|
|
|
|
|
|
|
মুখোমুখি... |
|
কোথাও আমি ইতুপন্না, কোথাও ঋতুপর্ণা |
দু’সপ্তাহ অন্তর তাঁর নতুন ছবির মুক্তি। ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের জায়গা ধরে রাখার
স্ট্র্যাটেজি এটাই? ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত-এর সামনে প্রশ্নসমেত প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
পত্রিকা: ‘অলীক সুখ’-এ মেডিক্যাল এথিক্স নিয়ে এ ভাবে ছবি করা মানে তো মৌচাকে ঢিল ছোড়া। ভয় করেনি?
ঋতুপর্ণা: (হা হা) অনেক ডাক্তার তো বলেছেন আমরা তাঁদের সামনে আয়না তুলে ধরেছি। ডাক্তারদের ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু থাকে না। সে নিয়ে তো কথা রয়েছে। কিন্তু তার থেকেও অনেক সাহসী জিনিস দেখিয়েছি আমরা। পরিচালকরা অনেক রিসার্চ করেই এমন একটা স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। দেখিয়েছেন কী ভাবে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের ওষুধ রেকমেন্ড করার জন্য উপহার হিসেবে অনেক ডাক্তারকেই বিনা পয়সায় বিদেশ সফরে পাঠানো হয়। কী ভাবে তাঁরা চেম্বারের পর চেম্বার করেন, যার ফলে রুগি দেখার জন্য তাঁদের খুব কম সময় থাকে। এ সব তো বাংলা ছবিতে আগে দেখানো হয়নি। সেদিন শুনলাম একটা মেডিক্যাল কনফারেন্সে বলা হয়েছে যে, এত ‘অলীক সুখ’-এর পেছনে দৌড়িয়ো না!
পত্রিকা: তার মানে ছবিটার ইমপ্যাক্ট হচ্ছে...
ঋতুপর্ণা: হ্যাঁ। বক্স অফিসেও উইকএন্ড হাউসফুল ছিল। রবিবার আমাদের একটা পার্টি ছিল। এক ডাক্তার আমাদের ছবিতে অভিনয় করেছেন। তিনি পার্টিতে আসার আগে বললেন, আগে এক জন পেশেন্ট দেখে আসি। না হলে যদি কোনও গণ্ডগোল হয়ে যায়! সিনেমার একটা দৃশ্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তো দেবশঙ্কর হালদারকে বলছেন ‘পেশেন্ট পার্টি’ না বলে যেন তাঁদেরকে ‘ডিয়ার রেলেটিভস’ বলে সম্বোধন করা হয়। এই সব সংলাপের মধ্যে দিয়ে তো আমরা লোকের চোখে ভুলগুলো ধরিয়ে দিতে পারছি। সচেতনতা বাড়ছে। যে ভাবে স্পষ্ট ভাষায় সব বলা হয়েছে, তাতে মনে হয় অনেক ডাক্তারেরই এই সিনেমাটা দেখে একটা সেল্ফ-রিয়েলাইজেশন হবে। আমির খান তো এই সব ইস্যু নিয়েই ‘সত্যমেব জয়তে’ করেছিলেন। ওটা অন্য ফরম্যাটে ছিল। আমরা ছবিতে সেটা নিজেদের মতো করে দেখিয়েছি।
পত্রিকা: ‘অলীক সুখ’-এর বেশির ভাগ পোস্টারেই তো শুধু দেবশঙ্কর হালদার। তা দেখে নাকি বাচ্চাদের মতো আপনারও একটু অভিমান হয়েছিল?
ঋতুপর্ণা: (হা হা) আই অ্যাম অ্যাভব দিস। আমি সবাইকে স্পেস দিই। তা সে নাইজেল হোক বা দেবুদা। সিনেমা একটা টিমওয়ার্ক।
পত্রিকা: যদিও ছবিতে কিছু অতিনাটকীয় মুহূর্ত রয়েছে, কেউ কেউ মনে করছেন যে, দেবশঙ্কর নাকি এই ফিল্মের হাত ধরেই টলিউডের ইরফান হয়ে উঠবেন। আপনারও কি একই মত?
