লিখছেন প্রাক্তন বিধায়ক গোবিন্দ রায়। ধূপগুড়িতে তাঁর সাক্ষাৎকার নিলেন নিলয় দাস। |
আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ি কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে দীর্ঘ ১০১ দিন কাটিয়েছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রাক্তন বিধায়ক গোবিন্দ রায়। ছাড়া পেয়ে জেলের অভিজ্ঞতা নিয়ে উপন্যাস লেখা শুরু করেছেন। নামটাও ঠিক করে ফেলেছেন। ‘কারাগারের হাহাকার।’ আলু কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত হয়ে দলের সমস্ত পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয়েছে, তার জন্য অবশ্য এই ‘হাহাকার’ নয়। বরং তাঁর দাবি, তিনি যে নির্দোষ তা আদালতে একদিন প্রমাণ হবেই। ধূপগুড়ি হাই স্কুলের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক গোবিন্দবাবু ছাড়া পেয়ে স্কুলে যোগও দিয়েছেন। তবে পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচারে আর যাননি। বরং গ্রীষ্মের ছুটিতে টানা লিখে চলেছেন তাঁর উপন্যাস। |
গোবিন্দ রায়।—ফাইল চিত্র। |
জেল খানায় এত দিন না কাটালে আমি ওই পরিবেশ সম্পর্কে কখনও কিছু হয়তো জানতে পারতাম না। দুটি জেলেই সকলের সঙ্গে একেবারে মিশে গেছিলাম। বন্দিদের সঙ্গে গল্পগুজব করে, তাদের সুখদুঃখ নিয়ে দিনভর কথাবার্তা বলে এত দিনে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলাম, তা খাতায় লিখে রেখে এতগুলি দিন কাটিয়েছি।
|
জেলের খাবার নিয়ে রীতিমত পুকুর চুরি হয়। বন্দিদের জন্য যে টাকা বরাদ্দ হয়, তার বোধহয় সিকি ভাগও খরচ হয় না। আমি গ্রামের ছেলে খাবার নিয়ে বাছ-বিচার আমার কখনও নেই। তবে খাবার জঘন্য, কাঁকড়-ভরা চালের ভাত। ডাল নামে যে তরল বস্তু দেওয়া হত তা থেকে ডাল খুঁজে বের করাই দায় হয়ে পড়ত অনেক সময়। খাবারের বিষয়টাও আমার লেখায় থাকবে। |
আর কী কী বিষয় আপনার ভাল লাগেনি? |
জলপাইগুড়ি কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার, যেখানে যাবজ্জীবন বন্দিদেরও রাখা হয়, সেখানে ৩১ দিন কাটিয়ে বুঝলাম তা নামেই কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার। নিকাশি নালার অবস্থা অসহনীয়। পানীয় জলের তীব্র আকাল চলছে। জলকষ্টে ভুগছেন বন্দিরা। জেল থেকে বেরিয়ে পুরসভার কর্তাদের বিষয়টি জানিয়ে বন্দিদের জন্য পানীয় জলের ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করেছি। কলেজে পড়ার সময় এনসিসি করার সুবাদে বালির উপর রাতে ঘুমানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে। জেলে মেঝেতে কম্বল পেতে রাতে ঘুমোতে হয়েছে। |
বাম শাসনের দীর্ঘ তিন দশকে জেলের উন্নতি হল না কেন? |
শুনেছি বামফ্রন্ট আমলেরও আগে, কংগ্রেসের সময় থেকেই সংশোধনাগারের এমন দশা। বাম আমলে পরিকাঠামোর ঘাটতি থেকে গিয়েছে। তবে জলপাইগুড়ি কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার ঘোষণা হবার পর আটটি হলঘর নির্মাণের কাজ বাম আমলে হয়েছে, গত বছর যার উদ্বোধন হয়। |
বিচারব্যবস্থা বিষয়ে কী বুঝলেন ? |
আলিপুরদুয়ার সংশোধনাগারের অধিকাংশ বন্দি আদিবাসী বা রাজবংশী সম্প্রদায়ের। কবে থেকে জেলে রয়েছেন, তার দিনক্ষণ বেশ কিছু বন্দি আর মনে করতে পারেন না। আত্মীয়-স্বজন বা পরিবারের কেউ তাঁদের খোঁজ নেন না। উকিলের ব্যবস্থা না থাকায় জেলের মধ্যে বছরের পর বছর তাঁদের জেলে কাটাতে হচ্ছে। তাঁদের ওই দশা দেখে রীতিমত খারাপ লেগেছে। জলপাইগুড়ি সার্কিট বেঞ্চ না থাকায় অনেক দরিদ্র মানুষ যে হাই কোর্টের উকিল ধরে নিজের আত্মীয়কে ছাড়াতে পারছেন না, সে বিষয়টি উপলব্ধি করেছি। |
আনন্দের মুহূর্ত কিছু ছিল? |
অবশ্যই ছিল। ১৯৮৬ সাল থেকে ছাত্র পড়াচ্ছি। অনেক ছাত্র বড় হয়ে এখন নানা পেশার সঙ্গে যুক্ত। জলপাইগুড়ি সংশোধনাগারে যাওয়ার পর একদিন দেখি কাঁধে বন্দুক ঝোলানো এক সেপাই কাছে এসে সটান আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। বলল, স্যার আমি আপনার ছাত্র। তার পর থেকে সে রোজ আমায় খবরের কাগজ পড়তে দিয়ে যেত। আলিপুরদুয়ার জেলে আমি প্রথম বন্দি যে প্রথম সেখানে বন্দিদের দিয়ে রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী পালন করেছি। নজরুলের উপর আলোচনা, কবিতা পাঠ করেছি। কয়েকজন বন্দি বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন। ‘সঞ্চয়িতা’ আনিয়ে বেশ কয়েকজন বন্দিকে দিয়ে বই দেখে কবিতা পাঠ করিয়েছি। কয়েক দিনের তালিমে তাদেরকে দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতও গাইয়েছি। একটি নাটকও উপস্থাপনা হয়েছে জেল সুপারের সামনে। ভাল-মন্দ এই সমস্ত অভিঞ্জতা নিয়ে বই লিখতে শুরু করেছি। আমি তাই একটি নাম ঠিক করেছি কারাগারের হাহাকার। দেখা যাক বইটি লেখা কবে শেষ করে উঠতে পারি। |