|
|
|
|
|
|
ব্যাগ গুছিয়ে...
|
পাতালপুরীর হাতছানি
হাজার হাজার বছরের জমে থাকা প্রাগৈতিহাসিক পাথরের খাঁজে
চোখ-ঝলসানো
হীরকদ্যুতি। কখনও যেন মণিখচিত ঝাড়বাতির রূপ,
আবার কখনও
বা নানান প্রাণীর পাথুরে অবয়ব। ঘুরে এলেন শৈবাল দাস |
|
‘চিচিং ফাঁক, চিচিং’! গলা থেকে আর আওয়াজ বেরোল না, অন্ধকার স্যাঁতসেতে পাতালপুরীর গুহার ভিতর থেকে কারা যেন হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসছে! সঙ্গী গাইডের ক্ষিপ্র ইশারায় গুহামুখে উবু হয়ে বসে পড়লাম সবাই। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার কয়েক মুহূর্ত। ‘দূর ছাই, কেন যে মজা করতে গেলে!’ কে যেন ফিসফিসিয়ে ধমক দিল, ‘গুহামুখ তো ফাঁকই ছিল!’ মাথার ওপর দিয়ে তখন উড়ে যাচ্ছে শয়ে শয়ে বাদুড়ের দল। ঘন অন্ধকারে পেট্রোম্যাক্সের আলো জ্বালাতেই এ বার তারা সরে পড়ল নিমেষে অন্ধকার গহ্বরে...।
|
|
কে বলবে, বাইরে তখন রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের মধ্যলগ্ন। একটু আগেই ঘন সবুজ অরণ্যের শাখাপ্রশাখায় সূর্য কী অপূর্ব লুকোচুরি খেলছিল। গাড়িতে বসে থাকায় সারা মনে তখন অরণ্যের অনন্য উত্তেজনা চলন্ত শেয়ালকেও বন্যকুকুর ভ্রমি! কিন্তু গাড়িতে বসে কি অরণ্য উপভোগ করা যায়? এ দিকে কাঙ্গের ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের প্রায় ২০০ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ জঙ্গলে তেঙ্গু, হলদু, বিজা, মহুয়া ছাড়াও বহু চেনা-অচেনা সমৃদ্ধ গাছের কাছে পৌঁছতে হলে, লেপার্ড, গাউর, ভালুকদের নিরাপদ দূরত্ব থেকে দর্শন পেতে হলে চার চাকাই যে ভরসা! কাঙ্গের নদীর নয়নভোলানো প্রবাহপথ ধরেই এই সঘন-সবুজ উপত্যকার বিস্তৃতি। এখানে গাড়ি থেকে নামতেই এক ঝলক জলজ বাতাস যেন সারা দেহ-মন ভিজিয়ে দিল! একজোড়া বাঁশপাতি পাখি ঠোঁটে-ঠোঁটে বসন্ত উপভোগ করছে বাঁশগাছের নীচে জমে থাকা বাঁশপাতারই নরম বিছানায়!
গাছ বলে, ‘আমি বর্ণময়’! পাখি বলে, ‘ধুস! চোখ জুড়ানো প্রকৃতি এখানে সারা দিন দিলখুশ’! প্রাকৃতিক মুক্ত বনচ্ছায়ায় এই অরণ্যের বিখ্যাত পাখি ময়নামাঝে মাঝেই দেখা যাচ্ছে ইতিউতি। জগদলপুরে বন দফতরের অফিস থেকে এই ন্যাশনাল পার্কে ঢোকার কাগজপত্র সংগ্রহ করার সময়েই দেখে নিয়েছিলাম এই পাহাড়ি ময়না প্রজননের কী দারুণ কর্মকাণ্ড চলেছে এখানে। প্রাকৃতিক পরিবেশে বিশালকায় খাঁচার ভিতর তাদের জীবনপ্রবাহ।
জগদলপুর থেকে এই ন্যাশনাল পার্কের দূরত্ব ২৯ কিলোমিটার। জাতীয় উদ্যানের প্রবেশপথেই চেকপোস্টে কাগজপত্র জমা দিয়ে গাইড, সৌর লন্ঠন ইত্যাদি নিয়ে আবার পথ চলা গহন জঙ্গলের ভিতর প্রায় ১০ কিলোমিটার। ভারতের গুটিকয়েক আদিম অরণ্যের মধ্যে অন্যতম প্রাচীন অরণ্যের ভিতর তখন বার্কিং ডিয়ারের ‘মেটিং কল’ চার পাশের স্তব্ধতাকে খানখান করে দিচ্ছে। |
|
গাড়ির পথ যেখানে শেষ, সেখানেই এক রোমাঞ্চকর অরণ্যপথ হঠাৎ তলিয়ে গিয়েছে আদিম প্রাকৃতিক কুটুমসর গুহাগর্ভে, যে ঘটনা দিয়ে এই কাহিনির শুরু। পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে গাইড রাজুকে সঙ্গী করে মাথা-ঠোকাঠুকি গুহাপথে ঢুকতেই বাদুড়ের বোঁটকা গন্ধ নাকে ধাক্কা দিল। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে পেট্রোম্যাক্সের জোরালো আলোয় গুহার ভিতর তখন ক্ষণে ক্ষণে তৈরি হচ্ছে অবর্ণনীয় পাথুরে ঐশ্বর্য! হাজার হাজার বছরের জমে থাকা প্রাগৈতিহাসিক পাথরের খাঁজে চোখ-ঝলসানো হীরকদ্যুতি। কখনও যেন মণিখচিত ঝাড়বাতির রূপ, আবার কখনও বা নানান প্রাণীর পাথুরে অবয়ব। পাথরের গা বেয়ে তিরতির করে বয়ে-চলা জলপ্রবাহের ভিতরে যেন সোনার কুমির আশ্চর্য ভাবে ওত পেতে আছে শিকারের অপেক্ষায়। আঁকাবাঁকা গুহার পথে জায়গায় জায়গায় যেন পাথুরে অস্ত্রাগার!
