|
|
|
|
স্মরণ |
উত্তম উধাও
তিন দিনের জন্য যাত্রার মহড়া ছেড়ে কোথায় গিয়েছিলেন উত্তমকুমার? জানাচ্ছেন নিবেদিতা দে |
কোথায় যে গেল মানুষটা...
ক’দিন বাদে শো, এ দিকে সেই মানুষটাকেই কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমন তো করেন না উত্তমদা। এত সিরিয়াস...অথচ রিহার্সালেই আসছেন না...দুশ্চিন্তায় যাত্রা প্রায় বন্ধ হওয়ার জোগাড়। অন্য কাউকে ফিট করা হবে?... ভাবছেন বাড়ির সদস্যরা, এমন সময়ে জগদ্ধাত্রী পুজোর ঠিক আগের দিন ভুবনভোলানো হাসি নিয়ে তিনি হাজির ঠাকুরদালানে। হারমোনিয়াম টেনে ধরে ফেললেন গান।
আসলে, গিরীশ মুখার্জি রোড রাস্তাটি যাঁদের বাড়ির পূর্বপুরুষের নামানুসারে, তাঁদের বাড়ির নাম ‘গিরীশ ভবন’। উত্তমকুমার এঁদের প্রতিবেশী। আজও তিন মহলা বাড়িতে ন’পুরুষের বাস সেই ভবনে। প্রতি বছর আজও দুর্গাপুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো হয়। আর জগদ্ধাত্রী পুজোর রাতে বসে যাত্রাপালার আসর।
১৮৮৬ সালে ওই বাড়িতেই জগদ্ধাত্রী পুজোর পরে প্রথম সর্বজনীন যাত্রার শো হয়েছিল কলকাতায়। কালে কালে যে শো বাড়ির সদস্যরা নিজের হাতেই তুলে নেন।
উত্তমকুমার নিয়ে লিখতে বসে গিরীশ ভবনের প্রসঙ্গ আনার বিশেষ অর্থ আছে। সেই সময়ে গিরীশ ভবন ছিল বর্ধিষ্ণু বাড়ি। আর সেই বাড়িতেই এগারো বছর বয়সে প্রথম ঘরোয়া অনুষ্ঠানে নাটক করেন উত্তম। নাটকের নাম ‘মুকুট’। শুধু তা-ই নয়, এই বাড়ির সঙ্গে উত্তমের সুদীর্ঘ সম্পর্ক আজ ইতিহাসের অঙ্গ। |
|
|
ছবির অটোগ্রাফে
দেখুন তারিখ ৭.৪.৬৯। |
যাত্রার ছবিটির সালও ’৬৯।
যাত্রা: ‘ব্রজের কানাই’। ধোপার চরিত্রে উত্তম। |
|
কেবল জীবনের প্রথম নাটকই নয়, চিরটা কাল তিনি এই বাড়ির ঘরোয়া জলসায় অংশগ্রহণ করতেন স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে।
উত্তমের পৈতৃক বাড়ির কয়েকটা বাড়ি পরেই এই ‘গিরীশ ভবন’। প্রত্যেক বছর জগদ্ধাত্রী পুজোর রাতে বসত সেই যাত্রা, চলত ভোর পর্যন্ত। আজও সেই ট্র্যাডিশন চলছে। শুধু সেই মানুষটাই যা নেই!
“হ্যাঁ হ্যাঁ, ‘সন্ন্যাসীরাজা’ হওয়ার পরেও উত্তমদা যাত্রা করত”, বলছিলেন বাড়ির সাত ভাইয়ের ষষ্ঠ ও সপ্তম ভাই প্রদীপ ও রথীন মুখোপাধ্যায়।
এ বাড়ির বড় ছেলে দিলীপ উত্তমের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে পঞ্চ-পাণ্ডব টিমের অন্যতম সদস্য ছিলেন। আজ তিনি প্রয়াত।
ছিলে কোথায় উত্তমদা...
“যে কথা বলছিলাম...১৯৭৫ সাল। উত্তমদা তখন কী রকম রমরমে বলে বোঝানোর দরকার নেই...‘সন্ন্যাসী রাজা’র অনেক পোশাকআশাক সে বছর ব্যবহার করা হয়েছিল স্টুডিয়ো থেকে আনিয়ে। তো আমাদের ‘নটি-বিনোদিনী’ হবে। গিরীশ ঘোষ বুড়োদা (তরুণকুমার) আর গুরমুখ রায়, উত্তমদা। বিনোদিনী চরিত্রটি কে করেছিল জানো?
কে?
“আমি”, বললেন রথীন।
অ্যাঁ? |
যাত্রা: ‘নটি বিনোদিনী’ |
|
|
|
রথীন মুখোপাধ্যায় এখন |
রথীনই মেয়ে সেজে বিনোদিনী, সঙ্গে গুরমুখ রায়ের |
|
“হ্যাঁ, তখনও মহিলা চরিত্রে অভিনয় করার জন্য আমরা মেয়ে সাজতাম।”
আর যেহেতু সেই সময় উত্তমদা খ্যাতির চুড়োয়, ফলে পুজোর সন্ধ্যারতির সময় থেকেই ঠাকুরদালানে লোকে লোকারণ্য। যাত্রা কিন্তু আরম্ভ হবে রাত বারোটায়।
...তো সব ঠিকঠাক চলছে...হঠাৎই উত্তমদা উধাও!
