ব্যবধানটা মাত্রই কয়েক দিনের। পঞ্চায়েতের পরে রাজ্যের ১৭টি পুরসভার নির্বাচনের দিনক্ষণও ঠিক করে দিল আদালতই। শুধু একটাই পার্থক্য। গত ২৮ জুন রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনের নির্ঘণ্ট ঠিক করে দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। এ দিন পুরভোটের দিন ঠিক করে দিল কলকাতা হাইকোর্ট।
ওই সব পুরসভার নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক করা নিয়ে রাজ্য সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মধ্যে সংঘাত চলছিল। এর মধ্যেই পুরসভাগুলিতে দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়ে হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা করেন আইনজীবী বাসবী রায়চৌধুরী। ওই মামলায় দুই পক্ষকে বৈঠকে বসে বিরোধ মিটিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। কিন্তু দুই পক্ষ বৈঠকে বসেও সমঝোতায় আসতে পারেনি। মঙ্গলবার হাইকোর্ট বিষয়টি জানতে পেরে ক্ষুব্ধ হয়। তারা জানিয়ে দেয়, শুক্রবার একতরফা ভাবে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবে আদালত। এ দিন সেটাই করল প্রধান বিচারপতি অরুণ কুমার মিশ্র এবং বিচারপরি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চ।
পঞ্চায়েত নির্বাচন মামলায় সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিয়েছিল, সংবিধানই মূল কথা। তার উপরে কিছু নেই। পুরভোট নিয়ে তাদের নির্দেশেও সেই কথাই বলেছে কলকাতা হাইকোর্ট। সংবিধানকেই মান্যতা দিয়ে তারা জানিয়ে দিল, যে সব পুরসভার মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছে, সেখানে অবিলম্বে নির্বাচনের মাধ্যমে পুর বোর্ড গঠন করা উচিত। হাইকোর্টের মন্তব্য, “ওই পুরসভাগুলিতে আগেই নির্বাচন হওয়া উচিত ছিল।” মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় ওই ১৩টি পুরসভায় রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই প্রশাসক বসিয়েছে।
রাজ্য গত সপ্তাহে কোর্টকে জানিয়েছিল, তারা ১৩টি পুরসভায় ৭ সেপ্টেম্বর ভোট করতে চায়। কিন্তু ওই দিনে নির্বাচন করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন কমিশনের আইনজীবী লক্ষ্মীচাঁদ বিয়ানি। কমিশনের যুক্তি ছিল, ভোটের জন্য নির্দিষ্ট কিছু প্রস্তুতি নিতে হয়। সে সব সেরে ২১ সেপ্টেম্বরের আগে তারা নির্বাচন করাতে পারবে না। ১৯ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১২টি পুরসভার নির্বাচন হতে পারে বলে কমিশন প্রস্তাব দেয়। সীমা নির্ধারণের কাজ না হওয়ায় মেদিনীপুর পুরসভার নির্বাচন নভেম্বর মাসের আগে করা সম্ভব নয় বলেও জানিয়েছিল কমিশন। নভেম্বরে রাজ্যে আরও চারটি পুরসভার মেয়াদ শেষ হচ্ছে। সেগুলির সঙ্গে মেদিনীপুর পুরসভার নির্বাচন করা সম্ভব বলে কমিশন আদালতকে জানিয়েছিল। |
পুর-তরজা |
আবেদনকারীর বক্তব্য ছিল |
হাইকোর্ট কী বলল |
• পুর নির্বাচনের দিন ঘোষণা
নিয়ে রাজ্য টালবাহানা করছে
• হাইকোর্ট দিন ঘোষণার ব্যবস্থা করুক
• পুর আইনের ১৪ ধারার
৪ উপধারা খারিজ হোক
• ওই উপধারায় মেয়াদ ফুরনোর
পরে প্রশাসক বসানোর ক্ষমতা রাজ্যকে |
• ২১ সেপ্টেম্বর ১২ পুরসভার ভোট
• ওই দিনই অন্য পুরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডের উপনির্বাচন
• ১৬ অগস্ট বিজ্ঞপ্তি
• ২৬ সেপ্টেম্বর ফল
• ২২ নভেম্বর মেদিনীপুর ও চার পুরসভার ভোট
• ১৪ ধারার ৪ উপধারাকে পরে চ্যালেঞ্জ করা যাবে |
|
রাজ্যের তরফে অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চট্টোপাধ্যায় বলেন, রাজ্য চায় সেপ্টেম্বরের ৭ থেকে ১০ তারিখের মধ্যে ভোট হোক। কারণ, ১৭ সেপ্টেম্বর বিশ্বকর্মা পুজো। তার পর থেকেই পিতৃপক্ষ শুরু হয়ে যাবে। তাই সে সময় ভোট হলে মানুষের সমস্যা হবে।