ঋতুপর্ণা: দেবুদা এক জন সুপার অভিনেতা। ‘অলীক সুখ’ ওর সিনেমার কেরিয়ারের একটা মেজর রোল। হিরো হিসেবেও এখানে ওর প্রথম আত্মপ্রকাশ। ছবিতে ওর অভিনয় আমার ভাল লেগেছে। যদি কারও অতিনাটকীয় লেগে থাকে, সেই সমালোচনাটা দেবুদা নিশ্চয়ই কনস্ট্রাকটিভলি হ্যান্ডেল করবে।
পত্রিকা: নাটকের অভিনেতারা সিনেমা করলে অনেক ক্ষেত্রেই থিয়েটারের হ্যাংওভারটা বড় পরদাতে ফুটে ওঠে। তার তুলনায় আপনার অভিনয়ে থাকে পরিমিতির ছাপ। কাজ করতে গিয়ে নিজেও কি এটা অনুভব করেছেন?
ঋতুপর্ণা: দেখুন, সিনেমা ছাড়া অন্য কোনও মাধ্যমে আমার তেমন এক্সপোজার নেই। অভিনয় শেখার ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। আই অ্যাম আ প্রোডাক্ট অব সিনেমা। তা সে বাণিজ্যিক হোক, আর্ট হোক বা মিডল অব দ্য রোড। এই ছবিটি দেখে থিয়েটার অভিনেতা দেবদূত আমাকে মেসেজ করে বলেছে: ‘সিনেমার অভিনয়টা আমাকে শেখাবে?’ তবে আমি এটাও বলতে চাই যে, যখন আমি ছবি করি, তখন আমি পরিচালকদের ওপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখি। ওরা আমাকে যে ভাবে গড়ে নিতে চায়, আমি সেটাই করি। কোনও ইগো রেখে কাজ করি না। যত বার ডাব করতে বলে, আমি তত বারই করে দিই। মনে করি না যে আমি এত দিন কাজ করেছি, এর থেকে বেশি আর করা উচিত নয়।
|
|
পত্রিকা: এই ইগো না থাকাটাও কি একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় না? নিজের অভিনয় ছেড়ে দিন, কতটা সময় দেন আপনি ছবির চিত্রনাট্যটা মেরামত করার পিছনে?
ঋতুপর্ণা: সিনেমা করলে আমার একটা দায়বদ্ধতা থাকে। একটা সময় শুধু নায়িকা হিসেবে কাজ করতাম। ‘পারমিতার একদিন’, ‘আলো’ করার পর থেকে আমার দায়িত্বটা বেড়ে গিয়েছে। বুঝতে পারি দর্শকের আমার ওপর অনেক আশা-ভরসা। ফিল্ম হল একটা টিমওয়ার্ক। ‘ইচ্ছে’ সে ভাবেই হয়েছে। আমি তো ওখানে অভিনয় করিনি। কিন্তু ছবিটার উপস্থাপনা করেছিলাম। প্রচার করেছিলাম।
পত্রিকা: প্রচারের কাজটা আপনি দারুণ করেন। তবে চিত্রনাট্যের দিকে নজর দেন কি?
ঋতুপর্ণা: পরিচালক আমাকে যে স্ক্রিপ্ট দেয়, সেটার ওপরেই ভরসা করি আমি। শিবু, নন্দিতাদি দারুণ লেখে। একটা প্রপার ন্যারেশন শুনে নিই। তার পর নিজের অভিনয় নিয়ে ভাবি। এবং সেটাই ফুটিয়ে তুলি পরদায়।
পত্রিকা: শুধু নিজের জায়গার স্ক্রিপ্টটা নিয়ে ভাবার কথা বলছি না। গোটা স্ক্রিনপ্লে-র গুণমান নিয়ন্ত্রণ করার কথা ভাবেন? আপনি তো একটা ছবির মুখ...
ঋতুপর্ণা: আমি যে পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছি, আমি বিশ্বাস করি তারা নিজেদের কাজটা জানে। হয়তো আলোচনার মাধ্যমে আইডিয়ার আদানপ্রদান হয়। কিন্তু ওদের সৃষ্টিশীল জায়গাটায় আমি হস্তক্ষেপ করি না।
পত্রিকা: ‘অলীক সুখ’-এর দ্বৈতসত্তার কনসেপ্টটা পরদায় যে ভাবে দেখানো হয়েছে, তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। বলছেন আইডিয়াটা ভাল। কিন্তু পরিচালকদের আরও একটু দক্ষতার সঙ্গে সেটা হ্যান্ডেল করা উচিত ছিল...
