে, কাছেপিঠের মনিষ্যিদের লোম আর চুল খাড়া খাড়া হয়ে উঠবে। তার পর অলপ্পেয়ের দল পুলিশ ডেকে, কুকুর লেলিয়ে, ওষুধ খেয়ে নিজেরা পাগল হবে, ভূতেদেরও পাগল করবে। শেষমেশ ঠিক হল, আপাতত ওই মলের মাথাতেই চড়ে বসবে। তার পর জায়গা খুঁজে চলে যাবে। ভূতেদের জীবন মরুভূমি হয়ে গেল। ফুর্তিফার্তা বনধ। চুলো জ্বলে না। গেঁড়িগুগলি যা জোটে খেয়ে নিঃশব্দে বসে থাকা। গেছো, মেছো, সোজা, হাজারা এক যোগে চৌমাথাকে জানাল ‘প্রতিকার চাই’। চৌমাথা দেখল মানুষের কাছাকাছি থাকতে থাকতে ক্রমশ ভূতেদের হাবভাব যেন ওই আকাটগুলোর মতনই হয়ে যাচ্ছে। এক জোট হচ্ছে, চাই চাই করছে, দাবি জানাচ্ছে। হানাহানি করা থমথমথিশের সংবিধানে নেই। ঠিক হল ওই ভেংচি পর্যন্ত। তবে মাঝরাতের আগেও কাটা যাবে।
যত প্রতিবাদী ভূত আছে সবাই মিলে আজকাল সাঁঝের বেলায় ওই মলের মাথায় পা ঝুলিয়ে বসে। যারাই মলের সামনে দিয়ে হাঁটে, কষে তাদের রামভেংচি কাটে। দুপেয়েগুলোর মাথাটাথা বেবাক গুলিয়ে যেতেই আপদের দল মলের মধ্যে ঢুকে পড়ে। গোলকধাঁধায় ঘুরে ঘুরে জোড়া জোড়া জুতো, গণ্ডা গণ্ডা ছাতা, দিস্তে দিস্তে তোয়ালে, ডজন ডজন কাপডিশ সব কিনতে থাকে। পকেটের টাকা, ব্যাগের টাকা, রুমালের টাকা, ব্যাঙ্কের টাকা সব হুড়হুড় করে বেরিয়ে ফুরফুর করে উড়ে যায়।
চুপিচুপি একটা কথা বলে রাখি, মলের সামনে দিয়ে হাঁটবার সময় ভূতের ভেংচি থেকে সাবধান। |