ভারতে, বস্তুত উন্নয়নশীল বিশ্বে সর্বত্রই, গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে প্রচুর সমস্যা আছে। ভারতে কয়েকটি অঞ্চল ছাড়া এ বিষয়ে আশানুরূপ উন্নতি করা যায়নি। পশ্চিমবঙ্গ গত দুই দশক মাঝামাঝি জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। আমরা খুব খারাপ নই, আবার খুব ভালও করতে পারিনি। সমস্যার উৎস একাধিক হলেও, গ্রামে ডাক্তারের অভাবকেই অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা হয়। প্রতি ১০,০০০ জনসংখ্যায় শহরে ১৩ জন ডাক্তার পাওয়া যায়। গ্রামে সেই সংখ্যাটা তিন। গুলাম নবি আজাদের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার একটি নতুন বিল আনতে চলেছে— সব এমবিবিএস ডাক্তারকেই গ্রামে যেতে হবে, নতুবা তাঁরা স্নাতকোত্তর ডিগ্রির প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসতে পারবেন না। গ্রামের লোকেদের কাছে ডাক্তার দু’রকমের। ‘ডাক্তার’ আর ‘পাশ-করা ডাক্তার’। যদিও ‘হাতুড়ে’ কথাটি অবমাননাকর, কিন্তু ‘পল্লিচিকিৎসক’ বা ‘অনথিভুক্ত চিকিৎসক’ বলাও মুশকিল। কোদালকে কোদালই বলতে হবে। এঁদের ‘গ্রামীণ স্বাস্থ্য সহায়ক’ বলা যেতে পারে। তবে, এঁরা যে সব সময় উপকারই করেন তা নয়, অনেক ক্ষেত্রে অপকারও করে বসেন নিজেদের অজান্তেই।
এঁরা কারা? শহরতলি বা উপনগরীর অনেক চিকিৎসক আছেন, যাঁদের পসার অভূতপূর্ব। তাঁদের সহকারী হিসেবে থেকে, কিছুটা দেখে, কিছুটা শুনে, সমাজসেবী হিসেবে কাজ করে, এঁরা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। আবার, আয়ুর্বেদ-ইউনানির ছোট কোসর্ করে, ওষুধের দোকানে কয়েক বছর কাজ করে করে, বা ছোট নার্সিং হোম, হাসপাতালের চাকরি থেকেও অনেকে এই পেশায় আসেন। এঁরা সাধারণত রোগী ‘রেফার’ করেন সরকারি হাসপাতালেই। কয়েকজন বড় শহরের বেসরকারি হাসপাতালের দালাল হিসেবেও কাজ করেন। এই বড় শহরের তালিকায় শুধু কলকাতা নয়, চেন্নাই-হায়দরাবাদও পড়ে! |
কাজ করেন কী ভাবে? ‘চেম্বার’ থাকে, আবার ‘কল’ এলে বাড়ি গিয়েও রোগী দেখেন। এঁদের রুজি কিন্তু সব ক্ষেত্রে ‘ফি’ নয়, ওষুধ বা ইঞ্জেকশনের দামটুকুর মধ্যে দিয়েই ‘রোজগার’ জোটে।
স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে দুটি ভুল ধারণা আছে। প্রথমটা হল, পাশ-করা ডাক্তার মানেই সব সমস্যার সমাধান। গ্রামের ছোট হাসপাতালে যে ডাক্তার পাঠানো হয়, তাঁর কাজ কী? আমরা সাধারণত ‘জেনারেল ডিউটি’-র কথাই ভাবি— অর্থাৎ কিনা তাঁরা ‘স্পেশালিস্ট’ নন। এটাই মস্ত বড় ভুল। মেডিসিন, সার্জারি বা শিশুরোগ যেমন ‘স্পেশালিটি’, ঠিক তেমন ভাবেই ‘জেনারেল প্র্যাক্টিস’ও একটি স্পেশালিটি। দু-এক বছরের প্রশিক্ষণে কোনও স্নাতকের পক্ষে তা রপ্ত করা সম্ভব নয়। সদ্য পাশ করা এমবিবিএস এক বছর হাসপাতালে শিক্ষানবিশ থাকেন। ধরুন, তিনি বিশ-ত্রিশ জন প্রসূতির স্বাভাবিক প্রসব করালেন। সেখানে দাদা-দিদি আছেন, স্যর আছেন, মাথায় ছাতা আছে। গ্রামের হাসপাতালে মাঝরাতে, যখন উদ্গ্রীব গ্রামবাসীদের ভিড় বাইরে, সামান্য বিগড়ে যাওয়া প্রসব তাঁরা সামলাতে পারবেন কি?
