|
|
|
|
|
|
|
নাটক সমালোচনা... |
|
ফিরিঙ্গির মঞ্চে প্রত্যাবর্তন
কবিয়াল অ্যান্টনি। ‘পূর্ব পশ্চিম’ নাট্য দলের নতুন নাটক
তাঁকে নিয়েই। মহড়া দেখলেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায় |
এ যেন অনেকটা টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের মাঝে হঠাৎ করে টেস্ট ম্যাচ দেখে ফেলা। ঠিক এমন ঢঙেই মঞ্চে ফিরতে চলেছে ‘অ্যান্টনি কবিয়াল’।
চারদিকে যখন ধাক্কাধাক্কি, লাফালাফি, একটা নিস্তরঙ্গ সময়ের হাওয়া যেন কোত্থেকে ভেসে এল হঠাৎ করেই!
ব্রাত্যজন-য়ের ‘সিনেমার মতো’। ‘নান্দীকার’য়ের ‘নাচনী’। স্বপ্নসন্ধানী-র ‘থানা থেকে আসছি’।
এই তিনটে নাটককেও যদি বেছে নেওয়া যায়, একটা সাধারণ ছবি কিন্তু স্পষ্ট। গ্রুপ থিয়েটার তার পুরনো ধাঁচ, ছক ছেড়ে বেরচ্ছে প্রতিদিন। ফর্ম নিয়ে চলছে ভরপুর ভাঙচুর। বিষয় নিয়ে হাজারটা পরীক্ষানিরীক্ষা। পুরনো নাটক ফিরলেও সমকাল থেকে বুনে দেওয়া হচ্ছে সংলাপ। ঠিক এমন একটা সময় কবিয়ালকে নিয়ে নাটক করতে চলেছে ‘পূর্ব পশ্চিম’ নাট্য দল।
চোখকান বুজে বলে দেওয়া যায় ব্যাপক ঝুঁকি নিলেন, বিশাল মাপের ফাটকা খেললেন তাঁরা। কিন্তু এও সত্যি, এ খেলায় জেতা মানে বাংলা নাটকে একটা বড়সড় মাইলস্টোনের জন্ম দেওয়া। |
নাটকে গার্গী রায়চৌধুরী ও অনির্বাণ ভট্টাচার্য। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল |
এ নাটকের সূত্রেই ছ’বছর বাদে মঞ্চে ফিরছেন অভিনেত্রী গার্গী রায়চৌধুরী। গার্গী এখানে সৌদামিনী। কবিয়ালের ঘরণী। ‘পিরীতি পরমনিধি’র পর সুকণ্ঠী গার্গীর সামনে আবার এক বড় মাপের চ্যালেঞ্জ এই ‘সৌদামিনী’। মহড়ায় শরীরী বিন্যাস, চোখের খেলা, নিখুঁত স্টেপিং-য়ে সৌদামিনীর প্রতি তাঁর যত্ন ধরা পড়ছিল বার বার। কবিয়াল হয়েছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। অসম্ভব সুকণ্ঠ তাঁরও।
উনিশ শতকে পর্তুগিজ হ্যান্সম্যান অ্যান্টনি যখন এ দেশে আসেন নাটকের শুরু সেই সময়কাল থেকেই। এর পর তাঁর বাংলা শেখা, হিন্দু বিধবা ব্রাহ্মণী সৌদামিনীর প্রেমে পড়া, তাঁর সঙ্গে ফরাসডাঙ্গায় সংসার পাতা, ধীরে ধীরে অ্যান্টনির কবিয়াল হয়ে ওঠা, ভোলা ময়রার সাক্ষাৎ পাওয়া, কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করা। অসংখ্য ঐতিহাসিক কাহিনির মোড় পেরিয়ে এগিয়েছে নাটক। কিন্তু শেষমেশ ইতিহাস নয়, এ নাটকের রাশ থাকে প্রেমের হাতে। অ্যান্টনি আর সৌদামিনীর প্রেম। আর ধীরে ধীরে এই প্রেম এক সময় হয়ে যায় পূজার মন্ত্র, দেবতার নৈবেদ্য। একীভূত হয়ে যান কালীর সঙ্গে মা মেরী।