অপূর্ব রূপ আর রোমাঞ্চে সকলেই তখন বাক্যহারা! হাতে হাতে ধরা উঁচু টর্চ তখন গুহার ছাদে কাটাকুটি খেলছে নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশায়।
বেশি দিন নয়। ১৯৫৮-তে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের পরে এই অরণ্যগুহার আবিষ্কার। তার পরেই সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয় এই পথ। তার আগে কিছু দুঃসাহসী স্থানীয় অধিবাসীই শুধু মশাল জ্বালিয়ে এই গুহায় ঝুঁকি নিয়ে ঢুকত স্রেফ বাদুড় শিকারের জন্য। ২৫০ মিটার দীর্ঘ পাতালগুহায় ঝিম ধরানো অ্যাডভেঞ্চারের পরে যখন বেরিয়ে এলাম তখন বাইরের উদ্দাম আলোর পৃথিবী যেন একগাদা তাজা বনজ অক্সিজেনই ঢেলে দিল আমাদের সারা শরীরে, মনে! |
|
এই জাতীয় উদ্যানের প্রবেশপথের ঠিক বিপরীত পথেই আর এক প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য! মাত্র তিন কিমি চললে আদিবাসী অধ্যুষিত তিরথগড় গ্রাম। অরণ্য-লাগোয়া এক গ্রাম্যপথ ধরে যাওয়ার সময় ছোট্ট এক নদীর সঙ্গে পরিচয় ঘটবেই। মুঙ্গাবাহার নদী। ক্ষীণতোয়া এই বাহারি নদীকে দেখে কে বলবে, সে-ও জন্ম দিতে পারে স্নিগ্ধ উতলা এক ছন্দকে। প্রায় ১১০ ফুট ওপর থেকে এই নদী মোহময়ী হয়ে ছন্দে ছন্দে নেমে আসছে তিরথগড় জলপ্রপাত হয়ে। সুঠাম পাথুরে দেওয়ালের সাধ্য কি তাকে সামলায়! পাথুরে পাহাড়ে বেষ্টিত আর তিনটি ধাপে বিভক্ত এই জলপ্রপাতের নিজস্ব রূপ আরও বর্ণময় হয়েছে তার চার ধারের আরণ্যক সৌন্দর্যের দানে। প্রথম ধাপের নীচ থেকে সুন্দরকে উপভোগ করা গেলেও ধাপে ধাপে একদম নীচে নেমে, সুন্দরী এই ঝরনাধারার নীচে মুক্ত হয়ে এক বার দাঁড়িয়ে পড়লেইউফ্! বাহ্! ধারাস্নান আর কাকে বলে!
|
কী ভাবে যাবেন |
মুম্বই মেল, আমদাবাদ/আজাদহিন্দ এক্সপ্রেস-সহ হাফ ডজন
গাড়ি যায় রায়পুর হয়ে। রায়পুর থেকে বাসে বা প্রাইভেটে জগদলপুর। |
কখন যাবেন |
গ্রীষ্ম আর বর্ষা ছাড়া যে-কোনও ঋতুতেই যাওয়া যায়। গুহা খোলা থাকে
নভেম্বর থেকে জুন। গুহায় ঢোকার সময় জল আর টর্চ নিতে কিন্তু ভুলবেন না। |
কোথায় থাকবেন |
জগদলপুরে একাধিক ভাল মানের থাকার হোটেল আছে। |
|
|
|
|
|
|
|