হাঁড়ির খবর
পাস্তার তিন অবস্থা
যার নেই রাস্তা, তার আছে পাস্তা! বাঙালির শহুরে প্রবাদমালায় এই স্লোগানটা প্রায় ঢুকে পড়েছে আর কী! সে কলকাতা হোক বা দেশে-বিদেশে যে কোনও শহর কি মফস্সলের একলাটে সন্ধে— কোনও রান্নাগবেট পুরুষ বা নারী পর্যন্ত ল্যাপটপে কাজ সারতে সারতে রেডিমেডমশলাসমেত প্যাকেটের পাস্তা ঢেলে মুহূর্তে তাঁর নৈশাহার সাজিয়ে ফেলতে পারেন। স্রেফ প্যাকেটের নির্দেশগুলো মানলেই হল। চাইলে ক্যাপসিকামজাতীয় কিছু পছন্দের সব্জি বা চিকেন-মাশরুমও যোগ করা সম্ভব। জীবনধারণের জন্য এ ব্যবস্থা হয়তো চলনসই, এক-একদিন স্বাদটাও সয়ে যায় ঠিকই কিন্তু প্রকৃত পাস্তাপ্রেমীর পক্ষে পাস্তার এমন অবমাননা মানতে কষ্ট হয়।
আর এক দল পাস্তাখোর আছেন, যাঁরা রেস্তোরাঁয় ঢুকলে যা-ই খান পাস্তার খোঁজ করবেনই। নিজেরা খাবেন বলে কিন্তু নয়, বাচ্চাদের শান্ত রাখতে। বাড়িতে রান্নার সময় নেই, প্যাকেটের চটপটা নুড্ল্স-পাস্তা বেড়ে দিয়েই পরবর্তী প্রজন্মকে অভ্যেস করিয়েছেন, মাছভাত খাওয়া ধরানো হয়নি এদের জন্যই নেমন্তন্ন-বাড়ির বুফেতেও বেখাপ্পা ভাবে পাস্তা ঢুকে পড়েছে। নুড্ল্স-আকৃতির স্প্যাগেটি কিংবা বাঁশের কঞ্চির মতো পেনে পাস্তা থকথকে টমেটো বা চিজ সসে সপসপে হয়ে পাতে হাজির হচ্ছেন। বাচ্চারা সহজে খুশ তো, মা-বাপ ভি খুশ! এই দুই গোষ্ঠীর বাইরে তৃতীয় দলও আছে। যারা পাস্তার যথার্থ সমঝদার। এবং পাস্তার বহুল পরিচিতি সত্ত্বেও তাঁরা কলকাতায় প্রকৃত পাস্তা এখনও দুর্লভ বলে হা-হুতাশ করেন। শেফ মৈত্রেয় সেনও পাস্তার অপমানে ব্যথিত হন। তাই হায়াত রিজেন্সি-র ইতালিয়ান রেস্তোরাঁ লা কুচিনা-য় খাঁটি পাস্তা কাকে বলে তা বোঝাতে তিনি আদাজল খেয়ে নেমেছেন। ঘটনা হল, বাড়ির রান্না ঘরোয়া পাস্তা যিনি একবার খেয়েছেন, তিনিই বুঝবেন প্যাকেটের রেডি-টু-ইট পাস্তার সঙ্গে তুলনায় তা কোনও মাপে আসে না।
ডিম-ময়দার মিশেলে তরিবত করে এই বঙ্গসন্তান তাই নানা আকৃতির পাস্তা গড়েন। তর্তেলিনি বা রাভিওলির পেটে ঠেসে দেন মানানসই মাংস কি চিজ-সব্জির পুর। কাভাতেলির চেহারাটা অনেকটা পুলি পিঠের মতো। গোদুগ্ধের চিজ রিকোতা দিয়ে তৈরি। লা কুচিনা-য় কাভাতেলি হাড় থেকে খসে পড়া সুসিদ্ধ ল্যাম্ব ও রেড ওয়াইন সসের বিছানায় শুয়ে পাতে এলে তা মোটেও সাহেবদের দেশের আলুনি রান্না বলে মনে হয় না। বরং রেডমিট বিলাসী বাঙালির মনে একটা বীররসের সঞ্চার ঘটে। কাভাতেলি-র এই পদটা ইতালির শিয়ান্তি এলাকার লাল আঙুরের মদিরার সঙ্গেও বেশ যায়। ফ্লেভারময় পাস্তার সঙ্গে অন্য ধরনের কড়া পানীয় ঠিক চলে না। কিন্তু হাল্কা কষাটে ওয়াইনের সঙ্গে পাস্তা বেড়ে খোলে। তবে বলা বাহুল্য, যে-সে পাস্তা নয়, পাস্তার মতো পাস্তা হতে হবে। লা কুচিনার মেনুতে শেফের হাতে-গড়া নানা কিসিমের পাস্তার ছড়াছড়ি।