‘পূর্ব পশ্চিম’ সৌমিত্র মিত্রর হাতে গড়া হলেও দলের দশম প্রযোজনায় এই প্রথম বার পরিচালনায় তিনি। অভিনয়ও করছেন নাটকটির সূত্রধরের ভূমিকায়।
পরিচালনায় প্রথম, কিন্তু গোড়াতেই সৌমিত্র বেশ সাবধানী, সেটা ওঁর প্রোডাকশনের লাইনআপ দেখলেই বোঝা যায়। শিল্প নির্দেশনায় ইন্দ্রনীল ঘোষ। আবহ মুরারী রায় চৌধুরী। থিয়েটারপ্রেমীকে এ দুই নামের গুরুত্ব ধরিয়ে দিতে লাগে না। কোরিওগ্রফিতে এনেছেন সুকল্যাণ ভট্টাচার্যকে। যে সুকল্যাণ দিনকতক আগে গিরীশ করনাডকেও নাচের তালিম দিলেন। এ নাটকে সুকল্যাণ লোকজন নিয়ে মঞ্চে কখনও পালতোলা নৌকো ভাসাবেন, কখনও ঘোড়ার রথ টানাবেন। আর মিঠে আলোয় রঙে তাকে স্বপ্নালু করে তুলবেন সুদীপ সান্যাল। পোশাকে আছেন মালবিকা মিত্র। |
ভোলাময়রা রজত গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে সপত্নী কবিয়াল |
নাটকে বড়সড় ভূমিকা গানের। সংখ্যায় প্রায় চোদ্দো-পনেরো। ‘পিরীতি পরমনিধি’র পর নান্দীকারের ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ বাদ দিলে এত গান বাংলা নাটকে বহু কাল আসেনি। তাও আবার একই ঘরানার গান নয়, নানান অঙ্গের। টপ্পা, কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, ছড়া গান...। সুর করেছেন থিয়েটারের আর এক প্রাজ্ঞজন ধীরেন দাস।
তরজা আছে, কবিয়াল আছেন আর ভোলা ময়রা থাকবেন না, তা তো হয় না। অ্যান্টনি নিয়ে যাঁরাই কাজ করেছেন কবিয়ালের জীবনে ভোলা ময়রার গুরুত্ব তাঁরা বুঝেছেন। মঞ্চে এর আগে যেমন বুঝেছিলেন বিধায়ক ভট্টাচার্য বা শেখর সমাদ্দার। এ বার নাট্যকার উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়-পরিচালক সৌমিত্র মিত্র জুটি।
এ নাটকের ভোলা ময়রা প্রবীণ অভিনেতা রজত গঙ্গোপাধ্যায়। সিরিয়াল, মঞ্চের অতি চেনা মুখ রজত এক সময় সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন ‘পিরীতি পরমনিধি’র নিধুবাবু হয়ে। এ বারও তাঁর সংলাপে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে গান। পায়ে ঘুঙুর বেঁধে গানে, কথায়, কখনও কবিয়ালের সঙ্গে লড়াইয়ে নামেন ভোলা, কখনও বা হেরে গিয়েও বুকে জড়িয়ে ধরেন তাঁকে। আশীর্বাদ করেন প্রাণভরে।
এমনই এক দৃশ্যর মহড়া দেখতে দেখতে মনে হল, এটাই বোধ হয় সরল রসে টইটম্বুর জীবনের ধারাপাত, যার মধ্যে আকুল করা ভালবাসাই শুধু তির তির করে বয়ে যায়। শান্ত নদীর মতো। এ বয়ে চলায় ভাঙন নেই, ফুঁসে ওঠা আক্রোশ নেই, নেই ক্লেদ, ক্লিন্নতা। আছে শুধু মুগ্ধ চোখের কোমল চাওয়া। ভিন্ন এক সময়ে দাঁড়িয়ে সেই কোমলতাকে আশ্রয় করে দর্শককে ছুঁতে চাইছে পূর্ব পশ্চিমের ‘অ্যান্টনি-সৌদামিনী’। |
|
|
|
|
|