ঋতুপর্ণা: আমি কিন্তু সোহিনীর আর আমার দৃশ্যগুলোর জন্য দারুণ ভাল ফিডব্যাক পেয়েছি।
পত্রিকা: কিন্তু অনেকে বলেছেন যে ওই জায়গাগুলো হয়তো আরও পরিণত ভাবে হ্যান্ডেল করা যেত। মনে হয় না যে আপনার এত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে ওই ক্রিয়েটিভ জায়গাতেও ইনভলভমেন্ট প্রয়োজন?
ঋতুপর্ণা: দেখুন এই জিনিসটা পুরোটাই পরিচালকরা করেছে। তবে হ্যাঁ, পজিটিভ কোনও সাজেশন থাকলে আমি নিশ্চিত যে শিবু আর নন্দিতাদি এগুলোর দিকে নজর দেবে। তবে একটা কথা নিশ্চয়ই বলব যে বাংলা ছবিতে এ রকমের কাজ করার সাহসটাকে এনকারেজ করা দরকার। নাটকের অভিনেতাদের নিয়ে আজকের দিনে সিনেমা করাটাও তো একটা বিশাল বড় ব্যাপার। পজিটিভ ক্রিটিসিজম তো আসবেই, তার সঙ্গে চেষ্টাটারও প্রশংসা করা উচিত। এই তো সে দিন প্রিমিয়ার থেকে বেরোতে গিয়ে এক দর্শকের সঙ্গে দেখা। বয়স্ক মহিলা। ‘অলীক সুখ’ দেখে অভিভূত। আপ্লুত হয়ে বললেন: ‘প্রত্যেক দু’সপ্তাহ অন্তর অন্তর আপনার একটা করে ভাল ছবি দেখছি।’
পত্রিকা: এটা কি আপনার স্ট্রাটেজি? এই যে প্রত্যেক দু’সপ্তাহ অন্তর একটা ছবি রিলিজ করা? কনস্ট্যান্ট বোমবার্ডমেন্ট যাকে বলে...
ঋতুপর্ণা: (হা হা) কাজ করতে গেলে একটা তো স্ট্র্যাটেজি লাগেই। তবে এত ছবি একসঙ্গে মুক্তি পাওয়াটা অনেকটাই কাকতালীয়।
পত্রিকা: আমির খানের তিন বছরে একটা ছবি মুক্তি পায়। বিদ্যা বালনের বছরে বড়জোর দু’টো। আপনি কি সেই স্টাইলে বিশ্বাসী নন?
ঋতুপর্ণা: আমির খান একটা ছবি করে সাত থেকে দশ কোটি পান। আর আমরা? তাই অন্য ভাবে অর্থনৈতিক দিকটা আমাদের ভাবতে হয়। কিন্তু একটা কথা বলে রাখা দরকার, কোয়ালিটির কথা মাথায় রেখেই আমি কাজ করি।
|
|
পত্রিকা: কেউ কেউ বলেন যে ঋতুপর্ণার কাছে সংখ্যাটাই প্রাধান্য পায় কারণ উনি জানেন যে ফিল্ম যে রকমই হোক না কেন, নিজের কাজটা উনি ফাটিয়ে করবেনই...
ঋতুপর্ণা: আজকাল অনেক স্ক্রুটিনি করে কাজ করি। তবে চেষ্টা করি পুরনো যাদের সঙ্গে কাজ করেছি তাদের নিরাশ না করতে।
পত্রিকা: এতে তো অনেক সময় মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন। দেওয়ালের এক দিকে আঁতেল ছবির পোস্টার। অন্য দিকে পুরনো ধাঁচের বাণিজ্যিক ছবিতেও আপনি...