...তিন দিন কাটিয়ে ফিরে আসার পর আমরা পড়ি কী মরি করে ঠাকুরদালানে গিয়ে বসলাম...কী ব্যাপার উত্তমদা?
বলল, “শোনো বাবা, এই পার্ট তোমরা যা আমায় দিয়েছ, কলকাতায় বসে মুখস্থ করা অসম্ভব। হাজারটা লোক বিরক্ত করবে। আমি তিন দিনের জন্য পুরী চলে গিয়েছিলাম। হোটেলের ঘরে বসে মুখস্থ করেছি।... এ বার নাও চলো।”
এই হল উত্তমদা...বাড়ির জলসা তাতেও কী ডেডিকেশন! কত বার হয়েছে, আমাদের বাড়িরই হয়তো কেউ রিহার্সালে এল না, কিন্তু উত্তমদা ঠিক সময়ে হাজির। এমনকী বুড়োদাকে পর্যন্ত বকাঝকা করত, “পার্টটা ঠিক করে মুখস্থ কর।” বুড়োদা অনেক সময়ে ভাবত স্টেজে মেরে দেবে, কিন্তু উত্তমদার সেই সব ব্যাপার নেই। আমাদের সঙ্গে ঘরোয়া যাত্রাতেও চেষ্টা করত কী করে স্টেজ নেবে।
এক বার ‘ব্রজের কানাই’ (’৬৯) যাত্রায় ধোপার চরিত্রে অভিনয় করছেন উত্তমদা। বুড়োদা কংস আর রথীন সেজেছেন কংসের বৌ প্রাপ্তি। কংসের বৌয়ের কোমর জড়িয়ে ধরার একটা দৃশ্য ছিল...বুড়োদা রিহার্সালে সেটা কিছুতেই করছেন না, “উত্তমদা দিল ধমক। কী হচ্ছে কী বুড়ো...গণেশ (রথীনের ডাকনাম) তো স্টেজ নিয়ে বেরিয়ে যাবে... বৌয়ের কোমরটা পর্যন্ত ঠিক করে জড়াতে শেখোনি...?” মেয়েদের কী করে ট্যাকল করতে হয়...মন ভরিয়ে দিতে হয়...সেই সব অভিনয়ে... নমস্য নমস্য! |
|
|
দীপ মুখোপাধ্যায় |
যাত্রায় যিনি মেয়ে সেজে পান্নাবাঈ। |
|
বিনোদিনী...পান্না বাঈ
স্টেজ নেওয়া প্রসঙ্গে আরেকটা কথা... প্রদীপ তখন করছেন একটু চটুল ধরনের চরিত্র পান্না বাঈ, আর আগেই বলেছি রথীন সেজেছেন বিনোদিনী।
যেহেতু বাড়ির ব্যাপার তাই “আমরাও স্টেজে একটু-আধটু নতুন-নতুন কীর্তি করতাম উত্তমদার সঙ্গে। যেমন আমি একবার নাচতে নাচতে স্টেজ থেকে বেরিয়ে আসার সময়ে উত্তমদার গায়ে একটু ঠুনকো মেরে দিয়েছিলাম। আর ওর কথাটা কী বলব...” প্রদীপের কথা কেড়ে নিলেন ছোট ভাই রথীন। “আমি বিনোদিনী...গুরমুখ রায় আমায় চায়...আমাকে সোনার হার উপহার দিতে ভোগ করতে চায়...হার নিতে আমি রাজি নই...আমার ডায়লগ ছিল, ‘দেখুন গুরমুখবাবু, কিছু না দিয়ে আমি কিছু নিই না’। তার পর উত্তমদা বলবে, ‘এটা তোমায় নিতে ভি হবে..দিতে ভি হবে’...মুশকিল হল, উত্তমদার এই ডায়লগের পরে আমার ডায়লগ লোকে শুনবে কেন? এমন চিৎকার...তাও আমি বলেছিলাম...‘হে ঈশ্বর...এমন পাতকীকে তুমি ক্ষমা কোরো’...
স্টেজ থেকে নেমে আমার গাল টিপে উত্তমদা বলল, “ওরে আমার বিনোদিনী রে...তার পর কানে কানে বলল...সত্যি বলছি এত নায়িকাকে জড়িয়েছি, কিন্তু তুই অসাধারণ...”
সেই গাল টেপা দেখে বাইরের দর্শক, বিশেষ করে মেয়েরা গড়িয়ে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ছে। যেন তাদের গালটা উত্তমদা যদি টিপে দিত, তা হলে কী-ই না হত!
সত্যি, স্টেজ থেকে নেমেও যে জীবনের স্টেজে অন্যকে কী করে ‘মেরে দিয়ে স্টেজ নিতে’ হয় বুঝেছিলাম সে দিন, সকলের সামনে ওই গাল টেপা আর কানে কানে কথা বলার রহস্য দেখেই! |
|
|
|
|
|