নূতন গবেষণা দাবি করিল, প্রাগৈতিহাসিক মানুষেরা বহু ক্ষেত্রে নেশা করিয়া গুহাগাত্রে ছবি আঁকিতেন। বহু প্রাচীন, এমনকী চল্লিশ সহস্র বৎসর পূর্বেরও গুহাচিত্র বিশ্লেষণ করিয়া দেখা গেল, বারে বারে লক্ষ করা যাইতেছে কুণ্ডলীর ন্যায়, আবর্তিত, সর্পিল কিছু নির্দিষ্ট ছাঁদ। এবং এই নকশা কোনও বিশেষ অঞ্চলের গুহায় সীমাবদ্ধ নহে, হুবহু এই বিন্যাস দেখা যাইতেছে সহস্র কিলোমিটার দূরবর্তী গুহাতেও। নকশাগুলি অচেনা নহে। মাদক গ্রহণ করিয়া যখন কেহ চিত্তবিভ্রমের বশে অলীকদর্শন করিয়া থাকে, এই নকশাগুলিই সর্বাধিক দেখিতে পায়। যে সকল বৃক্ষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাদক-গুণাবলি রহিয়াছে, সেইগুলি কোনও ভাবে সেবন করিলে এই নকশা দেখিতে পাওয়ার সম্ভাবনা প্রভূত। মাস্তিষ্কের কাঠামো যে ভাবে বিন্যস্ত রহিয়াছে, নকশাগুলি তাহাকেই অনুসরণ করে। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী অ্যালান টুরিং, যিনি এইগুলি লইয়া গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করিয়াছিলেন, তাঁহার নামে ছাঁদগুলির নাম ‘টুরিং প্যাটার্ন’ বা ‘টুরিং ইনস্টেবিলিটি’। চৈতন্যের পরিবর্তিত অবস্থায় এই ছাঁদগুলি যখন চোখের সম্মুখে ঘুরিয়া বেড়ায়, তখন ইহাদের গভীর তাৎপর্যপূর্ণ মনে করাই স্বাভাবিক। তাই এইগুলিকে কেহ চিত্রে বা ভাস্কর্যে, কেহ অনুষ্ঠানবিধি বা ধর্মীয় পদ্ধতিতে অন্তর্ভুক্ত করিয়া লন। ফলে, সাধারণ মানুষের যে ধারণা, নেশা করিয়া শিল্প রচনা হালের মানুষের তীব্র বদভ্যাস, তাহা সর্বৈব ভুল। আর্টের সহিত মাদকের সম্পর্ক এতই প্রাচীন, ইহাকে ঐতিহ্য বলাই সঙ্গত। ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বা বিভিন্ন আর্ট স্কুলে যখন ছাত্রছাত্রীরা গাঁজায় দম দিয়া তবেই শিল্প-অভিজ্ঞতা লাভ করিতে যায়, তাহারা কোনও বিসদৃশ ব্যবহার করে না, বরং পূর্বপুরুষগণের অভ্যাসেরই পুনরাবৃত্তি করে মাত্র। বলা যাইতে পারে, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর’ আন্দোলনের ইহারা অগ্রপথিক।
ষাটের দশক হইতে পাশ্চাত্যে ‘সাইকেডেলিক’ শিল্পের, অর্থাৎ মাদক লইয়া তাহার প্রভাবে সৃষ্ট শিল্পের, এক প্রকার রমরমা হইল। কিছু আন্তরিক নিরীক্ষা, এবং কিছু নিতান্ত হুজুগের বশে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হইল, যে শিল্পীরা মাদক না লইয়াই শিল্প করিতেছেন, তাঁহাদের প্রায় মধ্যমানের শিল্পী হিসাবে ধার্য করা হইল। হিপি আন্দোলন আসিয়া মাদক গ্রহণকে অন্যরকমত্বের বাধ্যতামূলক অভিজ্ঞান হিসাবে দাগিয়া দিল। বিশাল সংগীতানুষ্ঠানে শিল্পী ও শ্রোতা সকলেই নেশা করিয়া দুলিতে লাগিলেন, একেলা গায়কের নহে তো নেশা। আলডাস হাক্সলি মাদকের প্রভাবে শিল্প লইয়া গ্রন্থ লিখিলেন তো বটেই, এমনকী মৃত্যুশয্যায় স্ত্রীর নিকট এলএসডি চাহিলেন। ডিলান টমাস, লুই ফার্দিনান্দ সেলিন, জ্যাক কেরুয়াক প্রমুখ বহু বিশ্বখ্যাত শিল্পীর নেশার কাহিনি মুখে মুখে ছড়াইতে লাগিল এবং মাদক লইয়া নিজ চৈতন্যকে সাময়িক ভাবে যুক্তিবুদ্ধির খড়ির গণ্ডি অতিক্রম করিয়া অবাধ ও নিয়মহীন জগতে উড়ান দিবার প্রয়াসকে মহৎ শিল্পপ্রয়াসের সমার্থক ধরা হইতে লাগিল। এই ধারণার অভিনবত্বের জোর এখন কমিয়া আসিয়াছে, কিন্তু আধুনিক বাঙালির শিল্প-ময়দানেও নেশাগ্রস্ত শিল্পীর উন্মত্ত কারবারকে শৃঙ্খলা-বিরোধিতা, সুতরাং প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার মহিমা-তকমা দিবার প্রবণতা বহুলাংশে বর্তমান। নেশা করিয়া পথেঘাটে লাট না খাইয়াও প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করা যায়, বা শিল্পীর নেশাখ্যানের অপেক্ষা তাঁহার রচনায় ভাঙচুরের লক্ষণ-সন্ধান অধিক বুদ্ধিমানের কর্ম— এই কথা বুঝাইতে গেলে বিলক্ষণ ব্যঙ্গের শিকার হইবার সম্ভাবনা। আদিম মানুষের ঘটনা জানিয়া মনে হইতেছে, প্রাচীন কালে ইহা বুঝাইতে গেলে মস্তকে মুগুরের বাড়ি খাইবার সম্ভাবনা ছিল! |