দ্বিতীয় ভুল ধারণাটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বিষয়ে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও প্রাথমিক চিকিৎসা সমার্থক নয়। কোন পেটব্যথার ওষুধ দিয়েই রোগীকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া যাবে, কাকে ভরতি করে স্যালাইন-অক্সিজেন দিতে হবে, আর কাকে তক্ষুনি বড় হাসপাতালে পাঠাতে হবে, এই সিদ্ধান্ত প্রাথমিক চিকিৎসার অনেক উপরের ভাবনা।
এ বার গ্রামের মানুষের জায়গা থেকে ভাবুন। যেখানে সাইকেল-রাস্তা ছাড়া কিছুই নেই, সেখানে রাত-বিরেতে অসুখ-বিসুখ হলে চিকিৎসার মান বা খরচ, কোনওটাই প্রথম মাথাব্যথার কারণ হয় না। প্রথম উদ্বেগ হল, ডাক্তার পাওয়া যাবে তো? কাকে ডাকলে সহজেই আসবেন? এই প্রশ্নের উত্তর থেকেই সহায়কদের রমরমা।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ন্যূনতম পরিকাঠামোর অভাব ও প্রশিক্ষিত ‘পাশ করা’ ডাক্তার না-থাকা— এই দুই কারণে সহায়করা সরাসরি রেফার করেন সদর ও মহকুমা হাসপাতালে। বিপুল জনসংখ্যার গরিব দেশে ঢাল-তলোয়ারবিহীন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ব্যর্থতা স্বাস্থ্য পরিষেবার মুখ থুবড়ে পড়ার অন্যতম কারণ।
যাঁরা গ্রামেই থাকেন, সেই সহায়কদের দিয়ে কি এর কিছু সুরাহা সম্ভব? অদূর ভবিষ্যতে এঁদের বাদ দিয়ে কিন্তু কিছু করা সম্ভব নয়। নিয়মকানুন যা-ই করা হোক, প্রত্যন্ত গ্রামে এঁদের জনপ্রিয়তা কমবে না। মানবসম্পদ হিসেবে দেখলে, এঁরা কিন্তু ‘ওয়ার্ক ফোর্স’ হিসেবে বহাল রয়েছেন। বাতিল না করে ব্যবহার করা যায় কি?
কোনও সরকারের পক্ষেই এঁদের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেওয়া, মাইনে দেওয়া অথবা স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব নয়, উচিতও নয়। একমাত্র যেটা সম্ভব, তা হল, ধারাবাহিক ভাবে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। তার জন্য প্রয়োজন এমন একটি পাঠক্রম যা সব রাজ্যে সমান ভাবে গ্রহণযোগ্য। স্বাস্থ্য সহায়করা কী করতে পারবেন আর কী পারবেন না, সেই সীমারেখা বা কাজের গণ্ডি বেঁধে দিতে হলেও সেটা দরকার। যদিও তাঁরা সেই সীমা পরে মানছেন কি না, তা নজরদারি করা দুরূহ। গ্রামের মানুষের শিক্ষা ও ক্ষমতায়নের পথেই তার সুরাহা হবে।
কেন্দ্রীয় সরকার সাড়ে তিন বছরের একটি আধা-ডাক্তারি কোর্স শুরু করার কথা ভাবছে। কাদের নেবেন এই কোর্সে? নতুনদের না যাঁরা বহু দিন ধরে কাজ করছেন, তাঁদের? সুযোগ দেবেন কীসের ভিত্তিতে? কোন পরীক্ষার মাধ্যমে? কাকে বাছাই করবেন, যে ভাল করল, না যে ফেল করল?
দ্বিতীয় জনকে নেওয়া বেশি জরুরি, কারণ সে ‘ডাক্তারি’ করেই চলেছে, তার ভুল শোধরানোর প্রয়োজন অনেক বেশি। এই শিক্ষাপর্বে শেখানোর থেকেও বেশি গুরুত্ব ভোলানোর— অর্থাৎ, ভুল ভাঙানোর। বহু ডাক্তার ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এই নিয়ে কাজ করছে অনেক দিন। সরকার এদের সাহায্যে অবশ্যই একটি পাঠক্রম তৈরি করতে পারে। এই পদ্ধতি শুরু হলে, যাঁরা সত্যি অভিজ্ঞ এবং ভাল সহায়ক, তাঁরা নজর কাড়বেন (অভিজ্ঞতা বলছে, প্রতি গ্রামাঞ্চলেই কয়েক জন এ রকম আছেন)। সরকার কিছু অনুদান দিয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে হয়তো তাঁদের কাজে লাগাতে পারবে। |