বছরখানেক আগে মৈত্রেয় ইতালিতে লম্বা সফর করে একেবারে পাস্তার আঁতুড়ঘরে নাড়া বেঁধেছেন। ইতালিয়ান ঠাকুমা-দিদিমাদের রান্না খেয়ে বুঝেছেন আসলি পাস্তা কেমন খেতে। এ সব শিক্ষা কাজে লাগিয়েই চলছে নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। লা কুচিনার ওপেন কিচেনের মঞ্চে মৈত্রেয়র হাতে ধ্রুপদী ইতলিয়ান রান্না স্প্যাগেটি কারবোনারা তাই পাল্টে গিয়েছে। হাতে গড়া চৌকো আকৃতির রাভিওলি পাস্তার থলেয় ক্রিম ও ডিমের কুসুমের মিশেল নিপুণ কায়দায় ভরে দেওয়া হয়েছে। ধবধবে পারমেজান চিজের সসে এই রাভিওলি কারবোনারার সঙ্গে মোক্ষম সঙ্গত করছে মাংসখণ্ড পানচেতা। পানচেতা বেক্নেরই তুতো ভাই। কিন্তু বেক্নের মতো গুরুপাক নয়। রাভিওলির সঙ্গে হাল্কা নির্ভার সসে নোনতা মাংসখণ্ডটি একটা অন্য মাত্রা জুড়ছে যেমন, নিস্তরঙ্গ গেরস্ত জীবনে প্রেমের অভিঘাত। উত্তর ইতালির লোমবার্ডিতে ছবির মতো মাজিওরে হ্রদের ধারে একটি পাহাড়ি গ্রাম রান্কোয় বসে এই রান্না শিখেছিলেন মৈত্রেয়। সে-গ্রামে পুটুস, ঘেঁটু ফুলের মতো ঝোপেঝাড়ে রোজমেরি-থাইমের লতা ফুটে থাকে। হাত দিয়ে ছিঁড়লে, হাতে সুগন্ধ থেকে যায়।
কলকাতায় ঘরোয়া পাস্তা নিয়ে নানা চর্চা শুরু হয়েছে। গমের ময়দার বদলে পানিফল, সাবু ইত্যাদির প্রয়োগের কেউ কেউ পাস্তা গড়ার চেষ্টা করছেন, কারও লক্ষ্য ময়দার গ্লুটেনমুক্ত পাস্তা সৃষ্টি কিন্তু ডিম-ময়দার মিশেলের পাস্তাই সব থেকে সেরা বলে মনে করেন বেশির ভাগ শেফ। তাতে না কি সস ও পাস্তার প্রেমটা আরও বেশি মাখো-মাখো হয়। আবার রিকোতা চিজের কাভাতেলির মতো আলু বা কুমড়োর পাস্তা নকি(gnocchi) কারও কারও বেশি মুখে রোচে। তুলনায় শাকাহারীদের মধ্যেই এ তল্লাটে পাস্তার বেশি কদর। তাদের কথা ভেবে লা কুচিনা-র রবিবাসরীয় ব্রাঞ্চের এলাহি মেনুতে চার-পাঁচ রকম নিরামিষ পাস্তা রাখা হয়। আমিষ পাস্তারা কিছুটা সংখ্যালঘু সেখানে। চিকেন বা মাশরুমাদির পাস্তার সঙ্গী হিসেবে সবুজ আঙুরের কোনও হোয়াইট ওয়াইনই ভাল যাবে, রেড মিটের সঙ্গে রেড ওয়াইন।
থাক থাক পাস্তার ফালির মাঝে ঠাসা বিফ কি ল্যাম্বের রাজসিক লাজানিয়া কিংবা অনেকটা আমাদের রোলের আকারের কানেলনিতে ঠাসা মৃদুভাষী চিকেনে পাস্তার অজস্র রূপ। তর্তেলিনির চেহরায় মোমোর আদল। আবার কাপেলিনি যেন একটু কুঁকড়ে যাওয়া গোলাপ ফুল। সাধারণত কফিশপ বা ফুডকোর্টের পাস্তায়, পাস্তার বিচ্ছুরণ বোঝা শক্ত। কিন্তু কুকিজারের রেস্তোরাঁ মান্জিও কি ফোরামের স্প্যাগেটি কিচেনে উঁচু দরের পাস্তা মিলবে। পুরঠাসা পাস্তার বাইরে নামী ব্র্যান্ডের স্প্যাগেটি, লিঙ্গুইনি গোছের পাস্তাও মন্দ নয়। লা কুচিনায় নুড্ল্স আকৃতির লিঙ্গুইনি পাস্তা ‘ফ্রুটি ডি মেয়ার’ বা সমুদ্রের শস্যের সঙ্গে পেশ করা হয়। সামুদ্রিক চিংড়ি, লবস্টার, কাঁকড়ার স্টক মিশে তেজি সসটায় চেরি টমোটো চিপে চিপে খেতে টাকরায় দারুণ আরাম। আর প্রতি চামচে চিংড়ি, স্কুইড, ভেটকি তো আছেই! ঘরোয়া পুর-ঠাসা পাস্তার এখনও এ শহরে খুব সহজে দেখা মেলে না ঠিকই, কিন্তু দোনাদোনি-মালদিনিদের মতো তর্তেলিনি-কাভাতেলি-কানেলনিদের সঙ্গে রসিক বাঙালির আলাপ গাঢ় হওয়াটাও জরুরি দরকার।

ছবি: শুভেন্দু চাকী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.