ঋতুপর্ণা: একটা গল্প বলি। প্রায় দু’তিন বছর আগে আমি একটা ছবি করেছিলাম। এই সে দিন সেটা মুক্তি পেয়েছে। পরিচালক ফোন করে বলল যে গ্রামে নাকি ছবিটি দারুণ চলেছে। কিছু দিন আগে একটা মাচার শো-তে গিয়েছিলাম। সেখানে তো আমি ইতুপন্না। সেখানকার দর্শক আমার ঋতুপর্ণা নামটাও ঠিক ভাবে উচ্চারণ করতে পারে না। আমি ওদের ভালবাসাটাও হারাতে চাই না। হরনাথ চক্রবর্তী, অনুপ সেনগুপ্ত এঁদের সঙ্গে আগে কত কাজ করেছি। ওঁরা আমাকে যখন ডেকে বলেন তোকে ছাড়া এই ফিল্মটা হবে না, আমি তখন না করতে পারি না। তাই সব দিক সামলে কাজ করি। কোথাও আমি ইতুপন্না, কোথাও আমি ঋতুপর্ণা। তবে হ্যাঁ, আপনি যখন বলছেন যে আমার আরও বেশি সময় দেওয়া উচিত স্ক্রিপ্টে, আমি নিশ্চয়ই সেটা মনে রাখব।
পত্রিকা: কিন্তু আপনার সময় কোথায়? সকালে দিল্লি তো বিকেলে সিঙ্গাপুর...
ঋতুপর্ণা: (হা হা) সবটাই তো কাজের জন্য। সময়টা ঠিক বের করে নেব। সিনেমা আমার প্রায়োরিটি। এ দিকে নজর দিলে যদি আমার ফিল্ম আরও ভাল হয়, তা হলে সেটা নিশ্চয়ই করব।
পত্রিকা: আজকের টলিউডে ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের বাইরে থেকে ছবি করে সাফল্য পাওয়াটাই কি ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের জীবনের অন্যতম বড় লড়াই নয়?
ঋতুপর্ণা: আমার কাছে এটার আর কোনও এফেক্ট নেই। এ ভাবে আমি বেশ ভাল আছি। দশ বছর ভেঙ্কটেশের সঙ্গে কাজ করিনি। কিন্তু তার মধ্যে আমার কত ছবি হিট করেছে দেখুন। ‘আলো’, ‘অনুরণন’, ‘আক্রোশ’, ‘তৃষ্ণা’, ‘তিন কন্যা’, ‘চারুলতা ২০১১’, ‘মুক্তধারা’, ‘মিসেস সেন’, ‘অলীক সুখ’... ওরা যে রকম পরিচালক আর স্টার কাস্ট নিয়ে কাজ করছে সেখানে ভাল ওপেনিং পাওয়াটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমি মুষ্টিমেয় কিছু লোক নিয়ে কাজ করি। আমার হিরোরা হলেন নাইজেল আকারা আর দেবশঙ্কর হালদার। কত নতুন নতুন প্রযোজককে নিয়ে কাজ করেছি আমি। নতুন পরিচালকদের নিয়ে টিম তৈরি করছি। যেমন অগ্নিদেব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে একটা টিম। তার পর শিবু আর নন্দিতাদি। নাইজেল, সমদর্শীর মতো মানুষদের নিয়ে কাজ করেছে ওরা। নতুন এক্সপেরিমেন্ট করেছে। কাজের সমালোচনা হতেই পারে। কিন্তু এটা কি ভেবে দেখেছেন যে সোহিনীর মতো অভিনেতাকে নিয়ে কই আর কেউ তো পনেরো বছরে কাজ করেনি? ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের কর্ণধারদের আমি শ্রদ্ধা করি। তবে আমার কেরিয়ারে ওদের অভাব আমি কোনও দিন ফিল করিনি।
পত্রিকা: আপনি কি টালিগঞ্জে একটা নারীকেন্দ্রিক ‘পাওয়ার-সেন্টার’ তৈরি করছেন?
ঋতুপর্ণা: সাউথ ইন্ডিয়ান রিমেক করে নয়, অরিজিনাল গল্প দিয়ে ছবি বানিয়ে বক্স অফিসে সাফল্য পেতে চেয়েছিলাম। পরিচালকরাও ভাল স্ক্রিপ্ট দিয়েছেন। নতুন টিম তৈরি করেছি। যেখান থেকে রিজনেবল বাজেটে ছবি করেছি। আমাদের ছবির চাহিদা রয়েছে দর্শকের মধ্যে। ফিল্ম হিট করে দর্শককে দিয়ে। তারা ব্র্যান্ড ঋতুপর্ণাকে বিশ্বাস করে। জানে আমি দর্শককে যা উপহার দেব সেটা গ্রহণযোগ্য হবে। |
|
|
|
|
|