হাইকোর্ট অবশ্য রাজ্যের যুক্তি খারিজ করে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবই গ্রহণ করে। আদালত জানিয়ে দেয়, ২১ সেপ্টেম্বর ১২টি পুরসভার (মেখলিগঞ্জ, হলদিবাড়ি, আলিপুরদুয়ার, বালুরঘাট, ডালখোলা, বর্ধমান, গুসকরা, পানিহাটি, হাবরা, ডায়মন্ড হারবার, চাকদহ ও দুবরাজপুর) নির্বাচন হবে। ওই দিনই কলকাতা-সহ অন্য পুরসভার বিভিন্ন শূন্য ওয়ার্ডে উপনির্বাচন হবে বলেও জানিয়ে দেয় হাইকোর্ট। কমিশনের সুপারিশ মেনে মেদিনীপুর পুরসভা এবং তার সঙ্গে অন্য চারটি পুরসভার (কৃষ্ণনগর, হাওড়া, ঝাড়গ্রাম ও বহরমপুর) নির্বাচনের দিনও এ দিন ঠিক করে দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। ওই নির্বাচন হবে ২২ নভেম্বর।
মহাকরণ সূত্রের খবর, রাজ্য সরকার হাইকোর্টের নির্দেশকে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করবে না। মহাকরণের সূত্রটি বলেন, “বিষয়টি এতই সামান্য যে আমরা সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার প্রয়োজনই দেখছি না।” বিরোধীরা অবশ্য এ নিয়ে রাজ্য সরকারকে বিঁধতে ছাড়েনি। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, “এরা কোনও ভোটই করতে চায় না, তা আবার স্পষ্ট হয়ে গেল। পঞ্চায়েতের পরে পুরভোট নিয়েও আদালতকে নির্দেশ দিতে হচ্ছে। তৃণমূল সরকার মানুষকে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত করতে চায়।”
আদালতের সিদ্ধান্তের পরে কংগ্রেস আবার আদালতের তত্ত্বাবধানে ভোটের দাবি তুলেছে। পঞ্চায়েত ভোটের প্রসঙ্গ তুলে প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান এ দিন বলেন, “শাসক দল কমিশনের তোয়াক্কা না করে পঞ্চায়েত ভোটকে প্রহসনে পরিণত করেছে। পুরভোটে তার পুনরাবৃত্তি আমরা চাই না।” কংগ্রেসের বক্তব্য, আদালতের তত্ত্বাবধানে পুরভোট না হলে ভোট অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হবে না। কমিশনকে এ দিন সে কথা জানানোও হয়েছে বলে মান্নানের দাবি।
কংগ্রেসের এই দাবিকে অবশ্য গুরুত্বই দিতে নারাজ তৃণমূল। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় এ দিন কংগ্রেসের দাবিকে কটাক্ষ করে বলেন, “কংগ্রেস ঠিকই বলছে! এ বার বলবে লোকসভা ভোট চাই সুপ্রিম কোর্টের আওতায়, বিধানসভা ভোট চাই হাইকোর্টের অধীনে আর স্থানীয় স্বশাসিত সংস্থার ভোট চাই স্থানীয় আদালতের নিয়ন্ত্রণে। শতাব্দী প্রাচীন দল বলে কথা!”
যে জনস্বার্থ মামলার জেরে এ দিন কলকাতা হাইকোর্ট পুরভোটের দিন ঠিক করে দিয়েছে, তার আবেদনকারী বাসবী রায়চৌধুরী তাঁর আবেদনে রাজ্য পুর আইনের ১৪ নম্বর ধারার ৪ নম্বর উপধারাটিও খারিজের দাবি জানিয়েছিলেন। ওই উপধারায় বলা আছে, পাঁচ বছরের মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার পরেও কোনও পুরসভার কাজকর্ম চালানোর জন্য ৬ মাসের জন্য প্রশাসক নিয়োগ করা যেতে পারে। সেই মতো মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়া ১৩টি পুরসভায় প্রশাসক নিয়োগ করেছে রাজ্য সরকার।
বাসবীদেবীর আইনজীবী সুব্রত মুখোপাধ্যায় আদালতে জানিয়েছিলেন, রাজ্য পুর আইনের এই উপধারাটি সংবিধানের ২৪৩ ইউ ধারার পরিপন্থী। সংবিধানের ওই ধারায় বলা হয়েছে, পুরসভা কিংবা পঞ্চায়েতের মতো কোনও সংস্থায় পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচন করতে হবে। আর সেই নির্বাচন করাতে হবে সংশ্লিষ্ট পুরসভার পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষের আগেই। এ দিন ডিভিশন বেঞ্চ বলে, “নির্বাচনের দিন ঠিক করাটাই আমাদের কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। তাই আমরা ওই দিন ঠিক করে দিলাম। আবেদনকারী রাজ্য পুর আইনের ১৪ নম্বর ধারার ৪ নম্বর উপধারাটি খারিজ করার যে আবেদন জানিয়েছেন, তা আমাদের কাছে যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে হয়েছে। ওই উপধারাটিকে চ্যালেঞ্জ করে আবেদনকারী পরবর্তী সময়ে মামলা করতে পারেন।” |